রয়র্টাসঃক্রাইমবার্তা ডেস্করির্পোটঃ
তারল্য সংকট ও রফতানি বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব কমে যাওয়ায় কোরবানির চামড়া বাণিজ্যে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরে উদ্যোক্তাদের অর্থের বড় একটি অংশ আটকে যাওয়া, অনিয়মের কারণে চামড়া কেনার ঋণ কমিয়ে দেয়া এবং পরিবেশসহ সার্বিক কমপ্লায়েন্স না থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আর এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
ফড়িয়া, পাইকার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- ঈদের দিন ও পরের দু’দিন পানির দরে চামড়া কেনাবেচা হয়। সরকার ও ট্যানারি মালিকদের যৌথভাবে নির্ধারিত দামেও চামড়া বেচা-কেনা হয়নি। বেচা-কেনা হয়েছে তার চেয়েও কম দামে। গত বছর মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকায় বিক্রি হয়। এ বছর তা ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকায় নেমে এসেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, এ বছর ৯শ’ থেকে ১১শ’ টাকার মধ্যে গরুর চামড়া বেচাকেনা হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত মূল্য গত বছরের তুলনায় একটু কম। তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের হাতে টাকা নেই। অর্থ সংকটে আছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবু তাহের জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য কমেছে। বিদেশি ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া ট্যানারি মালিকরা অর্থ সংকটে পড়েছেন। এ দু’কারণে চামড়া বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
পোস্তার আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির নেতা দেলোয়ার হোসেন যুগান্তরকে জানান, ট্যানারি মালিকরা সরাসরি চামড়া কেনায় তারা চামড়া কম কিনেছেন। তবে ট্যানারি মালিকদের নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করবেন না। কারণ এতে তাদের লবণ, শ্রমিক ও পরিবহন ব্যয় জড়িত আছে। তিনি বলেন, পোস্তার ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করেছেন। আগামী সপ্তাহে ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে মূল্য নিয়ে আলোচনার পর বিক্রি করা হবে।
জানা গেছে, এ বছর কোরবানির চামড়া কেনার জন্য ব্যাংকগুলো প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা ঋণ কম দিয়েছে। চলতি বছর ব্যাংকগুলো চামড়া কিনতে ৬শ’ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে। গত বছর দেয়া হয়েছিল ৭৩৫ কোটি টাকা। মূলত চামড়া শিল্পে খেলাপি ও দুর্নীতির কারণে ঋণের পরিমাণ কমানো হয়েছে। কয়েকজন ট্যানারি মালিক জানান, এ বছর অনেকের কেমিক্যাল কেনার টাকা নেই। কারণ অনেক উদ্যোক্তা নতুন ট্যানারি শিল্প সাভারে টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এতে অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, এ বছর চামড়া রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনে ধাক্কা খেয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে চামড়া খাতের রফতানি আয় কমেছে ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩০ কোটি ডলার। সেখানে রফতানি হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার। ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর, পরিবেশগত সমস্যা ও কমপ্লায়েন্স না থাকায় বিদেশি অনেক ক্রেতা অন্যত্র চলে গেছেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনের বাণিজ্যও কিছুটা কমেছে। চীন চামড়া আমদানির অন্যতম দেশ। এখন সেখানে পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে চামড়া রফতানি নিয়ে এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন বাংলাদেশের এ শিল্প মালিকরা। যে কারণে তারা রফতানির কাঁচামাল কিনছেন পানির দরে।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এবারের ঈদে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে। আর দেশে মোট চামড়ার প্রায় ৬০ শতাংশই আহরণ করা হয় ঈদুল আজহা বা কোরবানির সময়।
চামড়া সংগ্রহ করতে ঈদের আগেই বেঁধে দেয়া হয় মূল্য। এ বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৪৫-৫০ টাকা, ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অপরদিকে প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ১৩-১৫ টাকা।
তবে বেঁধে দেয়া দামে ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখাননি। ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, চামড়া কেনার আগে ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা প্রতিফুট ৪০ টাকা মূল্য দিয়েছেন। সে হিসাবে চামড়া কিনে তাদের কাছে বিক্রি করতে গেলে উল্টো কথা বলছে। তিনি বলেন, দূর-দূরান্ত থেকে চামড়া নিয়ে ট্যানারিতে আসছেন অনেকে। কিন্তু মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে মৌসুমি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। এখন তারা চামড়া ফেরতও নিয়ে যেতে পারছে না আবার কম দামে বিক্রিও করতে চাইছেন না। তাই এসব ব্যবসায়ীকে চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিকদের কাছে ধরনা দিতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ী আসাদুল মিয়া জানান, আমি সারা বছর ট্যানারিতে চামড়া সরবরাহ করেছি। কিন্তু ঈদের সময় ট্যানারি মালিকরা আমাকে চিনতেই পারছেন না। সিন্ডিকেট করে বেঁধে দেয়া দামের অর্ধেক দামে চামড়া কিনতে চাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈদের দিন থেকে চামড়া কেনার প্রতি ফড়িয়া ও পাইকারদের আগ্রহ কম ছিল। এলাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীর সংখ্যাও কম ছিল। চামড়ার পাইকারি বাজার পুরান ঢাকার পোস্তায় অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী বেচা-বিক্রি করতে এসে চোখের পানি ফেলেছেন।
সিলেটের তানবির আহমেদ এক ট্রাক চামড়া নিয়ে ঢাকার পোস্তার পাইকারি বাজারে আসেন। গ্রাম গ্রাম ঘুরে ঘুরে প্রতি পিস ৬শ’ টাকা দরে কয়েক বন্ধু মিলে চামড়া কিনেছেন। বাড়তি আয়ের আশায় চামড়াগুলো নিয়ে তারা ঢাকায় আসেন। কিন্তু পোস্তার পাইকাররা তাদের কেনা দামও বলছেন না। তানবির জানান- না পারছি বিক্রি করতে, না পারছি ফেরত নিতে।
বগুড়া থেকে চামড়া নিয়ে পোস্তায় আসেন সৈয়দ আবুল কাশেম। তিনি জানান, ৬০০ টাকা করে চামড়া কিনেছিলেন। এখন ২শ’ করে বিক্রি করতে পারছেন না। চামড়া কিনে তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন।
মৌসুমি ব্যবসায়ী রফিক মিয়া জানান, তিনি ৩শ’ পিস চামড়া কিনে বিপদে পড়েছেন। সংরক্ষণ করে কিছুদিন পর সঠিক মূল্য পাওয়া যাবে এ আশায় তিনি চামড়ায় লবণ দিচ্ছেন। প্রতিটি চামড়ার পেছনে লবণ ও শ্রমিক ব্যয় বাড়তি আরও ৩০০ টাকা যাবে। শেষ পর্যন্ত তাও উঠবে কিনা সে আশা করতে পারছেন না তিনি।
জানতে চাইলে রায়সাহেব বাজারের চামড়ার আড়তদার সৈয়দ ইকবাল বলেন, এ বছর আকার ও মানভেদে একেকটি গরুর চামড়া ৯০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হচ্ছে। কিন্তু গত বছর ১৪০০ টাকায়ও চামড়া কিনেছিলাম। এ বছর ১২০০ টাকার বেশি দিচ্ছি না। রাজধানীর হাজারীবাগের মৌসুমি ব্যবসায়ী জুয়েল এলাকা থেকে একশ’ চামড়া সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন, সেখানে আরও চামড়া পড়ে আছে। কিন্তু আমি আর কিনতে সাহস পাচ্ছি না। কারণ এখন পর্যন্ত কোনো ট্যানারি মালিক কিংবা আড়তদার চামড়ার দাম জানতে আসেননি।
রাজধানীর ঝিকাতলার মৌসুমি বিক্রেতা আব্বাস উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ঈদের দিন দেড়শ’ চামড়া কিনেই বড় অঙ্কের লোকসান গুনেছিলেন। যে কারণে বৃহস্পতিবার আর কিনতে সাহস পাইনি। ৬শ’ থেকে ৯শ’ টাকা দরে দেড়-দুই লাখ টাকার গরুর চামড়া কিনেছিলাম। অথচ চামড়া বিক্রি করতে হবে প্রতি পিস ৪০০ টাকা করে।
সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সচল নয়। ফলে ওই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরাও তেমন আগ্রহ দেখাননি চামড়া কিনতে। গজমহলের স্থানীয় বাসিন্দা আউলাদ হোসেনের ছেলে এনামুল হক সায়েম বলেন, অনেক বছর পর কোরবানির চামড়া বাণিজ্যের জৌলুস এবার হাজারীবাগে দেখা যায়নি। ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের কারণে এ এলাকায় চামড়া ব্যবসা কমেছে।