ক্রাইমবার্তারিপোট:বিলুপ্তপ্রায় চ্যাং (টাকি), শোল, কই, চিতল এবং রুই মাছের প্রজাতি টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে সাতক্ষীরার জাকির হোসেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স জাকির হোসেন কোন চাকরির পিছনে না ছুটে বাণিজ্যিকভাবে দেশী মাছ চাষে সাফল্য পেয়েছেন। জানা গেছে, এক কাঠা এবং মাত্র পাঁচ কাঠা আয়তনের দুটি পুকুরে দেশি জাতের শোল মাছের চাষ করেছেন তিনি। কম খরচে এক বছরে পাঁচ কাঠা জমিতে একটন শোল মাছ উৎপাদন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। দেশি জাতের মাছ যেখানে হারিয়ে যেতে বসেছে সেখানে শহরের পুরাতন সাতক্ষীরার জাকির হোসেন শোল মাছ চাষ করে সবার নজর কেড়ে নিয়েছেন। তার শোল মাছ চাষে সাফল্য দেখে সাতক্ষীরা জেলার অনেক বেকার যুবক বিলুপ্ত প্রায় কই, শোল, চিতল, ফলুই মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় প্রতিবছর গড়ে এক লাখ ৩১ হাজার ৫১৬ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। জেলায় মাছের চাহিদা ৪২ হাজার ২৯৩ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত ৮৯ হাজার ২২৩ মেট্রিক টনের মধ্যে একাংশ বিদেশে রপ্তানি এবং অবশিষ্ট মাছ দেশের অন্যান্য এলাকায় পাঠানো হয়।
জেলাতে মৎস্য হ্যাচারী রয়েছে ২৫টি, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে ২টি, মৎস্য আড়ৎ রয়েছে ৩২টি। এছাড়া ২৭৮টি মৎস্য ডিপো, ৪৪টি বরফ কল, ১৫টি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র এবং ৫৮টি পাইকারী মৎস্য বিপনন কেন্দ্রের মাধ্যমে সারা বছর মাছ বাজারজাত করা হয়।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য বিভাগের বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে দেখা যায়, সাতক্ষীরার চিংড়ি বিদেশে রপ্তানির বাজার দখল করেছে। এখানে উৎপাদিত হচ্ছে সব ধরনের সুস্বাদু সাদা মাছ। চিংড়ির পাশাপাশি কৈ, মাগুর, শিং, শোল, পাঙ্গাস, মনোসেক্স তেলাপিয়া, কার্পজাতীয় মাছ ছাড়াও জেলাব্যাপী কাঁকড়া ও কুচিয়ার চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। জেলার ৫৫ হাজার ১২২টি বাগদা চিংড়ি ঘের ও ১১ হাজার ৬৩৮টি গলদা চিংড়ি ঘেরের এক চতুর্থাংশে আধানিবিড় ও নিবিড় চিংড়ি চাষ করা গেলে জেলার চিংড়ি উৎপাদন ৮ থেকে ১০ গুণ বেড়ে যাবে বলে জানানো হয়। বেসরকারি হিসাবে বাগদা ও গলদা চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা আরো বেশি। এসব ঘেরের মিষ্টি পানিতে ধান ও মাছ এক সাথে চাষ করা গেলে সাতক্ষীরায় মৎস্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হতে পারে এ খাতে সংশ্লিষ্টদের দাবি।
দেশীয় মাছ চাষ সম্পর্কে জাকির হোসেন বলেন, ‘কিটনাশক ও স্যার ব্যবহারের ফলে কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, মলা, ঢেলা, চেলা, শাল চোপরা, শোল, বোয়াল, আইড়, বাইন, খলিসা, চিংড়ি, গজার, , চেং, টাকি, চিতলসহ দেশীয় অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কৃষক পরিবারের জন্ম হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াকালিন সময় থেকে কৃষি আমাকে টানতো। লেখা-পড়া শেষ করে ধানের বীজের ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসা ভালো চলছিল। ২০১৫ সালে এসে ধানের বীজের জন্য চাতাল বানাতে গিয়ে দুটি তৈরী হয়ে যায়। সেখানে কি মাছ চাষ করবো সেই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বই পড়তে থাকি। অধিকাংশ বইতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে অচাষকৃত রাক্ষুসে মাছ নিধন করুন। সহজে না মরলে বিষ দিয়ে নিধন করুন। আর নিধন করার কথা বলা হয়েছে দেশী মাছগুলো। মাছে ভাতে বাঙালির প্রিয় মাছগুলো নিধন করে পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া নাইলোটিকা চাষ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমার মধ্যে জিদ হলো বিলুপ্ত মাছ চাষ করে সবাইতে দেখিয়ে দেব। সেই থেকে শুরু শোল মাছের চাষ শুরু করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই দেশের মতো মাটি এবং পানি কোথাও নেই। তাহলে আমি কেন মাছ চাষ অন্য দেশের কাছ থেকে টেকনোলজি ধার নেব। দেশী চ্যাং, শোল এবং বোয়াল মাছ যদি রাক্ষস হয় তাহলে অন্যগুলোহাঙ্গর। শোল, চ্যাং, বোয়াল মাছগুলোকে আমি খুব ভালোবাসি। মমতা দিয়ে দেশী মাছ চাষ করে সাফল্য পেয়েছি। প্রথমে অনেকে আমাকে পাগল বলে আখ্যা দিয়েছিল। এখন অনেকে এই দেশী মাছ চাষে ঝুকে পড়ছে। দেশী মাছ চাষে করচ কম লাভ বেশী। মানুষের কাছেও প্রিয় এই মাছগুলি।’
শোল মাছ চাষ সম্পর্কে জাকির হোসেন আরও বলেন, ‘এই অঞ্চালের মাছ চাষিরা যেসব মাছ চাষের প্রতি ঝুঁকছে তাতে ঝুঁকি আছে এবং খরচও বেশি। কিন্তু তারা বোঝেনা দেশীয় মাছ চাষে বেশী কষ্ট করা লাগে না। মানুষ যাকে পুকুরের অন্যান্য মাছের জন্য শত্রু মনে করেন আমি তাকে বন্ধু মনে ভেবে নিয়েছি। এর নার্সিং কিংবা একটু বড় হলেই পোনা লালনের দায়িত্ব মা মাছটির। এজন্য বাড়তি কোনো কাজেরও দরকার নেই বলে জানান তিনি।’
তিনি আরও জানান, ‘দেশীয় মাছ চাষ করতে পুকুরে কোনো সার দেওয়া দরকার হয়না। চুন কিংবা কোনো রাসায়নিক খাবারও নয়। সম্পূর্ন প্রাকৃতিকভাবে মাছগুলি বেড়ে উঠেছে। বাজারের ছোট মাছই এর প্রধান খাদ্য। জাকির রোজ সকাল বিকাল খাবার দেন তাদের। গত বছরের জুলাই ডিম ছাড়ে মা মাছটি। তারপর পোনা বের হয়। এই পোনাই তার পুকুরে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এক একটি শোল মাছের ওজন হয়েছে সর্বনি¤œ ৯শ’ গ্রাম থেকে এক কেজি ছাড়িয়ে গেছে।’ জাকির হোসেন বলেন, ‘রাক্ষুসে মাছ হিসাবে সবাই এড়িয়ে চলেন শোল মাছকে। আর আমি এটাকে বেছে নিয়েছে। অনেকে বলে ‘এরা অন্য সব ছোট মাছ খেয়ে ফেলে’। তিনি শোল মাছের সাথে চিতল, রুই, কাতলার চাষও করেছেন। তাদের বৃদ্ধিও নজর কাড়ার মতো।’ জাকির তার বাড়িতে গড়ে তুলেছেন গুড়পুকরের রিসার্চ ইনস্টিটিউিট। পুকুরে শোল মাছের চাষ এরই অধীনে বলে জানান তিনি। ধীরে ধীরে বোয়াল, আইড়, গজারসহ সকল দেশী মাছ চাষ করবেন বলে জানান তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এখানকার মাটি ও আবহাওয়ার কারণে সব ধরনের মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে গত কয়েক বছর ধরে চিংড়ি ঘেরের সাথেও সাদা মাছ চাষ করছেন চাষিরা। তা ছাড়াও পৃথকভাবেও সাদা মাছ উৎপাদন হচ্ছে সাতক্ষীরাতে। চলতি মৌসুমে সাদা মাছের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে উৎপাদন তার অনেক বেশি।
তিনি আরও বলেন, দেশীয় মাছ রক্ষার জন্য ইতোমধ্যে নানা ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সদরের জাকির হোসেন ব্যক্তি উদ্যোগে শোল মাছ চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন। তার সাফল্য দেখে জেলার অনেক যুবক কৈ, চ্যাং, শোল, চিতলসহ বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় মাছ চাষে উদ্ভুদ্ধ হয়েছেন।