সড়ক-মহাসড়কের ১৩ হাজার কিলোমিটারই যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী

কামাল উদ্দিন সুমন : চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে দেশের অধিকাংশ সড়ক। বেহাল সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। আর ভাঙ্গাচুরা সড়ক দিয়ে চলাচলের কারণে দুর্ভোগের শেষ নেই মানুষের। বেহাল সড়ক মেরামত নিয়ে হাজারো অভিযোগ আমলে নেয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে নিজ নিজ জেলার বেহাল সড়কের চিত্রতুলে ধরে ঈদের আগে মেরামতের দাবি জানান জেলা প্রশাসকগণ। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে এই দাবি জানানো হয় । এছাড়া বেহাল সড়কের চিত্র তুলে ধরে খোদ সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর বলছে, সড়ক মহাসড়কের বেহাল দশা আরো বেড়েছে।
সূত্র বলছে, সারাদেশে ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক ও মহাসড়কের মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার সড়ক যান চলাচলের অনুপযোগী। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জেলা ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলো। সড়কের অধিকাংশ স্থানে পিচ ঢালাই উঠে গিয়ে ইট-সুরকি বেরিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। আসন্ন ঈদুল আজহার আগেই ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো মেরামত চেয়েছেন জেলা প্রশাসকরা।
সূত্র জানায়, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ)’র অধীনে ৬৫৪টি জেলা সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সবকটি সড়কের বেহালদশা। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রয়েছে খুলনা, যশোর, নেত্রকোনাসহ দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সড়কগুলো। তাই  ঈদুল আজহার আগে জেলা সড়কগুলো সংস্কারের কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসকগণ।
সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী ঈদুল আজহা যাতে স্বস্তিদায়ক ও যানজট মুক্ত হয় সেজন্য সারাদেশের জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এজন্য ঈদের আগে ও পরে সড়ক-মহাসড়কে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভারী বর্ষণ ও বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো দ্রুত মেরামত করে যান চলাচলের উপযোগী রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, সারাদেশে ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কের মধ্যে সড়কের মধ্যে ৩ হাজার ৮১৩ কিলোমিটারের ৯৬টি জাতীয় মহাসড়ক, ৪ হাজার ২৪৭ কিলোমিটারের ১২৬টি আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটারের ৬৫৪টি জেলা মহাসড়ক রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে যান চলাচলের কিছুটা উপযোগী থাকলেও খুব খারাপ অবস্থা জেলা ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলো। প্রায় ১৩ হাজার ৪৮৯ কিলোমিটার সড়কেই যান চলাচলের অনুপযোগী। এছাড়া বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে খানাখন্দে ভরা সড়কে বড় বড় গর্ত একটি একটি মৃত্যুর ফাঁদ তৈরি হয়েছে। বন্যা ও বৃষ্টিতে সড়ক-মহাসড়কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাই ঈদের আগে সড়কগুলো দ্রুত সংস্কারের দাবি জানান স্থানীয়রা।
ডিসি সম্মেলন শেষে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম বলেন, নেত্রকোনা জেলায় সব বড় বড় সড়কেই খারাপ অবস্থা। প্রায় সড়কেই সংস্কার কাজ হচ্ছে। তবে বৃষ্টির কারণে সংস্কার কাজ করা যাচ্ছে না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা শ্যামগঞ্জ ও থেকে দূর্গাপুর পর্যন্ত সড়কটি। এই সড়কটি সংস্কার কাজ হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে সড়কের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে যাওয়ায় আরও খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি।
সওজ সূত্র জানায়, জেলা পর্যায়ে সওজ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সড়ক রয়েছে। এসব সড়কের অধিকাংশ স্থানে পিচ ঢালাই উঠে গিয়ে ইট-সুরকি বেরিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। খানাখন্দর সড়কে ধুলাবালিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যাত্রীদের পোশাক। এসব সড়কে অনেক স্থানে খোয়া-বালি উঠে গিয়ে শুধু মাটির ওপর দিয়ে চলছে যানবাহন। এর মধ্যে সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, বরিশাল ও খুলনা বিভিন্ন জেলা সড়কের খারাপ অবস্থা। তবে ফরিদপুর-যশোর মহাসড়কে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মাগুরা-যশোর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার সড়ক ও ভৈরব-কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন মহাসড়কে খানাখন্দ ও গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লাা, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুর, বাগেরহাট, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সকল জেলা সড়কগুলো যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়।
এর মধ্যে শরীয়তপুরের আলুরবাজার থেকে মাদারীপুরের আঙ্গারিয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা দীর্ঘদিন থেকেই বেহাল অবস্থা। তিন বছর আগে ২২ কোটি টাকায় সংস্কারের কাজ হলেও এখন আবার খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। সড়কটিতে তৈরি হয়েছে অসংখ্য বড় বড় গর্ত। প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছে আশপাশের লোকজন।
এদিকে ত্রিশাল ও ফুলবাড়ীয়া উপজেলার অন্যতম বইলর-ফুলবাড়ীয়া সড়কের বেহাল অবস্থা। প্রায় দুইশ গ্রামের কয়েক লাখ মানুষের চলাচল এ রাস্তাটি দিয়ে। বর্তমানে ত্রিশালের শেষ সীমানা পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পাকা রাস্তার প্রায় পুরোটাই বড় বড় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। দুই উপজেলার সংযোগ সড়কের এই বেহাল অবস্থার ফলে অন্তহীন দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। নিম্নমানের কাজ হওয়ায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বইলর মোড় থেকে ত্রিশাল উপজেলার শেষ সীমানা পর্যন্ত ওই ৫ কিলোমিটারর পাকা রাস্তাটির বেশিরভাগ অংশে বড় বড় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।
যশোর জেলার বেনাপোল শার্শায় সড়কের বেহাল অবস্থা মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ। জেলার সীমান্তবর্তী শার্শা উপজেলায় গ্রামীণ জনপদের পাকা সড়কের বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এর ফলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে এলাকার মানুষ। দুর্বিষহ হয়ে ওঠছে মানুষের জনজীবন। শতাধিক কিলোমিটার সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। যশোর জেলার শার্শা উপজেলায় এক হাজার দুইশ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক রয়েছে। গ্রামীণ এ সড়ক দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে পথচারীরা।
শার্শা উপজেলায় নাভারণ-কাশিপুর, শার্শা-স্বরপদহ, কাগজপুকুর-রামপুর, বেনাপোল-দৌলতপুর, বাগআঁচড়া-বালুন্ডা, জামতলা-বালুন্ডা, সাঁতমাইল-গোগাসহ শতাধিক পাকা সড়ক দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত অবস্থায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে বলে স্থানীয়রা জানান।
এদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদফতরের অধীনে নওগাঁর সাপাহার উপজেলা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ হতে খঞ্জনপুর বাজার পর্যন্ত  প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার রাস্তাটি দীর্ঘদিন বেহালদশায় পরিণত হয়েছে। ওই পাকা রাস্তা প্রায় সম্পূর্ণ কার্পেটিং উঠে গিয়ে হাজারো খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। সে সাথে রাস্তা চলাচলে একেবারে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই এলাকার হাজারো মানুষ ও যানবাহন এই পথেই চলা চল করছে। রাস্তায় চলতে গিয়ে হরহামেশা দুর্ঘটনার স্বীকারও হচ্ছেন অনেকে।
এদিকে দেশের রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা সম্পর্কে তিন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় তারা বলেছেন, এলাকায় গেলে মানুষের সামনে মুখ দেখানো যায় না। ভোটারদের সামনে লজ্জায় পড়তে হয়। পরিকল্পনামন্ত্রীর সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে বিটুমিনের ভাঙ্গার রাস্তার বদলে কংক্রিটের টেকসই রাস্তা নির্মাণের পক্ষে মত রাখেন সংসদ সদস্যরা। তাদের বক্তব্য বিটুমিনের তৈরি রাস্তা অল্প দিনেই নষ্ট হয়। কংক্রিটের রাস্তা সে তুলনায় হয় দীর্ঘস্থায়ী। বিটুমিনের রাস্তা তৈরিতে অনিয়মের সুযোগ থাকলেও কংক্রিটের তৈরি রাস্তার ক্ষেত্রে সে সুযোগ কম। তবেপ্র কৌশলীরা জনপ্রািতনিধিদের বক্তব্যে আপত্তি জানিয়ে বলেন, কংক্রিটের রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রেও দুর্নীতির সুযোগ থাকে। বিটুমিন না কংক্রিট  কোন পদ্ধতিতে রাস্তা নির্মাণ করা উচিত সে বিষয়ে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বিবেচনা-পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধাস্তা নেওয়া উচিত। তবে সবচেয়ে যেটি নিষ্ঠুর সত্য হয়ে দেশবাসীর বিরক্তির কারণ ঘটাচ্ছে তা হলোÍ দেশের শতকরা ৯০ শতাংশ সড়কই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
তারা বলেন, গাঁওগ্রামের রাস্তার কথা বাদ দিলেও বলা যায় মহাসড়কগুলোর অবস্থাও মোটেই ভালো নয়। খোদ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর অবস্থা এতটাই বেহাল যে, তা গ্রামের রাস্তাকেও হার মানায়। বাংলাদেশ দীর্ঘ বছর ধরে ঘাড়ে চেপে বসা স্বল্পোন্নত দেশের লজ্জা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের সোপানে পা বাড়িয়েছে। কিন্তু দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোর দিকে চোখ দিলে এগুলো মান্ধাতা আমলের সড়ক বলেই মনে হয়। সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা যে সংসদ সদস্যদের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

Check Also

৩০ জুলাই পর্যন্ত অনেক দল সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, সংগ্রামে যুক্ত হবে কি না: সারজিস আলম

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেছেন, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।