ক্রাইমবার্তা রিপোট: রাত এগারোটারও একটু পরে যে ফ্লাইটটি লন্ডন থেকে নামল, সেখানে ছিলেন এমন একজন যাত্রী – যিনি দিল্লিতে পা রাখুন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তা একেবারেই চাইছিল না।অথচ তার কাছে ভারতের বিজনেস ভিসা ছিল। যে কারণে ভারতের ফ্ল্যাগশিপ ক্যারিয়ার এয়ার ইন্ডিয়াও তাকে বিমানে উঠতে দিয়েছিল বিনা বাধাতেই।প্রবীণ, সত্তরোর্ধ্ব ওই ভদ্রলোকের নাম লর্ড অ্যালেক্সান্ডার কার্লাইল।
ব্রিটেনের হাউস অব লর্ডসের প্রবীণ সদস্য তিনি, বিশিষ্ট আইনজীবীও। তবে তার আর একটি পরিচয়, বাংলাদেশে কারাবন্দী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী হিসেবেও নিযুক্ত হয়েছেন সম্প্রতি, আর সে কাজের সূত্রেই তার দিল্লিতে পা রাখা।
আসার দিনকয়েক আগেই তিনি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, খালেদা জিয়াকে কীভাবে ‘সাজানো মামলা’য় ও ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ হেনস্থা করা হচ্ছে, দিল্লিতে এসে সংবাদমাধ্যমের কাছে সেসব তুলে ধরাই তার উদ্দেশ্য।
তার বাংলাদেশের ভিসার আবেদন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলেই তিনি ঢাকার পরিবর্তে দিল্লিতে এসে ওই সংবাদ সম্মেলন করতে চান, এমনটাও জানিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু এ খবর জানাজানি হওয়ার পর থেকেই দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে যে ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছিল, তাও ছিল নজিরবিহীন।
বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য ছিল, লর্ড কার্লাইল যদি দিল্লিতে এসে খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে কথা বলেন তাহলে সেটা হবে দিল্লির মাটিতে দাঁড়িয়ে একটা ‘ পেইড পলিটিক্যাল ক্যাম্পেন’ – অর্থাৎ পয়সা নিয়ে চালানো রাজনৈতিক প্রচারণার সামিল।
ভারত যে এভাবে ‘তাদের মাটিকে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারে’ কাজে লাগাতে দিতে পারে না, ঢাকার সেই মনোভাবও দিল্লির কাছে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল।
ভারতে ঢুকতে না পেরে লর্ড কার্লাইল লন্ডনে ফিরে গিয়ে সেখান থেকে একটি ভিডিও কনফারেন্সিং করেছেন। সেখানে তিনি দিল্লির সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনারকে তলব করে এ ব্যাপারে তাদের তীব্র আপত্তির কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন।
সেটা সত্যি হোক বা না-হোক, ঘটনা হল দিল্লিতে লর্ড কার্লাইলের পরিকল্পিত কর্মসূচী প্রায় প্রথম থেকেই বাধার মুখে পড়ে।
যেমন প্রথমে স্থির ছিল, ১৩ জুলাই দিল্লির ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাবে (এফসিসি) তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করবেন।
কিন্তু ওই একই দিনে কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত এফসিসি-তে আসছেন, এই যুক্তি দেখিয়ে তারা লর্ড কার্লাইলের বুকিং বাতিল করে দেয়। বাধ্য হয়ে তিনি দিল্লির একটি পাঁচতারা হোটেলে বিকল্প ভেন্যুর ব্যবস্থা করেন – সংবাদ সম্মেলনও একদিন এগিয়ে আনা হয়। কিন্তু বুধবার রাতে দিল্লি বিমানবন্দরে আরও নাটকীয়তা বাকি ছিল।
লর্ড কার্লাইলের ভাষ্য অনুযায়ী, “আমি যখন দিল্লিতে নেমে আমার ফোন অন করলাম, দেখি আমার ভিসা বাতিল করা হচ্ছে বলে আমাকে মেসেজ পাঠানো হয়েছে। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আমাকে জানানো হল আমাকে ভারতে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।”
“সত্যি কথা বলতে কি, ইমিগ্রেশনের কর্মীরা খুবই ভদ্র ও বিনীত ছিলেন, তারা আমার সঙ্গে এমনিতে খুবই সুন্দর আচরণ করেছেন। কিন্তু তাদের কাছে কোনও জবাবই ছিল না যে কেন আমাকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না,”ভিডিও সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন লর্ড কার্লাইল।
ভারতের জবাব অবশ্য এসে যায় এর কিছুক্ষণের মধ্যেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার জানিয়ে দেন, “লর্ড কার্লাইল যে কারণ দেখিয়ে ভিসার আবেদন করেছিলেন – আর তার সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য -এসবের মধ্যে কোনও সাযুজ্য নেই বলেই আমরা তার ভিসা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
পরে বিকেলে তিনি আরও যোগ করেন, “লর্ড কার্লাইল ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন – এমন সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।”
এমনকী তিনি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধী দলের (বিএনপি) সম্পর্কেও সন্দেহ তৈরি করতে চাইছেন বলে রবীশ কুমার দাবি করেন।
ওই মুখপাত্র আরও জানান, লর্ড কার্লাইল খুব ভাল করেই জানতেন তাকে ফিরে যেতে হবে – সে কারণেই তিনি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানের ‘রিটার্ন বোর্ডিং পাস’ নিয়েই এসেছিলেন।
যদিও এই যুক্তির সঙ্গে ব্রিটিশ আইনসভার প্রবীণ সদস্য একেবারেই একমত নন।
লন্ডন থেকে বৃহস্পতিবার সকালে তিনি বলছিলেন, হিথরোতে তার ভারতীয় ভিসা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অন্তত দুবার চেক করা হয়েছিল – কিন্তু তাতে কোনও অসঙ্গতি পাওয়া যায়নি।
ভারত সরকারকে রাজি করিয়ে দিল্লিতে ঢোকার ব্যবস্থা করা যায় কি না, সে জন্য লর্ড কার্লাইল দিল্লি বিমানবন্দর থেকে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনারকেও ফোন করেছিলেন।
কিন্তু লর্ড কার্লাইলের দাবি অনুযায়ী, তিনিও এ ব্যাপারে তার অসহায়তা ব্যক্ত করেন – এবং পরিষ্কার জানিয়ে দেন ভারতের সিদ্ধান্ত নড়চড় হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
এর কিছুক্ষণ পরই তাঁকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লন্ডনগামী ফিরতি বিমানে উঠিয়ে দেওয়া হয়।
লন্ডনে নামার মাত্র দুঘন্টার মধ্যেই স্কাইপ কলে তিনি দিল্লির মিডিয়ার সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে মিলিত হন।
লর্ড কার্লাইল সেখানে বলেন, “ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি আমার শ্রদ্ধা চুরমার হয়ে গেছে। রাজনৈতিক চাপের মুখে তারা যেভাবে নতি স্বীকার করলো এবং সত্তর বছর বয়সী একজন পার্লামেন্টারিয়ানের সঙ্গে যে আচরণ করল তাতে তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত, কৈফিয়ত দেওয়া উচিত।”
তিনি পুরো বিষয়টি লন্ডনে খুব শিগগিরি বিস্তারিত সাংবাদিক সম্মেলন করে জানাবেন বলেও জানান।
ভারতের বিমানবন্দরে যে অল্প কিছুক্ষণ তিনি ছিলেন, সেখানে শুধুমাত্র একজন তরুণ পোর্টার তাকে অসম্ভব সাহায্য করেছিল বলেও যোগ করেন লর্ড কার্লাইল। “ভারতে ওই একজন মাত্র লোকের ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে”।
সাকুল্যে তিনি দিল্লির মাটিতে ছিলেন তিন ঘন্টা। কিন্তু ওই তিনটি ঘন্টাকে ঘিরে ভারত, বাংলাদেশ এবং সম্ভবত যুক্তরাজ্যের সম্পর্কেও যে পরিমাণ তোলপাড় হয়ে গেল – তেমন নজির খুব কমই আছে!