যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে লা মেরিডিয়ান। পেশার প্রয়োজনে যেতে হচ্ছিল ওই পথ ধরে। পথ-ঘাট প্রায় যানবাহন শূন্য। মাঝে মধ্যে দু-একটি সৌভাগ্যবান আরোহীসহ রিকশা দেখা যাচ্ছিল। পথের দুধারে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় পথচারীরা শোরগোলতুলে হেঁটে যাচ্ছিল।
কোনোমতে বিশ্বরোডের রেললাইন পার হয়ে এয়াপোর্ট রোডে দাঁড়ালাম। দুদিকে পথের যতদূর ইচ্ছা দেখা যাচ্ছিল। যেন গ্রামের মেঠোপথ। শোরগোল তুলে কয়েকদল শিশু-কিশোর ইস্কুলের ড্রেস পরা, ছোটাছুটি করছে। সামান্য কিছু গাড়িকে বারবার ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ আনন্দ পাচ্ছে ওরা। তবে ভাব ভঙ্গিতে বড়দের মত একটা দায়িত্বপালনের গাম্ভীর্য!
আনন্দ লাগছিলো আমারও। কিন্তু কাজে যেতে হবে। এর মধ্যে একটা সাদা শূন্য প্রিমিও এসেছে। ওরা ডিজিটাল ড্রাইভিং কার্ড দেখে ছেড়ে দিচ্ছিল। আমি লিফট নেয়ার জন্য জানতে চাইলাম কতদূর যাবেন? সঙ্গে সঙ্গে ওরা বললো ওনাদের নিয়ে যান। হাসিমুখে ড্রাইভার আমাকে উঠিয়ে নিলো, পাশে আরও একজন উঠে পড়লেন। গন্তব্যে নেমে কাজ শেষে ফিরে এলাম। পথে দেখলাম বসুন্ধরার গেটে ওরা পথের পাশে রাখা বালির স্তুপ সরিয়ে পথ পরিষ্কার করছে।
মনে হলো, গত দু দিনের ট্রাফিকের দায়িত্ব নেওয়ার অভিজ্ঞতায়, অবিবেচকের মত পড়ে থাকা বালি-মাটির স্তুপগুলোকে এ এলাকার বড় সংকট বলে চিহ্নিত করেছে শিক্ষার্থী ছেলে-মেয়েরা।
আরও এক জায়গায় দেখলাম, একটা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষজন। ছাত্রদের একজনকে প্রশ্ন করতেই জানালেন, লাইনে দাঁড়ানো সবারই কাগজপত্রে সমস্যা রয়েছে। দায়িত্বরত পুলিশ সার্জেন্ট তাদের সকলের নামে মামলা করছেন।
বৃষ্টিটা একটু জোরে এলো। আমার ভিজতে ভালো লাগে বরাবরই। ভিজলাম কিছুক্ষণ ওদের সঙ্গে। বৃষ্টি ভেজার আনন্দ আর কাকে বলে! সাথে কেতাদুরস্ত মাল্টিন্যাশনাল কর্মকর্তা বন্ধুটিও তার জরুরি কাজ ভুলে সঙ্গ দিলেন।
ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, হাইস্কুলে পড়তে সময় ‘নৌ স্কাউটের’ সাথে যুক্ত ছিলাম। তখন বছরে ডিসেম্বরের দিকে একবার ট্রাফিক সপ্তাহে অংশ নিতাম। স্কাউট ইউনিফর্ম পরে রোডে দাড়িয়ে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন, গাড়ির হেডলাইটের একের তিনভাগে কালো রং করে আইন অমান্য করার জন্য জরিমানা আদায় করতাম। আবার বৃদ্ধ বা শিশু-নারীদের পথ-পারাপারে সাহায্যও করতাম। ভীষন উৎসব অনুভব করতাম। দেশের জন্য, মানুষের জন্য আনন্দের কিছু করতে পারার অভিজ্ঞা ছিল।
আমাদের স্কুলের ছেলে-মেয়েদের দিয়ে ট্রাফিক সপ্তাহ করে ওদেরও যেমন আইন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া সম্ভব। আবার সবার মাঝে সচেতনতা ও জাগিয়ে তোলা সম্ভব বলে মনে হয়। নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারেন বিষয়গুলো।
পথে চলতে চলতে বারবার ছেলে মেয়েরা যখন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চাচ্ছিল, তখন এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা মনে পড়ে যায়। আমার এক বন্ধু, ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে সংশ্লিষ্ট অফিসে গিয়েছেন। সেটি পেতে নাকি ৫/৬ মাস ও লেগে যায়, কিন্তু দালালকে টাকা দিলেই অল্পতে কাজটি হয়ে যাবে। তিনি যথাসময়ে পরীক্ষা দিয়ে আসলেন, এর কয়েক দিনের মধ্যে দালাল ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে অফিসে উপস্থিত।
মোটর বাইকের পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে দেওয়া হয়েছে মোটরবাইকসহ ভারি যনিবাহন মানে বাস-ট্রাক চালানোরও লাইসেন্স। বন্ধুটি জানতে চাইলেন, আমি তো বাস-ট্রাক চালাতে পারি না। তাহলে এটা এনেছেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন, রাইখাদেন স্যার, যদি কাজে লাগে।
বন্ধুটি অবশ্য একজন নামকরা ডিজাইনার। সময় বাঁচানোর জন্য দালাল ধরতে বাধ্য হলেও সচেতন মানুষ। তিনি সেটি ফেরত দিয়ে মোটরবাইকের লাইসেন্স নিয়েছিলেন।
তো যোগ্যতা থাক বা না থাক, লাইসেন্স পাওয়া খুব কঠিন কিছু না হয়তো। তাই সংস্কারের যে কথা উঠেছে, সেখানে সামগ্রিক সচেতনতা জরুরি।
না হতাশ করে বিদায় নিচ্ছি না। উন্নত বিশ্বে মানুষজন অনেক বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনযাপন করার ফলে পরিবার ও সন্তান পালনের দিকে অনীহা। এর মধ্যে আর্থিক অসঙ্গতির বিষয়ও আছে। তাই তাদের তরুণ প্রজন্ম আশঙ্কাজনকহারে কম। কিন্তু বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে তরুণ প্রজন্ম বেশি। ফলে উন্নত দেশগুলো আগামীর বাংলাদেশের উন্নয়নকে একটি বৈপ্লবিক সম্ভাবনা বলে ঘোষণাও করে দিয়েছে।
অনেকেই দেশকে গালি দেন। বিদেশের সাথে তুলনা করে ফ্রাস্ট্রেটিং (হতাশাজনক) পোস্ট দেন দেখি সামজিক গণমাধ্যমে। তাদের জন্য এটা একটা গোল্ডেন সিগনাল।
আর শিশুদের পিঠে সওয়ার হয়ে মৃদু হয়ে আসা অনেক বিপ্লব-ব্যবসায়ী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন। শিশুদের উদাহরণ তৈরি করে সুস্থভাবে ক্লাস রুমে ফিরতে দেন। ওরাই আগামীর বাংলাদেশ, আজকের বাস্তবতা। ওদরে ওপর নিজের ফ্রাস্টেটিং অশ্লীল শ্লোগান চাপিয়ে উৎসাহিত করবেন না। পুলিশ কোন চ্যাটের বাল টাইপের লেখা তাদেরই সন্তানদের বুকে ঝুলিয়ে বিপ্লব ব্যবসা জমবে না। এসব বিদ্যেশের রাজনীতি, ঘৃণার রাজনীতি। ওদের ভক্তি, শ্রদ্ধা, দেশের প্রতি মমতা অনুভবে পারলে উৎসাহিত করুন। মনে রাখবেন সব আগুনে আলু পোড়ানোর ধান্দা রাখতে নেই!
আরও একটা বিষয় হচ্ছে, ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ও বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম বারবারই স্কুলের কোমলমতি ছেলে মেয়েদের কাছে ছুটে যেতেন, তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। আর একই সঙ্গে নিজেকেও নবায়ন করে নিয়ে আসতেন বলে তার ইগনাইটেড মাইন্ড বইয়ে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন কয়েকবার।
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিও বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। আগামীর রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছেও সেই একই দাবি। অন্তত শিক্ষার্থীদের ৩ দিনের ঢাকার ট্রাফিকের একটা দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি।
তারুণ্যের জয় হোক! মানুষের জয় হোক!! জয় বাংলা!!!
লেখক: তরিক রহমান, হেড অব আইটি, দৈনিক যুগান্তর