ক্রাইমবার্তা নিজস্ব রির্পোটঃ ফেয়ার ভোট হলে সিলিটের মেয়ার হবেন জামায়াত। সিলেট নগরীতে জামায়াতে ইসলামীর ভোট কতটি তা নিয়ে চলছে গুঞ্জন। অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন জামায়াত তাদের নিজেদের ভোটের চেয়ে বেশি দাবি করছে এবং এ কারণে বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন না দিয়ে অনড় রয়েছে নির্বাচনে।
সিলেট নগরীর ৩ লক্ষাধিক ভোটারের মধ্যে কতজন ভোটার জামায়াতপ্রার্থীকে পছন্দ করতে পারেন তা জামায়াতের কাছেও স্পষ্ট নয় পুরোপুরি। তাই জামায়াতদলীয় নেতাকর্মীদেরও অনেকেরই ধারণা ২০ দলের ভোট ভাগ হওয়ার ফলে নির্বাচনের নিশ্চিত ফলাফল চলে যাবে বদর উদ্দিন কামরান সাহেবের পক্ষে।
জামায়াত একটি পুরনো রাজনৈতিক দল হলেও গণমানুষের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের দূরত্ব অনেক বেশি। ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন হওয়াতে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় তাদের।
এই দলটিতে শিক্ষিত জনশক্তির সংখ্যা প্রায় ৯০%। সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষকে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রবণতা বা উদ্যোগ খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে রিক্সার ড্রাইভার, চাষী, দিনমজুরদের মধ্যে জামায়াতের সমর্থক কতজন আছে তা জামায়াতদলীয় লোকেরাই বলতে পারবে না।
কিন্তু শিক্ষিত সমাজে বেশ ভালো একটি অবস্থানে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে দলটি। তাই গ্রামেগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলার চেয়ে সিটি নির্বাচনে জামায়াতের বিজয়ী হবার সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি।
যদিও বিগত উপজেলা নির্বাচনে সারাদেশে জামায়াতের ভাইস চেয়ারম্যানের সংখ্যা বিএনপির চেয়েও বেশি ছিল। অধিকাংশ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন দিতে গিয়ে জামায়াত নিজেদের প্রার্থীকে বসিয়ে দেয়।
উপজেলা নির্বাচনে সিলেট বিভাগে জামায়াতের ফলাফল ছিল ইতিবাচক। সিলেটের গোলাপগঞ্জে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির প্রার্থীকে টপকিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন হাফিজ নজমুল ইসলাম।
জৈন্তাপুরে জামায়াতের জয়নাল আবেদীন নির্বাচিতন হন বিপুল ভোটে। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বহাল রয়েছেন তরুণ জামায়াত নেতা সাইফুল্লাহ আল হোসাইন।
দক্ষিণ সুরমায় জামায়াতের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমান দ্বিতীয় মেয়াদে প্রার্থী হলে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় নিশ্চিত জয় থেকে বঞ্চিত হন। সেখানে আওয়ামীলীগ বিজয়ী হলেও জামায়াত ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে।
বিএনপির অবস্থান ছিল তৃতীয়। একইভাবে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে জামায়াতের ডা. আব্দুল কুদ্দুস দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন যেখানে বিএনপি ছিল তৃতীয় অবস্থানে।
বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের প্রার্থীদের থেকে কম ভোট পেতে দেখে তখন অনেকেই ব্যঙ্গ করে বলতেন, ‘বিএনপি এখন ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা!’
সিলেটের কানাইঘাটে জামায়াত থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন জামায়াত নেতা আব্দুর রহিম, কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তাঁকে বয়কট করে বিএনপির আশিক চৌধুরীর জন্য কাজ করে জামায়াতে ইসলামী। শেষ পর্যন্ত আশিক নির্বাচিত হলেও এখানেও সম্মানজনক ভোট পান জামায়াতের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুর রহিম!
সিলেট সিটি কর্পোরেশনে জামায়াতের ভোটসংখ্যা প্রকৃতপক্ষে কতটি তা জামায়াত নিজেরাও জানে না। অনেকেই মনে করেন জামায়াতের ভোট মানে কেবল তাদের দলীয় নেতা-কর্মীদেরই ভোট।
এটা ঠিক একটি সুশৃঙ্খল দল হিসেবে তাদের দলীয় ভোট অন্যবাক্সে পড়ার কোনো ঝুঁকি নেই। তাই দলীয় ভোটের সংখ্যাটা তাদের একটা বড় পুঁজি। এ হিসেবে জামায়াত বিরোধীরাও ধারণা করছেন অন্তত ২০ থেকে ৩০ হাজার দলীয় ভোট রয়েছে তাদের।
কিন্তু বিগত উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় জামায়াতকে সাধারণ মানুষও ভালোবাসতে শুরু করেছে। না হলে যেখানেই জামায়াত প্রার্থী দিল সেখানেই বিজয়ী হলো কিভাবে?
পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০১০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত রাজনৈতিক দল হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। দলের কেন্দ্রীয় আমির, নায়েবে আমির, সেক্রেটারি জেনারেল, এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেলসহ শীর্ষনেতৃবৃন্দকে একের পর এক ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। প্রথম দিকে এককভাবে হরতালসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে প্রতিবাদ করেছে জামায়াত।
একটা সময় মানুষের মাঝে এমন কথাও বলতে শোনা যেত, ‘আজকে জামায়াতের হরতাল, আজ সবকিছু অচল থাকবে।’ বাস্তবে ঘটতোও সেটাই। কিন্তু যেদিন বিএনপির হরতাল থাকতো সেদিন দেখা যেত ঢিলেঢালা সবকিছু। সর্বশেষ লাগাতার হরতাল-অবরোধ ডেকে এই কর্মসূচিকে ধ্বংস করে দিয়েছে বিএনপি!
জামায়াত নেতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণার পর সর্বপ্রথম নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করেছিল জামায়াত। সারাদশে দুই শতাধিক কর্মী নিহত হয়েছিল সে সময়। জামায়াত ঘোষণা করেছিল ২ দিনের হরতাল কর্মসূচি।
চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে এসে এর সাথে যোগ করেন ৩ নম্বর দিনের হরতাল কর্মসূচি! তখনও অনেককে ব্যঙ্গ করে বলতে শোনা যায় ‘বিএনপি এখন ছাগলের ৩ নম্বর বাচ্চা’।
এবার আসা যাক সিলেট সিটিতে জামায়াতের নির্বাচনী অবস্থান প্রসঙ্গে। জামায়াত সর্বশেষ নিজ নামে সিলেট পৌরসভায় নির্বাচন করেছিল ১৯৯৪ সালে। তখন বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির আ ফ ম কামাল।
তিনি ভোট পেয়েছিলেন ১৩ হাজার। আর জামায়াতের কুতুব উদ্দিন পেয়েছিলেন ৭ হাজার। লক্ষ্য করুন, ১৯৯৪ সালেও জামায়াতের ভোট ছিল বিএনপির ভোটের অর্ধেক থেকে বেশি।
এর মাত্র দুই বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে ১৯৯৬ সালে জামায়াতের চরম বিপর্যয়ের সময় সাইফুর রহমান সাহেব ও হুমায়ন রশীদ সাহেবের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করে ২৬ হাজার ভোট পেয়েছিলেন তখন বয়সে তরুণ জামায়াত নেতা ডা. শফিকুর রহমান।
বিগত উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল আর অতীতের সিলেট শহরের ভোট পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে জামায়াতের প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বিজয়ী হয়ে চমক দিতে পারেন।
সিলেট সদর উপজেলা নির্বাচনে বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইসচেয়ারম্যানও কিন্তু জামায়াতেরই এ কথা ভুলে গেলে চলবে কী করে? তাছাড়া সিলেট সিটি কর্পোরেশনে ৪ জন কাউন্সিলর বিগত মেয়াদে ছিলেন। আর দুইজনকে কারচুপির মাধ্যমে পরাজিত করার অভিযোগ রয়েছে।
২০ দলীয় জোটের নামে বিএনপি কেবল তাদের ১ দলের প্রার্থীদেরই মনোয়ন দিয়ে যাচ্ছে সারাদেশে। এজন্যে শরিকদলগুলো ক্ষুব্ধ বিএনপির উপর। এই সুযোগটিও কাজে লাগাতে পারছে সিলেটের জামায়াত।
ইতোমধ্যে ২০ দলের মধ্য থেকে ১৭টি দলের সমর্থন ও সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছেন এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। তাঁর প্রতিটি পথসভায় শরিকদলগুলোর নেতৃবৃন্দকে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখতে দেখা যায়।
পক্ষান্তরে আরিফুল হক চৌধুরীরর পথসভা ও গণসংযোগে মজলিসের একটি অংশ এবং জমিয়তের দুটি অংশ ছাড়া ২০ দলের আর কোনো নেতাকর্মীকেই উপস্থিত হতে দেখা যাচ্ছে না। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো জামায়াতের প্রতি মানুষের সহানুভূতি রয়েছে আর বিএনপির প্রতি রয়েছে বিরক্তি। প্রার্থী হিসেবে বিএনপির রয়েছে ব্যাপক মতানৈক্য।
দলীয় প্রতীক ধানের শীষে যিনি প্রার্থী হয়েছেন সেই আরিফুল হককে বয়কট করেছেন দলের তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে সিলেটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। শেষ মুহূর্তে চাপের মুখে বিদ্রোহী প্রার্থী বদরুজ্জামান সেলি বসে গেলেও তাঁর বাক্সের ভোটগুলো এসে যাওয়ার সম্ভাবনা রযেছে জামায়াতের ঘড়িতে।
আওয়ামীলীগ থেকেও কামরানের বিকল্প প্রার্থী হতে ইচ্ছুক রয়েছেন একাধিক ব্যক্তি। তারাও চাইবেন নির্বাচনে কামরান সাহেবের ভরাডুবি। কারণ এবার কামরান পরাজিত হলে দলীয় হাইকমাণ্ডের নিকট বলতে পারবেন নিজেদের যোগ্যতার কথা। আগামীতে কামরানের পরিবর্তে প্রার্থী হতে আগ্রহীদের কয়েকটি গ্রুপ জামায়াতের প্রার্থীকে ভোট দিতেই পারে!
অন্যদিকে জামায়াত নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের রয়েছে ক্লিন ইমেজ, শিক্ষাগত যোগ্যতা আর জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা। তাই সবকিছুর হিসাবে ধারণা করা যায় জামায়াতের প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়েরই হতে যাচ্ছেন আগামী দিনে সিলেটের মেয়র।
তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্বী হবার সম্ভাবনা বেশি আওয়ামীলীগ ্প্রার্থী সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের। বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করায় তৃতীয় অবস্থানে থাকতে পারেন আরিফুল হক চৌধুরী।
সংবাদটি ভাল লাগলে অাপনার মতামত দিন