ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১৬টি কেন্দ্র ব্যতীত অন্য দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে নির্বাচন ভালো হয়েছে। আমরা সন্তুষ্ট। যেখানে সমস্যা ছিল সেখানে তো আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।’
সোমবার সন্ধ্যায় আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সিইসি কে এম নুরুল হুদা এসব কথা বলেন।
সিইসি কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ১৩৮টি কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং সেখানে ভোট গণনা শুরু হয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৩৪টি কেন্দ্রের মধ্যে দুটি কেন্দ্র ব্যতীত বাকি কেন্দ্রসমূহে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
সিইসি আরো বলেন, ‘বরিশালের ১২৩ কেন্দ্রের মধ্যে সকালের দিকে কিছু বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। আমরা বিস্তারিত তথ্য নিয়েছি। এই বিষয়ে একটি কেন্দ্র বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে সকালেই। আরো ১৫টি কেন্দ্রে অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় ওই কেন্দ্রগুলোর ফলাফল স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরবর্তী সময়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বরিশাল সিটিতে আওয়ামী লীগ ছাড়া সবাই ভোট বর্জন করেছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘এটা তো তাঁদের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমরা ১৫টি কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল স্থগিত করেছি। এটা তো বড় ধরনের শঙ্কা। এ ছাড়া অন্যগুলোতে আমরা অনিয়মের ব্যাপারে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে তথ্য পাইনি।
সিইসি নুরুল হুদা আরো বলেন, ‘মোট কত শতাংশ ভোট পড়েছে তা এখনি বলা মুশকিল। কারণ ভোট গণনা এখনো চলছে।’
বরিশালের ভোট বর্জন করা প্রার্থীরা পুনরায় ভোট গ্রহণের লিখিত আবেদন জমা দিয়েছে নির্বাচন কমিশনে। এ ব্যাপারে সিইসি বলেন, ‘তারা আবেদন করেছেন আমরা সেটা জেনেছি। কিন্তু পুনরায় ভোট গ্রহণ করার মতো অবস্থা আমরা সেখানে পাইনি।’
সিইসি আরো বলেন, ‘একজন মেয়র প্রার্থীর ওপর আক্রমণ হয়েছে কি না সেটা আমরা তদন্ত করব। আর তিনি চাইলে কোর্টের আশ্রয় নিতে পারেন।’
আরো পড়ুন : বরিশালে বিএনপির ভোট বর্জন নিয়ে কমিশনে আলোচনা
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার মাহাবুব তালুকদার বলেছেন, ‘আমি শুনেছি বরিশালে ভোটকেন্দ্র দখল হয়েছে। সেখানে একজন মেয়র প্রার্থীর সাথে খারাপ আচরণও করা হয়েছে। বিএনপির প্রার্থী ভোট বর্জনও করেছে। এসব বিষয় নিয়ে আমরা কমিশনে আলাপ-আলোচনা করছি।’
সোমবার দুপুর ১টার দিকে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা এই নির্বাচন কমিশনার এসব কথা বলেন।
মাহাবুব তালুকদার আরো বলেন, ‘আমরা জেনেছি বরিশালে খুব বাজে অবস্থা। আমরা তদন্ত করে দেখছি। এসব নিয়ে আলোচনা করছি। কমিশন সভায় যে সিদ্ধান্ত হয়, তা-ই জানানো হবে।’
সোমবার সকাল ৮টা থেকে রাজশাহী ও সিলেটের সাথে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়। পরে দুপুর ১২টায় বরিশাল প্রেসক্লাবের এসে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী। এ সময় তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে ৭০-৮০টি কেন্দ্রে আমাদের এজেন্টদের ঢুকতে দেয়নি। অন্য যেসব কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টরা প্রবেশ করেছে, সেখানে সবাই মিলে সিল করেছে, নৌকার মার্কার সিল করেছে। এসব কারণেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছি।’
তার আগে নির্বাচনে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহাবুবও সংবাদ সম্মেলন করে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সরকারি মহাবিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে বাসদের মেয়র প্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্তী হামলার শিকার হন বলে অভিযোগ করেন। মনীষা অভিযোগ করেন, সরকারি মহাবিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে তিনি দেখতে পান, সেখানে নৌকা মার্কার পক্ষে জাল ভোট দেওয়া হচ্ছে। নৌকা মার্কায় আগে থেকে সিলমারা ব্যালট পেপার দেখতে পান তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের পোলিং এজেন্টরা তার ওপর চড়াও হয়। তাকে মারধর করে মেঝেয় ফেলে দেয় তারা। এ ঘটনায় মনীষার বাঁ হাতে আঘাত লাগে। হাতে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।
হামলার ঘটনায় বরিশাল সিটি নির্বাচন স্থগিত করার দাবি জানান বাসদের মেয়র প্রার্থী মনীষা।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না এই ব্যাপারে। তবে আপনাদের কাছে কোনো তথ্য থাকলে আমাদের দিন। আমরা ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেবো।’
এদিকে কন্ট্রোল রুম থেকে মেজর রাজু বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যে খবর পাচ্ছি, তাতে অধিকাংশ কেন্দ্রেই ঝামেলার খবর শুনতে পাচ্ছি।’
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, বরিশাল সিটি করপোরেশনে দুই লাখ ৪২ হাজার ৬৬৬ জন ভোটার রয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ২১ হাজার ৪৩৬ ও নারী ভোটার এক লাখ ২০ হাজার ৭৩০ জন।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ছয়জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তারা হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ (নৌকা), বিএনপির মোঃ মজিবর রহমান সরোয়ার (ধানের শীষ), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ওবায়দুর রহমান মাহবুব (হাতপাখা), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির আবুল কালাম আজাদ (কাস্তে), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের মনীষা চক্রবর্তী (মই) ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোঃ ইকবাল হোসেন (লাঙ্গল)।
বরিশাল সিটিতে ৩০টি সাধারণ ও ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড রয়েছে। এখানে ১২৩টি ভোটকেন্দ্র ও ৭৫০টি ভোটকক্ষ রয়েছে।
আরো পড়ুন : ‘বরিশালে মেয়র প্রার্থীর ব্যালট উধাও’
শফিকুল ইসলাম
অদ্ভূত কান্ড ঘটেছে বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) নির্বাচনে। সকাল আটটায় ভোট শুরুর কিছুক্ষণ পরই ঘটে এই ঘটনা। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে খবর পাওয়া যায় যে মেয়র প্রার্থীর ব্যালট বই উধাও! একজন ভোটার মেয়র, কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ভোট দেয়ার কথা। কিন্তু অধিকাংশ কেন্দ্রেই মেয়র প্রার্থীর ব্যালট শেষ হয়ে যায় নির্ধারিত সময়ের আগেই।
এদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরওয়ার সকাল সাড়ে আটটার দিকে তার বাড়ি সংলগ্ন পশ্চিম কাউনিয়া এলাকার সৈয়দা মজিদুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন। এ সময় তার সঙ্গে কয়েকজন নেতা-কর্মী ছিলেন। তারাও কেন্দ্রের দোতলায় উঠেন এবং দুই তিনজন ভেতরে ঢোকেন। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও বহিরাগত লোকজন তাদেরকে বের হতে বলে এবং ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তারাও ভোট কেন্দ্রে প্রবেশের চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের বাধার কারণে ঢুকতে পারেননি। এতে করে মজিবর রহমান সরোয়ার কেন্দ্রে ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে পরেন। ক্ষমতসীন দলের নেতাকর্মীদের স্লোগানে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরো বেশ কিছু সদস্য। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে অবরুদ্ধ ছিলেন সরোয়ার।
সরেজিমন দেখা যায়, ২৭ নং ওয়ার্ডের কলাডেমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে ভোট শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়র প্রার্থীর ব্যালট উধাও হয়ে যায়। নৌকা মার্কার লোকেরা এসে ব্যালট ছিনতাই করে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারে বাক্সে ভর্তি করে। এসময় নৌকার এজেন্টরাও নিজেরাই নৌকায় সিল মারতে থাকেন।
কর্তব্যরত সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন ভোটার মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর তিনটি ভোট দিবে। কিন্তু মেয়র প্রার্থীর ব্যালট শেষ। কীভাবে শেষ হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের লোকজন এসে সব নিয়ে গেছে। একই ঘটনা ২০ নং ওয়ার্ডেও সরকারি বরিশাল বিএম কলেজ কেন্দ্রেও। সেখানে ইভিএমে ভোটগ্রহণ চলে। কিন্তু ডিসপ্লেতে নৌকা প্রতীক ছাড়া অন্য প্রতীক দেখা যায়নি।
১২ নং ওয়ার্ডের ৫০ নং কিশোর মজলিস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও। সেখানে ইভিএমে ত্রুটি দেখা দিলে ম্যানুয়ালি ভোট হয়। একপর্র্যায়ে ছাত্রলীগের নগর সভাপতি মো: জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে কিছু যুবক ব্যালট ছিনতাই করে প্রকাশ্যে নৌকা ও ঠ্যালাগাড়ি প্রতীকে সিল মারে। ফলে শেষ হয়ে যায় মেয়র প্রার্থীর ব্যালট বই।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে বাসদের মেয়র প্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্তীসহ সদর গার্লস স্কুল কেন্দ্রে যান কয়েকজন। সেখানে তারা জানতে পারেন মেয়র ব্যালট বাদে অন্য ব্যালট দেওয়া হচ্ছে। প্রার্থী ভেতরে গিয়ে দেখেন মেয়র ব্যালটে আওয়ামী লীগের কর্মীরা সিল দিচ্ছেন। তিনি সাথে সাথে রিটার্নিং অফিসারকে জানান। রিটার্নিং অফিসার দ্রুত চলে আসেন। এ সময় তার সামনেই বাকবিত-ার একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের দুই কর্মী চড় থাপ্পর মারেন মনিষাকে। এসময় তিনি বাম হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আহত হন।
২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউদ্দিন সিকদার বলেন, সোয়া ৮টার মধ্যে তার কেন্দ্রগুলো থেকে বিএনপি এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। ২৪, ২৫ ২৬ নম্বর ওয়ার্ড পুরোপুরি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দখলে। এখানে স্থানীয় পত্রিকার এক সাংবাদিক ভোট দিতে এসে পড়েন বিড়ম্বনায়। তাকে শুধু কাউন্সিলন প্রার্থীর ব্যালট দেওয়া হয়।
এদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরওয়ার সকাল সাড়ে আটটার দিকে সৈয়দা মজিদুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন। তার সঙ্গে কয়েকজন নেতা-কর্মী কেন্দ্রের দোতলায় উঠেন এবং দুই তিনজন ভেতরে ঢোকেন।
তিনি বুথে ঢুকে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে বলেন, তিনি তার ভোটার নম্বর জানেন না। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেন, ‘ভোটার নম্বর ছাড়া ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। নম্বর এখন খুঁজে বের করা যাবে না।’ পরে সরওয়ারের সঙ্গে থাকা লোকেরা বাইরে গিয়ে ভোটার নম্বর নিয়ে আসেন। কেন্দ্রের যে বুথের ভোটার, সেখানে গিয়ে সোয়া ১০টার দিকে গিয়ে ভোট দেন তিনি।
মজিবর রহমান সরওয়ার অপেক্ষা করতে থাকেন তার ভোটার নম্বরের কার্ড আসার জন্য। কিন্তু বাইরে হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী অনেকেই ‘জয় বাংলা’, ‘সরওয়ারকে বাইর কর’ স্লোগান দিতে থাকেন। ২০-২৫ জন ভোটকেন্দ্রে ঢোকার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু হয়। এ সময় মজিবর রহমান সরওয়ার কেন্দ্রে আটকা পড়েন। বাইরে আরো লোক জড়ো হয়। অতিরিক্ত পুলিশ এসে বিএনপি প্রার্থী মজিবর রহমান সরওয়ারকে বের করে আনেন।
বাইরে বেরোলে অপেক্ষারত নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী লোকজন মজিবর রহমান সরোয়ার ও বিএনপির নেতাকর্মীদের ঘিরে ধরেন। তার সঙ্গে থাকা লোকজন আওয়াজ তুলে সরওয়ারকে বের করার চেষ্টা করেন। পরে পুলিশ সদস্যরা মজিবর রহমান সরওয়াকে গাড়িতে তুলে কেন্দ্র থেকে বের করে দেন।
বেলা পৌনে নয়টার দিকে মজিবর রহমান সরওয়ার সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, অর্ধশতাধিক কেন্দ্র থেকে তার পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কোনোভাবেই সুষ্ঠু ভোট হবে না।