ক্রাইমবার্তা রিপোট: কোটা আন্দোলনের রেশ কাটতে না কাটতে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে চলমান শিক্ষার্থী আন্দোলন নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছে সরকার। টানা ষষ্ঠ দিনের এ ছাত্রবিক্ষোভে প্রতিদিনই নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা যুক্ত হচ্ছেন। রাজধানী ঢাকার এ আন্দোলন ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। আন্দোলনের রাশ টানতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলেও থামানো যায়নি শিক্ষার্থীদের। সরকারের তরফ থেকে বারবার দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়া হলেও রাস্তা ছাড়ছে না বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সমবেত হয় শিক্ষার্থীরা। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন অভিভাবকেরাও। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে দুর্ভোগ পোহানো সত্ত্বেও এ আন্দোলনকে যৌক্তিক আখ্যা দিয়ে হাসিমুখে সমর্থন জানাচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তবে এ আন্দোলনকে আর সামনে এগোতে দিতে চান না সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। সে জন্য এবার শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমনের দিকেই যাচ্ছে সরকার।
সরকারের সূত্রগুলো জানায়, চলমান শিক্ষার্থী আন্দোলন নিয়ে সরকারের দু’টি মত ছিল। নীতিনির্ধারকদের একটি পক্ষ আন্দোলনকে শুরুতেই দমনের পক্ষে ছিলেন। তাদের মতে, এ আন্দোলন দীর্ঘদিন চলতে থাকলে তার সুযোগ নিতে পারে সরকারবিরোধীরা। একপর্যায়ে তা সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিতে পারে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দমনের পক্ষে অবস্থান নেন তারা।
তবে অন্য পক্ষ মনে করছে, এ আন্দোলনের নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ কোনো নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বরং যে যার মতো করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে। সাধারণ জনগণও তাদের এ আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছেন। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের ওপর দমনপীড়ন চালানো হলে তা সরকারের জন্য বুমেরাং হতে পারে। সেজন্য জনজীবনে দুর্ভোগ বেড়ে চললেও এ মুহূর্তে চরম ধৈর্যধারণ ও ধীরে চলো নীতিকেই প্রাধান্য দেন তারা।
তবে আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের হাতে কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রী ও এমপিসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নাজেহাল হওয়া এবং শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণার পরও রাস্তা না ছাড়ায় সরকারে ক্ষোভ বাড়ছে। এ ছাড়া এ আন্দোলনের ফল একপর্যায়ে সরকারবিরোধীদের ঘরেই যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য আন্দোলন দমনের দিকেই হাঁটছে সরকার।
সূত্রগুলো জানায়, শিক্ষার্থী আন্দোলন দমনে করণীয় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে প্রশাসনের একাধিক বৈঠক হয়েছে। এ ছাড়া দলীয়ভাবেও সক্রিয় হয়ে উঠছেন সরকারসমর্থিত নেতাকর্মীরা। পাড়া মহল্লায় অবস্থান নিয়ে আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করতে ইতোমধ্যেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একইসাথে আন্দোলনে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির সমর্থক বা কর্মীরা যুক্ত হতে না পারে সে ব্যাপারে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ভণ্ডুল করে দিতে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ দিকে বৃহস্পতিবার মিরপুরে কোমলমতি ছাত্রদের ওপর পুলিশি হামলা চলাকালে ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ ওই এলাকার সরকার সমর্থক নেতাকর্মীরাও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিদিনই সড়কপথে এ রকম হতাহতের ঘটনা ঘটছিল। কিন্তু রাজধানীতে দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় এত বড় আন্দোলন দানা বাঁধবে তা ঘূণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি ক্ষমতাসীনদের কেউ। শিক্ষার্থীদের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়ার জন্য সড়ক পরিবহন শ্রমিক নেতা এবং সরকারের মন্ত্রী শাজাহান খানকে দায়ী করা হচ্ছে। পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও চালকদের স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবেই সরকারে চিহ্নিত তিনি। এবারো তাদের পক্ষে ন্যক্কারজনকভাবে সাফাই গেয়ে শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়েছেন মন্ত্রী। এ কারণে তার ওপর সিনিয়র মন্ত্রীরাসহ সরকারের সবাই খুব বিরক্ত। প্রধানমন্ত্রী নিজেও তাকে ডেকে ভর্ৎসনা করেছেন। শাজাহান খানের হয়ে সিনিয়র মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। পরে শাজাহান খান নিজেই কুৎসিত হাসি ও বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চান। শুধু তাই নয়, নিহত শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছেও ক্ষমা চান মন্ত্রী। তবুও বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামেনি। এমন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার নিহত দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ডেকে ২০ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদানও প্রদান করেন। সেখান থেকে অভিভাবকেরা আন্দোলন ছেড়ে ঘরে ফিরে যেতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান। এর আগে শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেয়া হয়েছে ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনকারীদের ঘরে ফিরে যেতে সরকারের তরফ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হলেও তাতে সাড়া দেয়নি আন্দোলনকারীরা। বরং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, জাতীয় পার্টি-জেপি চেয়ারম্যান ও পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ এমপির সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তারা সবাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যৌক্তিক বলে সমর্থন জানান। এ অবস্থা চলতে থাকলে সরকারের কোনো নেতা বা মন্ত্রী এমপি শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পাবেন না। তাই যেভাবেই হোক এ মুহূর্তে আন্দোলন দমন ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবছে না সরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের তিন নেতা এ প্রতিবেদককে জানান, নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানকে নিয়ে দল ও সরকারে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তবে পরিবহন খাতে তার প্রভাবের কথা ভেবে সরকার মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। উল্টো আজ শনিবার ও রোববার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করা হবে। তারা যদি রাস্তা না ছাড়ে তবে হার্ডলাইনে যাবে প্রশাসন।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে গতকাল বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যৌক্তিক এ কথা সরকার স্বীকার করেছে। কিন্তু এ যৌক্তিক আন্দোলনকে অযৌক্তিক পথে উসকানি দিয়ে ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করার বিষয় অশুভ চক্রান্ত লক্ষ করছি। একটি রাজনৈতিক মতলবি মহল এই শিশুদের সমাবেশে খাবার পানি সরবরাহ করছে এবং উসকানি দিচ্ছে আরো উত্তেজিত হওয়ার জন্য।’
তিনি বলেন, আমাদের মন্ত্রী, এমপি অনেকেই নাজেহাল হয়েছেন। আমরা মনে করি শিক্ষার্থীরা তাদের নাজেহাল করেনি। অনুপ্রবেশ করে মতলবি মহলটি অপকর্ম করেছে পুলিশ বিজিবি অফিসার ও ভদ্রলোককে অপমান অপদস্থ করেছে। এ অবস্থায় পাড়া মহল্লায় নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধারণ করে আন্দোলন মনিটর করার জন্য বলা হয়েছে, যাতে মতলবি মহল না ঢুকতে পারে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘ছাত্রদের সব দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবুও তারা আন্দোলন করে যাচ্ছে। আমরা প্রমাণ পেয়েছি তাদের এ আন্দোলনে শিবির-ছাত্রদল ঢুকে পড়ছে। তারা সাবোটাজ করতে চায়। আন্দোলনে উসকানি দেয়া মোবাইলের অডিও রেকর্ডও পেয়েছি। তাই শিক্ষার্থীদের বলব তোমরা ক্লাসে ফিরে যাও। পরবর্তী কোনো দায়ভার সরকার নেবে না।’নয়াদিগন্ত।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …