শোকেও সংঘাতে এমপি-নেতারা:শোক দিবসে আওয়ামী লীগের ৩০ সাংগঠনিক জেলায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি

এমপি-তৃণমূল আ’লীগ দ্বন্দ্ব

শোকেও সংঘাতে এমপি-নেতারা

১৫ আগস্টও তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি * কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা * দু-একদিনের মধ্যেই জড়িতদের ঢাকায় তলব করা হবে

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট:  ১৫ আগস্টের শোক দিবসে আওয়ামী লীগের ৩০ সাংগঠনিক জেলায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি কেন্দ্র করে এমপির সমর্থক এবং তৃণমূল নেতাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন অনেক নেতাকর্মী।

তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে দলের ভাবমূর্তির। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের আগে শাসক দলের এমপি এবং তৃণমূল নেতাদের দ্বন্দ্ব ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

শোক দিবসের মিলাদ, দোয়া ও কাঙালিভোজের অনুষ্ঠানে এমপির সমর্থক ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দলের হাইকমান্ড। তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, নৃশংসভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিনেও তারা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

এদিনটিও তাদের অশ্র“সিক্ত করতে পারেনি। পারেনি শোকাবহ ১৫ আগস্ট তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে।

জানা গেছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনকি জেলা আছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩০টি সাংগঠনিক জেলায় ১৫ আগস্ট শোক দিবসের অনুষ্ঠানে নিজেরা নিজেরাই মারামারি করেছেন। দীর্ঘদিনের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ সংঘর্ষ হয়। কোথাও কোথাও একই স্থানে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক  বলেন, শোক দিবসের অনুষ্ঠানে যারা মারামারির মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে দু-একদিনের মধ্যেই তাদের ঢাকায় তলব করা হবে। তাদের জবাবদিহি করতে হবে।

জবাব সন্তোষজনক না হলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, আজই (শনিবার) আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পৃথক একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওইদিনের ঘটনায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দলের হাইকমান্ড।

এ নিয়ে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের শৈথিল্য ও তৃণমূলের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে শোকাবহ দিনে এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, সামনে নির্বাচন।

দলের ভেতর কিছু স্বার্থান্বেষী মহল দলীয় মনোনয়ন পেতে ও নিজেকে জানান দিতে এসব অপকর্ম করছে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই অশুভ প্রতিযোগিতা থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বের হয়ে আসা উচিত।

রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক এইচ এন আশিকুর রহমান। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে তৃণমূল আওয়ামী লীগের একটি অংশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব। মিঠাপুকুর উপজেলার শাপলা চত্বরে ১৫ আগস্টের কর্মসূচির আয়োজন করেন এমপি। সবাইকে ডাকা হলেও অভিমানে তৃণমূলের নেতাকর্মী অনেকেই অনুপস্থিত ছিলেন।

১৬ আগস্ট একই স্থানে মিঠাপুকুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এমপি আশিকুর রহমান একইদিন একই স্থানে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে মাইকিং করে পাল্টা কর্মসূচি দেন। পরে দুটি অনুষ্ঠানই স্থগিত করে উপজেলা প্রশাসন।

এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, তৃণমূল আওয়ামী লীগের কর্মসূচি নস্যাৎ করার জন্য এমপি আশিকুর রহমান ১৫ আগস্ট কর্মসূচি পালন করে ১৬ আগস্ট ফের কর্মসূচি দেন।

আমরা উপজেলা আওয়ামী লীগসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মী এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন করি। ৪০ হাজার নেতাকর্মীর বিশাল শোক র‌্যালি দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি এখানে অপরাজনীতির দিন শেষ।

সেখানে কোনো পাল্টা কর্মসূচি নয়, এমন দাবি করে এমপি আশিকুর রহমান  বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, মহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ শোক দিবসের কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। দুটি কর্মসূচি এক জায়গায় হওয়ায় প্রশাসন তা বাতিল করে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (জাকির) নিজেকে জানান দিতে টাকা খরচ করে কর্মসূচি পালন করেছে। তার সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সগঠনের কেউ নেই বলে দাবি করেন এমপি।

শোক দিবসের আলোচনা সভাকে কেন্দ্র করে নেত্রকোনায়-৫ আসনের এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে সাংবাদিক-পুলিশসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়। শোকের মাসে এমন সংঘর্ষে এলাকায় এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইছে।

জানা যায়, ১৫ আগস্ট নেত্রকোনার পূর্বধলায় পাশাপাশি সমাবেশ ডাকে এমপি ওয়ারেসাত ও আহমদ হোসেনের সমর্থকরা। দীর্ঘদিন থেকে স্থানীয় আধিপত্য নিয়ে এ দুই নেতার দ্বন্দ্ব থাকায় সমাবেশ ঘিরে আগে থেকেই পুলিশ মোতায়েন ছিল।

তা সত্ত্বেও সেদিন ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং মঞ্চসহ বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাংচুর হয়। সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।

দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই বিরোধ নিরসনে এমপির কোনো উদ্যোগ নেই। সবাই বলেন, কেন্দ্রীয় নেতা যেখানে বিরোধে জড়িত সেখানে কার কোন্দল কে থামায়? তারা বলেন, এখানে দলের যে কোনো কর্মসূচি গ্রুপ দুটি সব সময় আলাদাভাবে পালন করে। বিষয়টিতে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ।

তবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তাদের পাওয়া যায়নি।

১৫ আগস্টের অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থবিষয়ক সম্পাদক এমপি ইউছুফ আবদুল্লাহ হারুন এবং কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সরকার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে ইকবাল নামে একজন ছুরিকাঘাতে আহত হন। পরে এ সংঘর্ষ দীর্ঘ সময় চলতে থাকে।

তবে শোকের অনুষ্ঠানের কোনো সংঘর্ষ হয়নি দাবি করে এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন  বলেন, এটা বানানো কাহিনী। কর্মসূচি অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এ বিষয়ে কুমিল্লা উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

শোকাবহ আগস্টের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে জেলা নেতাকর্মীদের না ডেকে এককভাবে কর্মসূচি পালন করে ঢাকায় ফিরেছেন জয়পুরহাট-২ আসনের এমপি আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন।

এমন অভিযোগ করে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুল হক দুদু বলেন, কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করলেও তিনি (স্বপন) এখানে হটকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছেন। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তও অমান্য করছেন তিনি। কয়েকদিন আগে জয়পুরহাট পৌর ও থানা যুবলীগের শোক দিবসের আলোচনায় এসে এককভাবে কর্মসূচি পালন করে চলে গেছেন। সেখানে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এটা তার হটকারিতা। দলের মধ্যে এসব করে ওনার (স্বপন) লাভ কি?

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অধিকাংশ উপজেলায় এখন আহ্বায়ক কমিটি। এখানে এমপিরা আলাদাভাবে দল গঠন করেছেন। তাদের নিজ বলয় মূল আওয়ামী লীগকে পাত্তা দিচ্ছে না।

আধিপত্য নিয়ে তাদের মধ্যে বেশি দ্বন্দ্ব চলছে। ফলে দলীয় কোনো কর্মসূচি এলেই তারা পৃথকভাবে পালন করে। শোকেও তারা একত্রিত হতে পারল না। এটা আওয়ামী লীগের জন্য খারাপ ইঙ্গিত।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ  বলেন, অতি উৎসাহীরা এ ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে থাকেন। রাজনীতিতে এটা কাম্য নয়। তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন।

নিজেদের জানান দিতে গিয়ে তারা শোকের মাসেও এমন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড করছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশা করে যারা এ ধরনের কাজ করছেন তাদের এখনই সংশোধন হওয়া উচিত। দলের হাইকমান্ড দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করতে পারে।   যুগান্তর

Check Also

তাবলীগ জামায়াতের সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ-সমাবেশ

মুহাম্মদ হাফিজ, সাতক্ষীরা : তাবলীগ জামাতে সাদপন্থীদের বর্বোরিচত হামলার প্রতিবাদ ও সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগের সহসভাপতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।