ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: এ মুহূর্তে অনেকের আলোচনায় স্থান পাচ্ছে ২০০৭ সালের ঘটনাবহুল সেই ‘ওয়ান-ইলেভেন (১-১১)’। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা ফের এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা ব্যক্ত করে সম্প্রতি বক্তব্য দিয়েছেন। তবে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ নিয়ে কথা বলার পরপরই দলমত নির্বিশেষে সবাই জানতে আগ্রহী কেন সরকারসংশ্লিষ্টদের মুখে এমন বক্তব্য। কিসের ভিত্তিতে এমন শঙ্কা।
কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, ক্ষমতাসীনদের এ ধরনের বক্তব্য ফেলে দেয়ার সুযোগ নেই। কেননা ১/১১-এর পরবর্তী টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। কোনো আশঙ্কা থেকে হোক, আর কৌশলের অংশ হিসেবে হোক, ওবায়দুল কাদের এবং ক্ষমতাসীন দলের অন্য নেতার আশঙ্কা অমূলক নয়।
আবার বিশ্লেষকদের কারও কারও অভিমত, দেশে রাজনীতির মাঠ অস্থির সময় পার করছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে সরকারবিরোধীদের বিচ্ছিন্ন বৈঠকের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহও খুব স্বাভাবিক নয়। তারপরও তথ্য-প্রমাণ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে এমন অভিযোগ রাজনৈতিক কৌশলও হতে পারে। তারা মাঠ গরম রাখতে এ ধরনের অভিযোগ তুলতে পারেন।
বৃহস্পতিবার জাতীয় শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশে আবার ‘ওয়ান-ইলেভেন’র ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এরপর শুক্রবার এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টির চক্রান্ত করছে বিএনপি। গোপন বৈঠক চলছে, দেশে-বিদেশে, ব্যাংককে বসে বৈঠক চলছে। গত ৭ দিনে কারা ঘন ঘন যাতায়াত করছেন, সেই খবর আমরা জানি। ব্যাংকককে এখন ঘাঁটি করেছে। কারা কারা আসছেন, কারা যাচ্ছেন, কি কি কথা হচ্ছে, মনে করেছেন আমরা জানি না। এর আগেও তার দলের অন্য নেতারা এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটি অন্য নেতারাও সমানতালে এসব বক্তব্যের জবাব দিচ্ছেন। সর্বশেষ রোববার মির্জা ফখরুল এ নিয়ে বলেন, বিএনপির ১/১১ করার প্রয়োজনটা কী? এর সঙ্গে বিএনপির তো কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। ড্রাইভিং সিটে আছে আওয়ামী লীগ। আর ১/১১ করার অভিজ্ঞতা তাদের।
কলাম লেখক ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, মতপার্থক্য দূর না হলে এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা অমূলক নয়। স্বাভাবিক অবস্থায়ও জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার ও বিরোধী দলগুলো মেঠো বক্তৃতায় নানা কথা বলে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। তখনকার সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যর্থতা এবং আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতানৈক্যের পরিণতি ছিল ১/১১। ইতিহাসে দেখা যায়, একই রকমের ঘটনা দু’বার ঘটে না। নেতাদের কথাবার্তায় জনগণ শঙ্কিত। দেশের স্বার্থে-গণতন্ত্রের স্বার্থে পরস্পরকে সন্দেহ ও দোষারোপ না করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধাগুলোকে দূর করা জরুরি। সময় কম।
অবশ্য লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ এমন বক্তব্যকে রাজনৈতিক রেটোরিক (অলঙ্কার) মনে করছেন। তিনি ওবায়দুল কাদেরের এমন অভিযোগের বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশে এ ধরনের অভিযোগ অহরহই চলে। সবাই বলে ষড়যন্ত্র চলছে। হয়তো ষড়যন্ত্র চলেও আবার চলে না। কিন্তু যাই বলা হোক সেটার ভিত্তি থাকা উচিত। এ ধরনের অভিযোগকে আগে থেকেই বাজার গরম করার কৌশল মনে করছেন তিনি।
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী এ ধরনের আলোচনা ও আশঙ্কাকে দেখছেন, দেশ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাওয়ার ফসল হিসেবে। তিনি বলেন, যেটা রাষ্ট্রের সমস্যা, সেটা সরকারের সমস্যা নয়। এদেশে এখনও ক্ষমতা বদলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। রাষ্ট্র মৌলিকভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক রয়ে গেছে। যখনই কোনো সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে আসে তখনই দেশে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে উত্তেজনাও চোখে পড়ে। সরকার ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করেছে। দেশের প্রবৃদ্ধিও অনেক ভালো। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তারপরও ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন না হলে এ ধরনের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলতেই থাকবে বলে তিনি মনে করেন।
সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার অবশ্য ১/১১ ফেরানোর চক্রান্তের অভিযোগকেই ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে চান। তিনি বলেন, কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ হাজির না করে ষড়যন্ত্রের কথা বলা হলে, সেটাই এক ধরনের ষড়যন্ত্র। কারও বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা বলে অতি সহজেই অপপ্রচার করা যায়। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের এমন অভিযোগের সপক্ষে বদিউল আলম মজুমদার সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সেটি তখন জনগণই বিচার করবে।
রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, যা বহাল ছিল পরবর্তী ২ বছর। ২০০৬ সালের শেষ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ইস্যুতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। প্রথম দফায় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়।
এরপর ২০০৭-এর ১১ জানুয়ারী রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করার পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বাতিল করা হয় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন। সেনা সমর্থনে গঠিত হয় নতুন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’, যার প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদ। ১১ জানুয়ারি ক্ষমতার পালাবদলের পর জরুরি ক্ষমতার আওতায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হয়েছিল। আলোচিত-সমালোচিত সেই ঘটনাপ্রবাহের শুরুর দিনটি পরিচিতি পায় ওয়ান-ইলেভেন বা ১/১১ নামে।যুগান্তর
————০——————
আরেকটি ওয়ান ইলেভেন কি আসন্ন?
হঠাৎ করেই রাজনীতিতে ওয়ান-ইলেভেনের প্রসঙ্গ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেছেন, ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবরা আবার সোচ্চার। আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি দেশে নতুন করে ওয়ান-ইলেভেন ঘটানোর চক্রান্ত করছে। অন্যদিকে একই দিনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগের কারণেই দেশে ওয়ান ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য অবিলম্বে আওয়ামী লীগের পদত্যাগ করা উচিত।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মুখে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। সে সময় দেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল। সর্বশেষ অবসর প্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার সাংবিধানিক বিধান ছিল। বিচারপতি কে. এম. হাসান যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে পারে সেজন্য বিএনপি প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়সসীমা বাড়িয়ে সংবিধান সংশোধন করে। আওয়ামী লীগ স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, বিচারপতি কে. এম হাসানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তারা মেনে নেবে না। আওয়ামী লীগ তীব্র আন্দোলন শুরু করে। তীব্র আন্দোলনের মুখে কে. এম. হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হবেন না বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নির্বাচনের পরবর্তী ধাপ অনুসরণ না করে, রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগ তাঁকে পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু একের পর এক পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তের ফলে ইয়াজউদ্দিন বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। এসময় এরশাদকে একটি মামলায় দণ্ডিত করে হাইকোর্ট তাঁকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করে। এরপর সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় । অন্যদিকে, বিএনপির অনুগত ড. ইয়াজউদ্দিন যেকোনো মূল্যে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানে অটল থাকেন। অস্থির, নৈরাজ্যকর এবং ভয়াল একটি রাজনৈতিক পরিবেশে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং দেশের সুশীল সমাজের একাংশ মিলে একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব তৈরি করে। আর সেনাবাহিনী তাতে সমর্থন দেয়। আপাত দৃষ্টিতে ওয়ান ইলেভেনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাস, নৈরাজ্য এবং দু:সহ জনজীবন থেকে দেশের মানুষকে মুক্তি দেওয়া। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দেশকে প্রস্তুত করা। কিন্তু ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ঐ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেই রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। নির্বাচনের বদলে অনির্বাচিত সরকারটি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পাঁয়তারা শুরু করে। এসময় তাঁরা দুই নেত্রীকে মাইনাস করার রাজনৈতিক কৌশলও গ্রহণ করে। সুশীল সমাজ নিয়ন্ত্রিত একটি অনির্বাচিত সরকার দিয়ে দেশ পরিচালনার এই মনোভাব জনগণ প্রত্যাখ্যান করে। দুই নেত্রীকে জেলে নিয়েও শেষ পর্যন্ত ঐ অনির্বাচিত সরকার দুবছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে কি আরেকটি ওয়ান ইলেভেন আসার আশঙ্কা রয়েছে? একথা অনস্বীকার্য যে, ওয়ান ইলেভেন আনতে যে দূতাবাসগুলো সক্রিয় ছিল তাঁদের মধ্যে একমাত্র ভারত ছাড়া বাকি সবাই সক্রিয়। দূতাবাসগুলো একের পর এক বৈঠক করছে সুশীল সমাজের সঙ্গে। শুধু দূতাবাসগুলোই নয়, সুশীল সমাজের যে অংশটি ওয়ান ইলেভেন আনতে সক্রিয় ছিল, তারা আবারও তৎপর। কিন্তু ২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পেছনে আরও দুটি উপাদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি হলো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং সহিংসতা। অন্যটি সেনাবাহিনীর ভূমিকা। দেশে এখন কোনো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা নেই। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে মানুষ সন্ত্রাস এবং সহিংসতার রাজনীতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। জ্বালাও পোড়াও করার শক্তি ও সাহস দেশের বিরোধী দলের নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও এখন ২০০৭ সালের সেনাবাহিনী নয়। সেনাবাহিনী এখন অনেক পেশাদার, দক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন।
আর সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আর ওয়ান ইলেভেন আসার সুযোগ নেই। সংবিধানের ৭ (ক) অনুচ্ছেদে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণকে রাষ্ট্রোদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই ওয়ান ইলেভেন এখন কেবল এক শ্লোগান আর রাজনৈতিক স্টান। বাস্তবে বাংলাদেশে আবার ওয়ান ইলেভেন আসার সুযোগ খুবই কম।
বাংলা ইনসাইডার