ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট:
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন মাত্রা মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার আরো বেশি জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। তাদের বাকশালী ও ফ্যাসিবাদী আচরণ পরিষ্কার হয়েছে। তবে এই আন্দোলনকে দমাতে সরকারের আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান বিএনপির মহাসচিব।
আজ শুক্রবার সকাল সোয়া দশটার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব বলেন।
তিনি বলেন, আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের প্রতি প্রকাশ্যেই সমর্থন জানিয়েছি। এটা অপরাধ হলে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ কর্মকর্তারা পর্যন্ত একই অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু যে সরকার প্রার্থী, ভোটার এবং ভোট ছাড়া নিজেরাই নিজেদের নির্বাচিত ঘোষণা করে জোর করে রাষ্ট্র চালাতে লজ্জাবোধ করে না তাদের কাছ থেকে পক্ষপাতমূলক বক্তব্য ও আচরণ ছাড়া আর কি আশা করা যেতে পারে। আমরা নিশ্চিত যে নানা বাধা বিপত্তির মধ্যেও মিডিয়া ও সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী প্রকৃত তথ্য পরিষ্কারভাবে জেনে গেছেন বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ক্রমাগত মিথ্যাচারে তারা বিভ্রান্ত হবেন না।
নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আব্দুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, কেন্দ্রীয় নেতা এবিএম মোশারফ হোসেন, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, মো: মুনির হোসেন, তাইফুল ইসলাম টিপু, বেলাল আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, লাইসেন্সবিহীন বাসচালকের বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের ফলে ঢাকায় দু’জন স্কুল ছাত্র-ছাত্রীর অকাল ও নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের যে অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধ এবং সুশৃংখল প্রতিরোধের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতি ও আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। সতীর্থ ভাই-বোনদের নির্মম হত্যাকন্ডের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠা শিশু কিশোরদের এই যুগান্তকারী আন্দোলন শান্তিপূর্ণ, গাড়ির কাগজপত্র চেক করার মতো গঠনমূলক এবং উপযুক্ত কাগজপত্র না থাকায় মন্ত্রী, বিচারপতি, পুলিশ কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের সম আচরণ ছিল দৃষ্টান্তমূলক ও শিক্ষণীয়। তাদের দাবি ছিল নিরাপদ সড়কের এবং তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই তারা গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করাটাকে একটা অন্যতম প্রাথমিক কাজ হিসাবে গ্রহণ করেছিল। তারা কারো সাথে দুর্ব্যবহার কিম্বা দেয়াদবী করেনি বরং সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। রিকশাগুলোকে এক লাইনে চলার এবং অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ির জন্য নির্দিষ্ট লাইন ফাঁকা রাখার মতো আইনী ও আধুনিক ব্যবস্থা যে করা সম্ভব তা প্রমাণ করে দেখিয়েছে।
তিনি বলেন, সমগ্র দেশবাসী থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তাদের আন্দোলকে সমর্থন দিয়েছে। প্রধামন্ত্রীও সমর্থন দিয়েছে। যে কারণে বিএনপিও সমর্থন করে। কিন্তু পরবর্তীতে সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ এই সরকার আন্দোলন নস্যাৎ করতে চক্রান্ত করেছে। চলমান এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে সরকার বিএনপিকে জড়িয়ে মিথ্যাচার করছে। ছাত্র-ছাত্রীরা অভিযোগ করেছে যে, সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে ধানমন্ডি আওয়ামী লীগের অফিস থেকে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওইসব সন্ত্রাসীরা হেলমেট পড়ে আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের রক্তাক্ত ও জখম করেছে। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে সেখানে মুহুর্মুহু গুলি হয়েছে তাতে অনেক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর যে পৈশাচিক আক্রমণ হয়েছে তার বিবরণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, কয়েক গত কয়েদিন ধরে একেবারে শান্তিপূর্ণভাবে নিরাপদ সড়কের জন্য শিক্ষণীয় আন্দোলন করছিলো। ছাত্র-ছাত্রীদের এই আন্দোলন শুধু তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য, নিরাপদ সড়কের জন্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে চিহ্নিত করে ছাত্র-ছাত্রীদের এই ন্যায়সঙ্গত যৌক্তিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য যে মন্তব্য করেছেন আমি তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। সরকার সুপরিকল্পিতভাবে এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য বিএনপিকে জড়িয়ে মিথ্যা কথা বলছে।
তিনি বলেন, আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের এই ন্যায়সঙ্গত যৌক্তিক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছি এবং অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষেত্রে সব বিষয়ে ব্যর্থতার জন্য সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছি।
ফখরুল বলেন, আমরা কখনোই কোনো সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে কাউকে উৎসাহ দেয়নি এবং দেই না। বরং সরকার ও সরকার দলীয় সন্ত্রাসীরা আজ ন্যাক্কারজনক সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর চালিয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপরও ঠিক একইভাবে যে সন্ত্রাসী আক্রমণ চালিয়েছিলো এটা তারই ধারাবাহিকতা।
সরকারের এহেন হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে একদলীয় বাকশালী ও ফ্যাসিবাদী চরিত্র পুণরায় প্রকাশিত হয়েছে মন্তব্য করে এর বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হওয়ার আহবানও জানান মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, আন্দোলন নিয়ে মিথ্যাচারের একপর্যায়ে সরকার খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার শহিদুল আলমকে গ্রেফতার করেছে। তার কি অপরাধ তিনি আল জাজিরায় সাক্ষাতকারে বলেছেন, সরকার এখানে বাকস্বাধীনতা খর্ব করছে। এরা অনির্বাচিত সরকার। এরপরই তাকে গ্রেফতার ও নিপীড়ণ করা হলো। তাহলে এখানেই তো সরকারে ফ্যাসিবাদী আচরণ পরিষ্কার হলো। এরপর তারা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। ছাত্রদলের নেতকর্মীদের নামেও মামলা দিয়েছে। আসলে এই সরকার আন্দোলনের কারণে ভীত হয়েছে।
সেইসাথে মিথ্যা মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য ক্ষমতাসীন অবৈধ সরকার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। তার সুচিকিৎসা পর্যন্ত করা হচ্ছে না। নানা বাহানায় তার মুক্তি বিলম্বিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা চালিয়েও সরকার নিজেদের নিরাপদবোধ করছে নাÑ তারা দলের সিনিয়র নেতাদের সম্পর্কে হাস্যকর ও বানোয়াট গল্প প্রচার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ সব কিছুর উদ্দেশ্য একটাইÑ আর তা হলো পুনরায় এক দলীয় স্বৈরাশাসন কায়েমের সরকারী নীল নকশা বাস্তবায়ন। আমরা এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সচেতন থাকার ও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ অফিসে নাকি বিএনপির নেতাকর্মীরা আক্রমণ করেছে! এটা আসলে একটা পাগলও বিশ্বাস করবে না। সেখানে পুলিশের সহায়তায় হেলমেট পরে লাঠিসোটা ও রড নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু ওবায়দুল কাদের এই ঘটনায় যে বক্তব্য দিয়েছেন, তিনি রসিকতা করেছেন। আক্রমণকারীদের হামলার ছবি তো পত্র-পত্রিকায় ছেপেছে। সুতরাং যে সরকার জনগণের ভোট ছাড়াই নিজেরা নিজেদেরকে নির্বাচিত ঘোষণা দেয় তাদের কাছে পক্ষপাতমূলক আচরণ পাওয়া স্বাভাবিক।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে যেসব শিক্ষার্থীকের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মুক্তির দাবি করে আহতদের সুস্থতা কামনায় সবার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান বিএনপির মহাসচিব।
এছাড়া সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বাড়িতে হামলা এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বার্ণিকাটের ওপর সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে আক্রমণকারীদের গ্রেফতারের দাবি জানান মির্জা ফখরুল।