রক্তাক্ত পাকিস্তানে শঙ্কার ভোট শুরু

ক্রাইমবার্তা রিপোট::নানা শঙ্কা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে পাকিস্তানে পার্লামেন্ট (জাতীয় পরিষদ) ও চারটি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। ভোটগ্রহণের যাবতীয় সরঞ্জাম গতকাল মঙ্গলবার সারা দেশের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সারা দেশে সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর আট লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩ লাখ ৭১ হাজার সেনাসদস্য। তাদেরকে দেয়া হচ্ছে বিচারিক ক্ষমতা। নির্বাচন সামনে রেখে পরিচালিত বিভিন্ন জনমত জরিপে পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) এগিয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইমরান খানের তেহরিক-ই- ইনসাফ পার্টি (পিটিআই)। এ দিকে এ নির্বাচনে সেনাবাহিনী তাদের পছন্দের দল ও প্রার্থীকে বিজয়ী করতে চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছে পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ (পিপিপি) বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠন। বলা হচ্ছে- প্রধানমন্ত্রী পদে সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রার্থী হচ্ছেন পিটিআই দলের চেয়ারম্যান ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান। তবে সেনাবাহিনী বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। খবর ডন নিউজ, বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্সের।
আজকের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩৪২টি এবং প্রাদেশিক পরিষদগুলোর মধ্যে পাঞ্জাবে ২৯৭টি, সিন্ধুতে ১৩০টি, খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে ৯৯টি এবং বেলুচিস্তানে ৫১টি আসনে প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন দেশের সাড়ে ১০ কোটির বেশি ভোটার। জাতীয় পরিষদের ৩৪২ আসনে দুই পদ্ধতিতে তিন শ্রেণীর প্রার্থী নির্বাচিত হন। এদের মধ্যে ২৭২ জন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। ৬০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। আর ১০টি আসন রয়েছে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য।
এবারের নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৭ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন এলাকায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে পার্লামেন্টের আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। নতুন বিন্যাস অনুযায়ী রাজধানী ইসলামাবাদে তিনটি আসন, পাঞ্জাবে ১৪১টি আসন, সিন্ধুতে ৬১টি, খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে ৩৯টি, বালুচিস্তানে ১৬টি ও কেন্দ্রশাসিত উপজাতীয় এলাকায় (ফাতা) ১২টি আসন করা হয়েছে।
২০১৩ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের দল ৩৪২ আসনের মধ্যে ১৬৬টি আসন লাভ করে। কিন্তু তা সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। পরে কয়েকজন স্বতন্ত্র এমপি নওয়াজের দলে যোগ দিলে তিনি সরকার গঠন করতে সক্ষম হন। কিন্তু পরে দুর্নীতির মামলায় তিনি অভিযুক্ত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। বিচারে সাজা হওয়ায় বর্তমানে নওয়াজ শরিফ ও তার মেয়ে মরিয়ম ইসলামাবাদের কারাগারে রয়েছেন। নওয়াজ শরিফ তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়েও একবারও তার ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের যোগসাজশের অভিযোগ : আজকের নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এন) যাতে বিজয়ী হতে না পারে অর্থাৎ তাদের ক্ষমতার বাইরে রাখতে সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ গোপনে হাত মিলিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী বিচারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন মামলায় নওয়াজের দলের বিরুদ্ধে রায় দিতে বাধ্য করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। দেশটির একজন বিচারপতিও সম্প্রতি সেনাবাহিনীর চাপ সৃষ্টির অভিযোগ করেছেন। একজন বিচারপতিও সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে গুরুত্বর অভিযোগ এনেছেন। এই পরিস্থিতির মধ্যেই দেশটিতে আজকের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষাপটে দেশটির গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কাও জোরালো হচ্ছে।

পাঁচ বছর শাসনের পর নির্বাচন আয়োজনের জন্য ক্ষমতাসীন দল পিএমএল-এন এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর ছিল দেশটির গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। তবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকেই রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পিএমএল-এন’র চারজন এমপি রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন যে, দল পরিবর্তন করে পিটিআইতে যোগ দিতে তাদের হুমকি ও চাপ দেয়া হচ্ছে। একই সময়ে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলোতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অভিযোগও জোরালো হয়ে ওঠে। বেড়ে চলেছে সাংবাদিক ও মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে সেন্সরশিপের অভিযোগ।
পিএমএল-এন’র প্রতিষ্ঠাতা নওয়াজ শরিফ গত বছর জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ক্ষমতাচ্যুত হন। বর্তমানে তিনি দুর্নীতি মামলায় কারাগারে রয়েছেন। ওই ঘটনাকে নওয়াজ নির্বাচনে আগেই কারচুপি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তার দাবি ছিল, দলকে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকাতেই এটা করা হয়েছে। লন্ডনে কেনা বিলাসবহুল চারটি ফ্ল্যাট কেনার অর্থের উৎস দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় ৬ জুলাই নওয়াজ শরিফ আর তার মেয়ে মরিয়মকে কারাদণ্ড দেয় আদালত।
রায় ঘোষণার সময় লন্ডনে অবস্থানরত পিতা ও কন্যা গত ১৩ জুলাই শুক্রবার দেশে ফিরেই গ্রেফতার হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ ও নওয়াজের নিজের নির্বাচনী এলাকা পাঞ্জাবের পুলিশ কর্মকর্তাদের সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে পিএমএল-এন নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এ ছাড়া দলটির বিভিন্ন কর্মসূচিতে বাধা দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
কেবল নওয়াজের মুসলিম লিগ নয়, লন্ডন থেকে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) প্রতিষ্ঠাতা আলতাফ হোসেন এবারের নির্বাচন সেনা পৃষ্ঠপোষকতার নির্বাচন উল্লেখ করে বলেছেন, নির্বাচনে ফল আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের জনগণকে বোকা বানানো হবে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী চায় ইমরান খানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানাতে। যাতে করে দেশ সেনাবাহিনীর নির্দেশে ও ইচ্ছানুসারে পরিচালিত হয়। আলতাফের এই বক্তব্য ভিডিও আকারে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনের দেড় মাস আগে থেকেই সংবাদমাধ্যম, সামাজিকমাধ্যম ও মূলধারার রাজনীতিতে সমালোচকদের শায়েস্তা করার উদ্যোগ নিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এর অংশ হিসেবে সাংবাদিকদের অপহরণ ও হুমকি, বড় বড় সংবাদমাধ্যমকে ব্লক, পিএমএল-এন’র প্রতি সমর্থনমূলক মত সেন্সর করা হচ্ছে, কখনো কখনো শাস্তি দেয়া হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে খবরে তুলে ধরা হয়েছে সেনা সমালোচক গুল বুখারিকে অপহরণের কথা। পিএমএল-এনকে চাপ দেয়ার সমালোচনায় সরব ছিলেন এই সাংবাদিক।
তবে সেনাবাহিনী দাবি করেছে, নির্বাচনে তাদের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু তারা ভোটকেন্দ্রগুলোতে ৩ লাখ ৭১ হাজার সেনা মোতায়েন করবে। নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের সংখ্যা ২০১৩ সালের তুলনায় এবার পাঁচগুণ বেশি। সেনা মুখপাত্র বলেন, আমাদের কোনো রাজনৈতিক দল বা পক্ষপাতিত্ব নেই। আমরা শুধু দেশের জন্য কাজ করি। পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খানকে সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে কি না জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের জনগণ যাকে নির্বাচন করবে তিনিই হবেন আমাদের ও দেশের প্রধানমন্ত্রী।

Check Also

তালায় ইউপি পরিষদ কক্ষে দুই সাংবাদিকের উপর হামলা, প্রতিবাদে মানববন্ধন

তালা প্রতিনিধি তালার ইসলামকাটি ইউনিয়ন পরিষদে সাংবাদিক আক্তারুল ইসলাম ও আতাউর রহমানের ওপর সন্ত্রাসী রমজান আলী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।