স্টাফ রিপোর্টার : আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। বাঙালি জাতির শোকের দিন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। ৪৩ বছর আগে এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ক্ষমতালোভী নরপিশাচ কুচক্রী মহল।
আজ যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যে জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর ৪৩তম শাহাদতবার্ষিকী পালনের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু ছাড়াও ১৫ আগস্ট রাতে ধানমণ্ডির বাড়িতে তার সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে তার জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল, এসবির কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান ও সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হককে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা করে তাকে ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় রেন্টু খানকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং নিকটাত্মীয়সহ ২৬ জনকে ওই রাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় তারা প্রাণে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সংগ্রামী নেতা। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ৬ দফার প্রণেতাও ছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে এ দেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ষাটের দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ ঘোষণায় উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত জাতি পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছিনিয়ে আনে দেশের স্বাধীনতা। জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর গোটা বিশ্বে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। হত্যাকারীদের প্রতি ছড়িয়ে পড়েছিল ঘৃণার বিষবাষ্প। পশ্চিম জার্মানির নেতা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসিত হতে থাকে। তারা এ দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে নানা উদ্যোগ নেয়। শাসকদের রোষানলে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও যেন নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেছিল মোশতাক সরকার। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়। বিচার শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দেয়া হয়েছিল, ৩৫ বছরেরও বেশি সময় পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সেই কলঙ্ক থেকে জাতির মুক্তি ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ওই দিন মধ্যরাতের পর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তবে বিভিন্ন দেশে পলাতক থাকায় আরও ছয় খুনির সাজা এখনও কার্যকর করা যায়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে স্বাধীনতার স্থপতিকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের পথও সুগম হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হতে থাকে। দিনটিকে সরকারি ছুটির দিনও ঘোষণা করা হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে এ ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটে। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন বাতিল করে দেয়। পরে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। ফলে জাতীয় শোক দিবস পালনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। এবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস পালন করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
আজ সরকারি ছুটি। সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয়ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এ ছাড়া দেশের সব সরকারি হাসপাতালে দিবসটি উপলক্ষে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে। চিকিৎসকরা আজ ব্যক্তিগত চেম্বারেও বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেবেন। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সব বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। এ ছাড়া পোস্টার, সচিত্র বাংলাদেশের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ও বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয়োজন করবে।
রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি : আজ সকাল সাড়ে ৬টায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন। সশস্ত্র বাহিনী গার্ড অব অনার দেবে। এ সময় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও বিশেষ মোনাজাত হবে। প্রধানমন্ত্রী সকাল সাড়ে ৭টায় বনানী কবরস্থানে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য ও নিহত অন্যদের কবরে এবং সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন। এ সময় ফাতেহা পাঠ, সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদানসহ বিশেষ মোনাজাত করা হবে। সারা দেশে সব মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসন আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলসহ জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, হামদ ও নাত প্রতিযোগিতা এবং দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : সূর্যোদয়ের সময় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলের কার্যালয়গুলোতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন (অর্ধনমিত) করা হবে। তোলা হবে কালো পতাকাও। সকাল সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে এবং সাড়ে ৭টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত করা হবে। ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন, ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত এবং বাদ জোহর মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। দুপুরে অসচ্ছল, দুস্থ মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ, বাদ আসর মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে দোয়া মাহফিল হবে। কাল বিকাল ৪টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এ ছাড়া সিপিবি, গণফোরাম, জাসদ, ন্যাপ ও গণতন্ত্রী পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে।
——————০——————–
বাবা-মায়ের স্মৃতি বলতে শুধুই রক্তাক্ত লাশ
ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস
শোকাবহ ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ফজলুল হক মনির ছেলে তাপস বলেন, অন্যদের বাবা-মায়ের কত স্মৃতি।
আমারও তো ইচ্ছে করে অন্যদের মতো বাবা-মায়ের স্মৃতিচারণ করতে। আবেগতাড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, অনেক ভেবেছি, অনেক চিন্তা করেছি, অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোনো স্মৃতিই পাইনি। শুধু আবছা আবছা একটি স্মৃতি। তিনি বলেন, আমার বাবা-মার স্মৃতি বলতে শুধু মেঝেতে পড়ে থাকা নিথর রক্তাক্ত দুটি লাশ। এ ছাড়া আমি আর কিছুই মনে করতে পারি না! মঙ্গলবার বিকালে ধানমণ্ডির নিজ কার্যালয়ে যুগান্তরকে এমন আবেগজড়িত কণ্ঠে সেদিনের স্মৃতিচারণ করেন ফজলে নূর তাপস।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের গুলিতে প্রাণ হারান তাপসের বাবা শেখ ফজলুল হক মনি এবং মা আরজু মনি। বাবা-মাকে হারিয়ে তাপস ও তার ভাই শেখ ফজলে শামস পরশ এতিম হয়ে পড়েন।
এ সময় তাপসের বয়স ছিল চার বছর এবং পরশের ছয় বছর। বঙ্গবন্ধুর বোন শেখ আছিয়া বেগমের বড় ছেলে মনি ছিলেন আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা। স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্যতম প্রধান গেরিলা বাহিনী ‘মুজিব বাহিনী’ তার নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত ও পরিচালিত হয়েছে।
ব্যারিস্টার তাপস বলেন, আমি তখন অবুঝ ছিলাম। কিন্তু এখন বুঝ হলেও মনকে বুঝ দিতে পারি না। কোনো সন্তান যখন ঘরে ফিরে যায় তখন কেন তার মাকে পাবে না! কেন তার মাকে আলিঙ্গন করতে পারবে না।
কেন তার মাকে সেবা করতে পারবে না! স্মৃতির মণিকোঠায় ভেসে ওঠা দৃশ্যপট বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর নাতি তাপস বলেন, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে শুধুই বাবার লাশ, সাদা গেঞ্জি পরা। সিঁড়ির চৌকিতে পড়ে আছে, গলায় গুলির রক্তাক্ত দাগ। এখনও গুলির দাগটি ভেসে ওঠে। আরেকটি দৃশ্য স্মৃতিতে আটকে আছে- বাবা-মার লাশ নিয়ে যাওয়ার পর সিঁড়িতে পড়ে থাকা জমাট বাঁধা রক্ত। এর বেশি কিছু মনে নেই। মনে নেই বাবা-মার আদর-আলিঙ্গন, হাসি-কান্না।
তাপস বলেন, আগস্ট মাসের প্রথম দিন থেকেই আমাদের বুকের ব্যথা অনেক বেড়ে যায়। আমাদের মনটা কালো ছায়ায় ঢেকে থাকে। বিচার হয়েছে বলে তবুও এখন একটু সান্ত্বনা পাই। আমি নিজেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরেছি। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন এই বিচার না দেখে বুকভরা কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন। এখনও অনেক খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে।
বিদেশে পালিয়ে থাকা এসব আসামিকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানান তিনি। জীবনের দুর্বিষহ স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তাপস বলেন, আত্মীয়দের বাসায় কিছু দিন লুকিয়ে থাকতে হয়েছে আমাদের। প্রায় দুই বছর এভাবে লুকিয়ে চলার পর ১৯৭৮ সালে আমরা ভারতে চলে যাই। দাদি আমাদের সেখানে নিয়ে যান। চাচারা সবাই আগেই ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
কিছু দিন ভারতে থাকার পর আবার আমরা দেশে ফিরে আসি। তিনি বলেন, আমরা যখন বাসা ভাড়া নিতে যেতাম, আমাদের কেউ বাসা ভাড়া দিত না। আমরা বাসা ভাড়া পেতাম না। আত্মীয়দের বাসায় থাকতাম। অনেক দিন পর লালমাটিয়ার একটি বাসায় উঠি। আমাদের পড়ালেখা করতেও বাধা দেয়া হতো। ভর্তি হতে দেয়া হতো না। আমাদের স্কুলেও বেশি দিন থাকতে দেয়া হতো না। স্কুল কর্তৃপক্ষ শঙ্কার মধ্যে থাকত। অনেক কষ্টে পড়ালেখা করতে হয়েছে আমাদের।
দাদা-দাদি, দুই চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, সর্বোপরি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অবদানের কথা স্মরণ করেন তাপস। তিনি বলেন, তাদের ভালোবাসা, আদর ও স্নেহে আজ এ অবস্থানে আসতে পেরেছি। তিনি বলেন, আমাদের এতিম দুই ভাইয়ের একমাত্র ছায়া ছিলেন আমার দাদি বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগম। তাপস বলেন, আমাদের বোঝানোর জন্য দাদি বলতেন, বাবা-মা বিদেশে আছে। তোমরা কেঁদো না, এই তো চলে আসবে। কিছু দিন পরই চলে আসবে।
ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস বলেন, আমরা যখন বুঝতে শিখলাম যে বাবা-মাকে আর পাব না, তাদের অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেই সময় আরেকটি উপলব্ধি এলো, ওই অন্যায়ের কোনো বিচার আমরা পাব না।
বিষয়টি দীর্ঘদিন আমাদের তাড়িত করেছে। বিচারহীনতার কষ্ট অন্য রকম। আমার মৌলিক অধিকার কিন্তু সেটি আমাকে দেয়া হবে না! ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর যখন বিচার কার্যক্রম শুরু হল, নতুন এক শঙ্কায় পেয়ে বসল। বিচার সম্পন্ন করতে পারব তো! দীর্ঘ ৩৪ বছর পর সেই বিচারের কার্যক্রম শেষ হয়েছে।
ফাঁসির আদেশও কার্যকর হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আইনজীবী হওয়ায় দু’বার হামলার শিকার হয়েছেন জানিয়ে তাপস বলেন, পুরানা পল্টনের বাংলার বাণী অফিসে তার ওপর সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগেই ওই হামলার পরিকল্পনা করা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই।
এরপর হাজারীবাগের পার্কের মধ্যে দ্বিতীয় হামলার শিকার হই। তিনি বলেন, এসব হামলার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে তাদেরই প্রচেষ্টা ছিল এটা। তাদের প্রচেষ্টা এখনও আছে, ষড়যন্ত্র এখনও চলছে।
১৫ আগস্ট তেমন কোনো কর্মসূচি পালন করেন না ফজলে নূর তাপস। সকালে ওঠে নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করেন। এরপর দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ধানমণ্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, বনানী কবরস্থানে নিহত আত্মীয়স্বজনের কবরে দোয়া ও মোনাজাত করেন। ফুফু শেখ হাসিনার সঙ্গে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাসায় ফিরে তিনি একাকী থেকে নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া মোনাজাত করেন।