ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট:সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে পশ্চিম ধানমন্ডির হাজী আফসার উদ্দিন রোডের নিজ বাসা থেকে ওই নারীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-২।
গ্রেপ্তার হওয়া ওই নারীর নাম ফারিয়া মাহজাবিন (২৮)।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব-২) জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) রবিউল ইসলাম বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-২-এর একটি দল গতকাল রাত পৌনে ১১টার দিকে অভিযান চালিয়ে ধানমন্ডির ওই বাসা থেকে ফারিয়া মাহজাবিনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন সেট, এক পাতা করে ফেসবুক আইডি প্রোফাইলের প্রিন্ট কপি এবং অডিও ক্লিপের প্রিন্ট কপি জব্দ করা হয়।
ফারিয়ার দেওয়া তথ্যের বরাতে রবিউল জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন যে ছাত্র আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত ও দীর্ঘায়িত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর উদ্দেশ্যে ফেসবুক আইডি মেসেঞ্জার থেকে বিভিন্ন রকম স্ট্যাটাস ও উসকানিমূলক মিথ্যা তথ্যসংবলিত অডিও ক্লিপ রেকর্ড করে পোস্ট করতেন।
র্যাব জানায়, এসব তিনি ব্যক্তিগত মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে করতেন। বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার পর ‘নিরাপদ চড়ক চাই’ আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। ফারিয়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংহতি প্রকাশ করে ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা, বানোয়াট ছবি, গুজব সংবাদ, বানোয়াট ভিডিও ভাইরাল, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য বিভ্রান্তমূলক স্ট্যাটাস দিতেন। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ছাত্রদের সব দাবি মেনে নিলেও অন্য সহযোগীদের নিয়ে অন্যায়ভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি পরিচালনা এবং রাস্তায় সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করার উদ্দেশ্যে অপতৎপরতা করে আসছেন ফারিয়া। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যাচাই-বাছাই করে ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানায় র্যাব।
———–0——————–
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
রাস্তা থেকে ধরেই মামলার আসামি!
- ২৯ জুলাই কুর্মিটোলায় বাসচাপায় নিহত হয় দুই শিক্ষার্থী
- নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা।
- আন্দোলনের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটে
- ধানমন্ডিতে ৪ আগস্ট হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে
- ধানমন্ডির ঘটনায় কয়েক শ ব্যক্তিকে আসামি করে তিন মামলা
- আন্দোলনের ঘটনায় ৫১ মামলায় ৯৭ জন গ্রেপ্তার
নারী উদ্যোক্তা বর্ণালী চৌধুরী লোপা ৫ আগস্ট দুপুরে নিউমার্কেট থেকে শিশুর পোশাক কিনে ধানমন্ডির দিকে যাচ্ছিলেন। পথে মেডিনোভার কাছ থেকে তাঁকে আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়। এরপর তাঁকে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়সহ ধানমন্ডিতে হামলা-ভাঙচুরের তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। এই ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছিল ৪ আগস্ট। বর্ণালীর মা আম্বিয়া খাতুন ও বোন কানিজ ফাতেমা গতকাল এসব অভিযোগ করেন।
বর্ণালীর বয়স ৩৫। ৪ আগস্টের ভাঙচুরের ঘটনায় এই ব্যবসায়ী নারী কী করে আসামি হলেন? এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, বর্ণালীর মুঠোফোন পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তিনি আন্দোলনকারীদের মাঝে খাবার বিতরণ করেছিলেন। এর মানে তিনি এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। তবে তাঁকে অন্যরা ধরে পুলিশের হাতে দিয়েছে।
বর্ণালীর আইনজীবী এইচ এম মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, সন্দেহের বশে তিনটি মামলাতে বর্ণালীকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। ছয় দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর হয়েছে। তিনি নিরীহ ব্যবসায়ী। হামলা-ভাঙচুর সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।
ধানমন্ডির এই হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাত কয়েক শ ব্যক্তিকে আসামি করে তিনটি মামলা করে। এসব মামলায় ৫ আগস্ট বর্ণালীসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের ১২ জনই বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কারও বিরুদ্ধেই পুলিশের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। বর্ণালী ছাড়া অন্য ১৩ আসামিকে গতকাল থেকে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের স্বজনদের দাবি, মিরপুর সড়ক ও ধানমন্ডি এলাকায় রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের ধরিয়ে দিয়েছেন লাঠিসোঁটা হাতে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। ওই এলাকা থেকে আরও বেশ কয়েকজনকে ধরে আনা হয়েছিল। ওই রাতেই তাঁদের ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। ছাড়া পাওয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের অভিযোগ, টাকা দিয়ে তিনি ছেলেকে ছাড়িয়ে এনেছেন।
তবে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ বলেন, ‘এটা হতে পারে না। নির্দেশ ছিল, কোনো স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীকে আটক রাখা যাবে না। তা ছাড়া সবাইকে তো আমরা ধরিও নাই, লোকজন ধরে দিয়েছে।’
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় বাসচাপায় নিহত হয় দুই কলেজশিক্ষার্থী। এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ওই আন্দোলনের মধ্যে সহিংস ঘটনা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানির অভিযোগে দায়ের হওয়া ৫১টি মামলায় এখন পর্যন্ত ৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ ও আদালত সূত্র বলছে, ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ের ঘটনায় দলটির পক্ষ থেকে করা দুটি মামলায় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের ৯ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে কয়েক শ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে আলোচিত হওয়া মিলহানুর রহমান নাওমিও এই মামলার আসামি।
রাস্তা থেকে ধরে যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁদের কারও রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে পুলিশ এখনো কোনো নিশ্চিত তথ্য দেয়নি। এই ১৪ আসামির একজন তমাল সামাদ পড়েন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে। তাঁর বাবা আবদুস সামাদ বলেন, ‘তমালের ব্রঙ্কাইটিস হয়েছে। ঘটনার দিন সে জ্বরে পড়ে বাসাতেই ছিল। বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই বোঝা যাবে। পরদিন বন্ধুদের সঙ্গে বের হলে ছাত্রলীগের ছেলেরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। এখন কারাগারে গিয়ে তার ব্রঙ্কাইটিস মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।’
ওই দিন একসঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছেন দুই ভাই মাহমুদুর রহমান ও মাহবুবুর নাঈম। তাঁদের বাবা আবদুজ জাহের প্রবাসী। ছেলেদের পড়াতে চার বছর ধরে ঢাকায় বাড়ি ভাড়া করে থাকছেন মা। গতকাল ভাড়া বাসায় গেলে তাঁদের মা বলেন, ‘ছেলেদের তো ধইরা মামলাতেও দিছে। রিমান্ডের অর্ডারও দিছে আদালত। এখন পত্রিকায় এসব নিয়া ল্যাখলে কী হবে!’
আর বারডেমে রোগী দেখে রিকশায় ফেরার পথে ল্যাবএইডের সামনে থেকে একসঙ্গে তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা তিনজন মোহাম্মদপুরের একটি মেসে থেকে ধানমন্ডির ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তাঁদের একজন মাসরিকুল আলমের বাবা শামসুল ইসলাম বলেন, তাঁর ছেলে ও বোনের ছেলে ওমর সিয়াম একই মেসে থাকেন। অসুস্থ আত্মীয়কে দেখে বারডেমে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে মিরপুর সড়কে তাঁদের আটকায় পুলিশ।
গ্রেপ্তার আরেক ছাত্র গাজী ইমাম বুখারি সিফাত পড়েন আশা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকেন শ্যামলীতে। ৫ আগস্ট অন্য চারজনের সঙ্গে নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। পুলিশ কলাবাগান এলাকায় তাঁদের আটক করে। তাঁর সঙ্গে থাকা চারজন স্কুল-কলেজপড়ুয়া হওয়ায় পুলিশ তাদের ছেড়ে দিয়ে সিফাতকে গ্রেপ্তার করে।
সিফাতের বাবা গাজী আক্কাস আলী বলেন, ‘আমার কিচ্ছু বলার নাই। ঈদের আগে সবাই আনন্দ করতাছে। আমার ছেলেটা জেলে। আমরা বিনীতভাবে বলতে চাই, আমার ছেলেটা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না। আন্দোলনেও যায়নি। দয়া করে দয়ার দৃষ্টিতে তাদের বিষয়টি দেখুন।’
তিন মামলার মধ্যে একটির তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার এসআই জায়েদ আবদুল্লাহ বিন সরওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নিজে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করেননি। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা তখন অনেককে ধরে দিয়েছেন। যাচাই করে যাঁরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। প্রথম আলো।