পাকিস্তানের নির্বাচন : প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন ইমরান, একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনঃ ‘নজিরবিহীন কারচুপির’ অভিযোগ

ক্রাইমবার্তা ডেস্করির্পোটঃবিপুলভাবে জয়ী হয়ে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খান। তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এককভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বাকি সব ‘নজিরবিহীন কারচুপির’ কথা জানিয়ে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। বুধবার এই নির্বাচন অনুষ্ঠি হয়।

এখন পর্যন্ত ৪৭ ভাগ আসনের ভোট গণনা সম্পন্ন হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে ইমরান খানের পিটিআই পেয়েছে ১১৩টি, মুসলিম লিগ (এন) ৬৪টি, পিপিটি ৪৩টি, এমকিউএম ৫টি, এমএমএ ৯টি।
পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ৩৪২ আসনের মধ্যে সরাসরি ভোট হয় ২৭২টি আসনে। ৭০টি আসন সংরক্ষিত থাকে নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য। এগুলোতে ভোটে জেতা আসনের আনুপাতিক হারে বণ্টিত হয় দলগুলোর মধ্যে। মোট আসনের নিরিখে সরকার গড়তে ১৭২টি আসন দরকার। যার অর্থ, ভোট-হওয়া ২৭২টি আসনের মধ্যে ১৩৭টি জিতলেই সরকার গড়া যাবে।
ইমরান খান তা পেয়ে যাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার দল ইতোমধ্যেই জয়ের উল্লাস শুরু করে দিয়েছে।
পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে পাঞ্জাবে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ, সিন্ধুতে পিপিপি, খাইবার পাকতুন খাওয়ায় পিটিআই ও বেলুচিস্তানে বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি জয়ী হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ (এন), বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম-পি), মুত্তাহিদা মজলিস-ই–আমিল (এমএমএ) বুধবার রাতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন করে।
রাতে সংবাদ সম্মেলনে পিএমএল-এনের সভাপতি শাহবাজ শরিফ নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ‘ব্যাপক অনিয়মের’ অভিযোগ আনেন।
তিনি বলেন, আমি সারা পাকিস্তান থেকে অভিযোগ পেয়েছি। আজ যা ঘটেছে, তা পাকিস্তানকে ৩০ বছর পেছনে নিয়ে গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে দলের মুখপাত্র মুশাহিদ হোসাইন সাইয়েদ বলেন, তাদের নির্বাচনী এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে চলে যেতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, এটি ছিল সিলেকশন, এটি কোনাভাবেই ইলেকশন ছিল না।
পিএমএল-এনের অপর মুখপাত্র মরিয়ম আওরঙ্গজেব অভিযোগ করেন, যেসব আসনে তাদের প্রার্থী জয়ের পথে ছিল, সেখানে ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করে দিয়ে রুদ্ধদ্বার কক্ষে কাজ সম্পন্ন করা হয়।

পিপিটি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো বলেন, আমার প্রার্থীরা অভিযোগ করেছে, তাদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।

আরো পড়ুন

নির্বাচনের পর পাকিস্তানের বড় চ্যালেঞ্জ পররাষ্ট্রনীতি
আলজাজিরার বিশ্লেষণ
গতকাল অনুষ্ঠিত হওয়া পাকিস্তানের নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তেমন কোনো কথা বলতে শোনা যায়নি। কিন্তু একটা বিষয় সত্য, পাকিস্তানের পরবর্তী সরকারকে দেশের বাইরের বিভিন্ন বিষয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ক্রমবর্ধমান বিরোধ, আফগানিস্তানে চলমান যুদ্ধ, ভারতের সাথে বিরোধ এবং চীনের সাথে সম্পর্ক নিয়েই মূলত পাকিস্তানের নতুন সরকারকে পররাষ্ট্রনীতি নির্ণয় করতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিরোধ
২০০১ সালের ৯/১১ ঘটনার পর পাক-মার্কিন জোট গড়ে ওঠে। দেশ দু’টির মধ্যে এতদিন ধরে টিকে থাকা শক্তিশালী সম্পর্ক এখন প্রায় ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। ২০১১ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের বাড়িতে আক্রমণ এবং একই বছরের শেষের দিকে পাকিস্তানি সীমান্ত চৌকিতে মার্কিন বিমান হামলায় এক ডজনেরও বেশি পাকিস্তানি সেনা নিহত হওয়ার পর থেকেই দেশ দু’টির মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। এই ঘটনার পর থেকেই দেশ দু’টি কৌশলগত মিত্র থেকে ‘লেনদেন নির্ভর মিত্রে’ পরিণত হয়।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের সময়ই পাকিস্তানের জন্য সামরিক ও বেসামরিক সাহায্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এই বছরের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার দক্ষিণ এশীয় নীতি ঘোষণা করার পর সামরিক সহায়তা স্থগিত করা হলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়। পূর্বসূরিদের ন্যায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা না করে দেশটির কাছ থেকে নিঃশর্ত সহযোগিতা দাবি করে।
ওয়াশিংটনের সামরিক সহযোগিতা কেবল পাকিস্তানি সীমান্তসংলগ্ন তালেবান যোদ্ধাদের ওপর ব্যবহার করার জন্য প্রদান করা হয় এবং এই কাজের হেরফের হলেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসীদের স্বর্গ রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। নিশ্চিতভাবেই এই ধরনের দ্রুত পরিবর্তন কখনোই সফল হতে পারে না। আর তাই তালেবান বিদ্রোহীদের ব্যাপারে কঠোর হতে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে পাকিস্তানের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করছে ট্রাম্প প্রশাসন। একই সময়ে গত কয়েক বছর ধরেই ইসলামাবাদ আঞ্চলিক পরাশক্তি চীনের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই পরিস্থিতি পাকিস্তানের নতুন নেতৃত্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে সন্দেহ নেই।

আফগানিস্তান ও তালেবান বিদ্রোহ

আগের সরকারগুলোর মতো নতুন সরকারের জন্যও আফগানিস্তান সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই থাকবে। সম্প্রতি দেশ দু’টির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা আবারো শুরু হওয়ায় কাবুল ও ইসলামাবাদের সামনে আবারো পারস্পারিক বিশ্বাস ও আস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ এসেছে। প্রকৃতপক্ষে উভয়পক্ষের এই বৈঠকে আশান্বিত হওয়ার মতো অনেক কারণ আছে; কিন্তু তার আগে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান উদ্বেগ ও পারস্পারিক অবিশ্বাস দূর করতে হবে এবং উভয় দেশে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বাধাগুলো দূর করতে হবে।
তালেবান বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আফগান সেনাদের জন্য সত্যিকারের পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগানিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই অভিযোগ করে এসেছে যে, গত ১৬ বছর ধরেই পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করে তালেবান বিদ্রোহীরা নিজেদের আরো বিস্তৃত ও শক্তিশালী করে তুলেছে এবং আফগানিস্তানে সরকারি বাহিনীর ওপর জোরদার হামলা অব্যাহত রেখেছে। তাই এই অভিযোগ আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া পাকিস্তানের নতুন সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি পাকিস্তানের মাটিতে হাক্কানি নেটওয়ার্কও সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ থাকলেও দেশটির কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের আফগান নীতি মূলত দেশটিতে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই পরিচালিত হবে এবং নতুন নির্বাচিত সরকার এই বিষয়টি মাথায় রেখেই সম্ভবত এগিয়ে যাবে। তারপরও পাকিস্তানের নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থাই কাবুলের সাথে সম্পর্কের ইতিবাচক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করবে।

ভারত ও চীন
প্রকৃতপক্ষে ইসলামাবাদের নতুন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নয়াদিল্লির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা এবং বেইজিংয়ের সাথে বাণিজ্যিক ভারসাম্য রক্ষা করা। পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক গত কয়েক বছর ধরে শুধুই শীতল হয়েছে এবং কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় উত্তেজনা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পেয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নয়াদিল্লির সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাধা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনাগ্রহের কারণে সেগুলো সফল হয়নি।
অন্য দিকে চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। চীন-পাকিস্তান জোট এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি এবং ভারতের সাথে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার কারণে ইসলামাবাদ ক্রমেই চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। চীনকে পাকিস্তান নিজেদের ‘সব মওসুমের বন্ধু’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কোন্নয়নও চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক মজবুত হওয়ার আরেকটি কারণ। এসব কারণ ছাড়াও অন্যান্য আরো ভূরাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি জটিল পরিস্থিতিতে জড়িয়ে গেছে। তাই নতুন সরকার শপথ নেয়ার পর সঠিক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ ও মেনে চলাই তাদের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।