ক্রাইমবার্তা রিপোট:বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর বাসের ধাক্কায় দুই সহপাঠী নিহতের ঘটনায় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে চতুর্থ দিনের মতো মতিঝিলে আন্দোলন করছেন দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।
বুধবার সকাল থেকে মতিঝিলে জড়ো হন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। সড়কে জড়ো হয়ে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন- দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবেন না।
মতিঝিল শাপলা চত্বরে নটর ডেম কলেজ, মতিঝিল মডেল ও আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ করছেন। অবরোধ থেকে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ, নিরাপদ সড়ক চাই ও ঘাতক জাবালে নূরের চালকদের দ্রুতবিচার এবং ফাঁসির দাবি ছাড়াও বেশ কয়েকটি দাবি করা হয়েছে।
দাবিগুলো হল- নৌপরিবহনমন্ত্রী সব সংসদীয় কমিটি, মালিক-শ্রমিক ফেডারেশন ও মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ, ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারের ন্যায্য দাবি পূরণ, পেশাদার লাইসেন্স প্রদানে স্বচ্ছতা, সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি, বিগত দিনের সব দোষীকে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতকরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসংলগ্ন এলাকায় ওভারব্রিজ, সব প্রকার দলীয় আচরণ ত্যাগ করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা, পরিবহন খাতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সর্বোচ্চ আইন প্রণয়ন, ক্ষতিগ্রস্তদের বাস্তবসম্মত ক্ষতিপূরণ, গাড়ির ফিটনেস ও শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া কার্যকর করা।
অন্যদিকে সকাল ৯টা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া ও রায়েরবাগে সড়ক অবরোধ করছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
————-০———————
বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে আজ বুধবারও চতুর্থ দিনের মতো রাজপথে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। দিনের শুরু থেকেই নগরীর রাজপথগুলো ছিল ফাঁকা। ফলে যাত্রীদের পড়তে হয়েছে দুর্ভোগে।
সকালে ঢাকার প্রবেশপথ শনির আখড়ায় সড়ক অবরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। এতে শনির আখড়া থেকে যাত্রাবাড়ী- সায়েদাবাদের রাস্তা ও ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের রাস্তা অচল হয়ে গেছে। ঢাকায় প্রবেশের পথে ব্যস্ততম এই সড়ক বন্ধ করায় ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। তারা পায়ে হেঁটে যে যার গন্তব্যের দিকে রওনা হয়েছেন।
ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটে অবস্থান নিয়েছে সরকারি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া হাউজবিল্ডিং ও শনিরআখড়ায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। এতে করে ওইসব সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে জনগণ ভোগান্তিতে পড়েছেন। মানুষজনকে কর্মস্থলে হেঁটে যেতে দেখা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, সকাল নয়টার দিকে সরকারি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করে ফার্মগেট এলাকায় অবস্থান নেয়।
রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সিটি কলেজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ফলে আজিমপুর থেকে মিরপুরগামী রোডে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
অপরদিকে হাউজবিল্ডিং সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে যান চলাচল বন্ধ।
নগরীতে পরিবহন নিয়ে দুর্ভোগের পরও অফিসগামী পথচারীরা বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। বেসরকারী অফিসে কর্মরত হানিফ সরকার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সফলতা কামনা করে বলেন, দুইদিন ধরে আমাদের দুর্ভোগ হচ্ছে। তারপরও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানাই।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাস বিমানবন্দর সড়কের জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির আবদুল করিম এবং একাদশ শ্রেণির দিয়া খানম মিম নিহত হন।
ওই ঘটনার পর দোষীদের বিচার চেয়ে ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা।
আরো দেখুন: মালিক যতো ক্ষমতাধর চালক ততোই বেপরোয়া
আবু ইউসুফ। পুলিশের একজন এডিশনাল এসপি। সিলেট রেঞ্জে কর্মরত রয়েছেন। দীর্ঘদিন ঢাকার ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন। সেই সুবাধে ঢাকার ট্রাফিক বিভাগ ও যানবাহন নিয়ে তার অভিজ্ঞতা অনেক। তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘ট্রাফিকের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- মালিক যত পাওয়ারফুল, ড্রাইভার তত পাওয়ার দেখায়।’
শুধু পুলিশ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নয়,ক্ষমতার এই দাপট হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন সাধারণ মানুষরাও। ক্ষমতার দাপটে তারা আইনকে থোরাই কেয়ার করে। আর চালকদের এই ক্ষমতার উৎস হচ্ছেন তাদেরই মালিকরা। মারিকদের মধ্যে রয়েছেন রাজনৈতিক কর্মকর্তা, ধনাঢ্য শিল্পপতি, প্রভাবশালী, এমনকি; ক্ষমতা সম্পন্ন সরকারী কর্মকর্তাগণ। এই ‘পদমর্যাদার’ লোকদের সুবিধা হলো-তাদের গাড়ী থেকে চাঁদা দিতে হয় না, কাগজপত্র ঠিক না থাকলেও বিআরটিএ কিছু বলে না,রক্ষায় পুলিশী হয়রানীর শিকার হতে হয় না-ইত্যাদি। যে কারণে এই দাপুটে লোকদের অনেকেই পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মন্ত্রী-এমপিদেরও অনেক গাড়ী রয়েছে। যা নির্বিঘ্নে রাস্তায় চলছে। এসব গাড়ী কাউকে চাপা দিয়ে মেরে ফেললেও কিছু যায় আসে না; এমনই অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেকে রয়েছেন যাদের একটি গাড়ীও নেই কিন্তু পরিবহন কোম্পানী খুলে বসেছেন। কোম্পানীর নামে তারা বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ী চালান। বিনিময়ে তারা পান মাসোয়ারা। কোন পূঁজি বিনিয়োগ না করেই তারা বসে বসে গাড়ী প্রতি দিনে ৫০০-১০০০ টাকা নিয়ে যান।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারী কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীসহ অর্ধশতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। এরমধ্যে বেশ কয়েকজন রয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের নিয়ন্ত্রণেই রাজধানীসহ সারাদেশের পরিবহন ব্যবসা। আর এমন ব্যক্তিদের গাড়ীতেই বেশী দুর্ঘটনা ঘটছে। এই পরিবহন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর মিরপুর থেকে চলাচলকারী চয়েজ, সিল্কসিটি, বিকল্প, বিহঙ্গ, শিখর, ইটিসি, ইউনাইটেড, দিশারী, নিউভিশন, সুপার সিটিং, শিকড়সহ বিভিন্ন কোম্পানির মিনিবাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলছে। এ ছাড়া বিমানবন্দর সড়কে চলাচল করছে প্রভাতী, আজমেরী, সুপ্রভাত স্পেশাল ও গাজীপুর পরিবহন। গুলি¯Íান-ধামরাই রুটের বাস দিশারী, গাবতলী মিনিবাস মালিক সমিতি, নিউ ভিশন, ভুঁইয়া, মৌমিতা, তেঁতুলিয়া, ঠিকানা, সাভার, নূরজাহান মানিকগঞ্জ, ফুলবাড়িয়া, প্রজাপতি, লাব্বাইক, আশীর্বাদ, প্রজাপতি, হিমাচল ও বসুমতী, মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুরগামী মৈত্রী, এটিসিএল, দিপন পরিবহনের বাসগুলো যাত্রী হয়রানির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে। এর অধিকাংশের মালিক হলেন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক লোকজন। বিশেষ করে ক্ষমতাসনী দলের সঙ্গে তারা কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন। আবার কখনো কখনো দেখা গেছে রাজনৈতিক বৈরী হাওয়ায় রাতারাতি এসব কোম্পানীর মালিক পরিবর্তন হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, শুধু ব্যবসা করার জন্যই এই খোলস পরিবর্তন। রাতারাতি কোম্পানীর নাম পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর কনক পরিবহন মিরপুর থেকে আগারগাঁও, মহাখালী, কাকলী হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত রুটে ১৫টি বাস নামানোর অনুমতি পায়। এরূপ আরো বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানী রয়েছে; যার সাথে ক্ষমতাসনী দলের নেতা-কর্মীরা সরাসরি জড়িত আছেন। গত রোববার জাবালে নূর নামের যে বাস হোটেল রেডিসনের সামনে দুই শিক্ষার্থীকে ফুটপাতে পিষে মেরেছে ওই পরিবহনের উদ্যোক্তা অরাজনৈতিক হলেও এর পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মিরপুর যুবলীগের এক নেতা। আরেকজন পরিচালক হচ্ছেন এক মন্ত্রীর আত্মীয়। প্রজাপতি পরিবহনের মালিক আওয়ামী লীগের মিরপুরের এক সাবেক এমপি। বসুমতী পরিবহন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উলøাহর। আজিমপুর থেকে উত্তরা রুটে চলাচলকারী ‘সূচনা-বিআরএফ’ পরিবহনে রয়েছে সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর ছেলের বাস। একজন প্রভাবশালী এমপির চাচাতো ভাইয়ের বাসও চলে ‘সূচনা-বিআরএফ’ পরিবহনে। রাজধানীতে গাড়িচাপায় সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছে তেঁতুলিয়া পরিবহন।
মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর হয়ে আবদুল্লাহপুর রুটে পরিচালিত এই পরিবহনে অনুমোদিত গাড়ি আছে মাত্র ৫০টি। অথচ একই সাইনবোর্ডে ১৩০টিরও বেশি গাড়ি চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তেঁতুলিয়া পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান ভোলার এক এমপি। জানা যায়, মাত্র আড়াই বছরে তেঁতুলিয়া গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ও বেপরোয়া চালানোজনিত দুর্ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। প্রভাবশালী হওয়ায় এই পরিবহনের কোন চালককে আইনের আওতায় নেয়া যায় না।
আজিমপুর, মিরপুর-১২, কুড়িল ও সদরঘাট রুটে চলাচলকারী বিহঙ্গ নামের পরিবহনের গাড়ির সংখ্যা ৩০০ এর উপরে। তবে সবই লক্কর ঝক্কর মার্কা। বিহঙ্গ পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন শীর্ষ নেতা। মালিক সমিতির অনেক নেতা রয়েছেন যাদের গাড়ী নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটায়। কিন্তু তারপরও কোন বিচার হয় না।