ক্রাইমবার্তা রিপোট:‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সাথে ছাত্রলীগকে বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী’Ñআওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আবার হামলা চালাল ছাত্রলীগ। এবারে কৌশল পাল্টে শিক্ষার্থীদের (ছিনতাইকারীর আখ্যা দিয়ে) ওপর সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দফায় দফায় হামলায় অন্তত ৬ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারাও রয়েছেন। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসিতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে ফেরার পথে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর এ হামলা করে ছাত্রলীগ।
এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলা, আটকদের মুক্তি, শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদ ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিপুল শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে আগামী ২৫ জুলাই বুধবার দেশের সব কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীদের যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে ভিন্ন কৌশলে চলে এবারের হামলা। বিকেল ৩টায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরুর আগ থেকেই ছাত্রলীগের বিপুল কেন্দ্রীয় ও বিশ^বিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মী সমাবেশের আশপাশে অবস্থান নেন। এ সময় তারা মোবাইল ফোনে সমাবেশে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের স্থিরচিত্র ধারণ করেন। সমাবেশ শেষে ফেরার পথে ছাত্রলীগ কয়েক গ্রুপে ভাগ হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে হামলা চালায় আন্দোলনকারীদের ওপর। টিএসসি রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে সিএনজিতে বাসায় ফেরার পথে বাইক নিয়ে আন্দোলনকারীদের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার পিছু নেন ছাত্রলীগ। বাটা সিগন্যাল মোড়ে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতারা সিএনজির গতিরোধ করেন। এরপর সিএনজির ভেতরে থাকা আন্দোলনকারীদের নেতাদের বের করে এনে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে সাধারণ মানুষ ও ট্রাফিক পুলিশ মারধরের কারণ জানতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতারা আন্দোলনকারীদের ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে মারধর অব্যাহত রাখেন। এ সময় জনতার সহযোগিতায় আন্দোলনকারীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। মারধরের শিকার শিক্ষার্থীরা হলেনÑআন্দোলনকারীদের যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা, রাতুল সরকার, সৌরভ ও মিয়াজি।
হামলায় অংশ নেয়াদের মধ্যে ছিলেনÑছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক উপ-সম্পাদক মুরাদ হায়দার টিপু, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইদুর রহমান উজ্জ্বল, জহুরুল হক শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক আমির হামজাসহ ছয় নেতাকর্মী। তাদের হাত থেকে পালিয়ে এসে আন্দোলনকারীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ভিত্তিক এক গ্রুপে লাইভে এসে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাতুল সরকার বলেন, কিছুক্ষণ আগে আমাদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ছিল। কর্মসূচি শেষে আমি, কেন্দ্রীয় কমিটির বিন ইয়ামিন মোল্লা, সৌরভ ও মিয়াজি শাহবাগ পার হয়ে ধানমন্ডি যাওয়ার পথে ছাত্রলীগের ৮ থেকে ১০ জন সন্ত্রাসী আমাদের ওপর হামলা করেছে। সৌরভ ও মিয়াজিকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আমি সন্ত্রাসীদের সাথে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে পালিয়ে এসেছি।
এ দিকে প্রতিবাদ কর্মসূচি শেষে আন্দোলনকারী অন্য শিক্ষার্থীরা ফেরার প্রস্তুতি নেয়ার সময় রাজু ভাস্কর্যের সামনে হামলা চালান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিদার মুহাম্মদ নিজামুল হকসহ বেশ কিছু নেতাকর্মী। এরপর আন্দোলনকারীদের কয়েকজন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পালিয়ে গেলে সেখানেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এ সময় দুই-তিনজন আহত হন বলে জানা গেছে। একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়ে ধাওয়া দিলে পালিয়ে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
এর আগে প্রতিবাদ সমাবেশে আন্দোলনকারীদের যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, কোটা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে। এসবের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। এ আন্দোলন যৌক্তিক। কিন্তু এখানে হামলা চালিয়ে ব্যক্তিগত বিরোধ তৈরি করা হচ্ছে। যেটি কোনোভাবে কাম্য নয়। তিনি বলেন, আটকদের মুক্তি, নিরাপদ ক্যাম্পাস ও হামলাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে। আগামী ২৫ জুলাই বেলা ১১টায় সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করার আহ্বান জানাচ্ছি। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ বলেন, বেশির ভাগই বলেন কোটা সংস্কার আন্দোলন যৌক্তিক। কিন্তু আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও নিপীড়তদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। আটকদের যতদিন মুক্তি দেয়া হবে না ততদিন আমরা প্রতিবাদ জানাব। সমাবেশে রাশেদের মা সালেহা বেগম বলেন, আমার বাবা সাধারণ ছাত্র। সে কোনো রাজনীতি করে না। সে একটা চাকরির জন্য আন্দোলনে গিয়েছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, সে আপনার পক্ষের লোক। সে অনেক কষ্টে আছে। আমি আপনার কাছে আমার বাবাকে ভিক্ষা চাচ্ছি। আমি আমার বাবাকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমি আমার বাবার মুক্তি চাই।
গভীর রাতে নূরের কক্ষ দখলে নেয়ার চেষ্টা ছাত্রলীগের : এ দিকে গত শনিবার গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুরের কক্ষ দখলে নিতে যায় ছাত্রলীগ। পরে হল কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে তারা কক্ষটি দখলে নিতে পারেনি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার সাড়ে ১২টায় হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানীর অনুসারী শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আরিফ হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক আরাফাত হোসেন জোতিসহ অন্তত ২০ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী নুরের ১১৯ নম্বর কক্ষে যান। তারা নুরের রুমমেট নাজিমকে কক্ষ থেকে বের হয়ে ১১১ নম্বর কক্ষে যেতে বলেন। এ সময় ছাত্রলীগ নেতারা নুরের বইপত্র বের করে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কথা বলেন এবং নুরের বইপত্র নিয়ে হলের সিঁড়ির কাছে রাখেন। পরে রাত আড়াইটায় মুহসীন হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম এসে বইপত্রগুলো কক্ষের ভেতরে নিয়ে আসেন।
এ বিষয়ে নুরের রুমমেট নাজীম বলেন, আমাকে এসে তারা হলের ১১১ নম্বর কক্ষে যেতে বলেন। বইপত্রগুলো বের করেন। এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি। অভিযুক্তদের ব্যাপারে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী বলেন, এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা ছাত্রলীগের অতি উৎসাহী পোলাপান। তাদের খোঁজ নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে নুরুল হক নূর বলেন, ওরা চেয়েছিল আমার বইপত্র-সার্টিফিকেট পুড়িয়ে দিয়ে একটি আতঙ্ক সৃষ্টি করতে, যাতে আর কেউ কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে সাহস না পান। আমি ঘটনাটি প্রক্টর স্যারকে জানিয়েছি। এ বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক এ এফ এম গোলাম রব্বানী বলেন, হল প্রশাসনকে সমন্বয় করে প্রক্টরিয়াল টিম পাঠিয়ে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে।
Check Also
সাতক্ষীরা জেলা আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মাসিক সভা অনুষ্ঠিত
শাহ জাহান আলী মিটন, সাতক্ষীরা:সাতক্ষীরা জেলা আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক মাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার (১০ নভেম্বর) …