রয়র্টাসঃক্রাইমবার্তা ডেস্করির্পোটঃ
ঈদের টানা ছুটি কাটাতে কক্সবাজার সৈকতে এখন দেশী-বিদেশী হাজার পর্যটকের ভিড়। সমুদ্রের সফেন ঊর্মিমালার নান্দনিক ছন্দে নেচে ওঠে প্রতিটি হৃদয়। তাই সাগরের ঢেউয়ের সাথে মিতালী করতে তর সয়না। কোনো বাধা কিংবা সতর্কবাণী মানতে চান না তারা। কক্সবাজার তথা সৈকতে এসেই পানিতে নেমে পড়েন দ্রুত। এতে ঘটে যায় বিপত্তি। কেউ বা আবার পড়ে যান সৈকতের গুপ্তখালে। হ্যাঁ, গত দুই দিনে এ রকম গুপ্তখালে পড়ে যান অর্ধশত লোক। তবে কোনো অপঘাত ছাড়াই তাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। সম্প্রতি এই গুপ্তখালে পড়েই প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন। এখন সৈকতে পর্যটকের এ রকম ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা জানান, চলতি বর্ষা মওসুমে সৈকতে বেশ কয়েকটি গুপ্তখাল সৃষ্টি হয়েছে। সাগর উত্তাল থাকায় এসব গুপ্তখাল প্রতি বর্ষায় সৃষ্টি হয়। এসব গুপ্তখালে থাকে প্রচণ্ড স্রোত। স্বাভাবিকভাবে এসব গুপ্তখালের অস্তিত্ব বুঝা যায় না। এ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা সংঘটিত হলেই কেবল বিষয়টি টের পাওয়া যায়। বাইপাস সড়ক ধরে কক্সবাজার শহরে ঢুকতেই প্রাণ জুড়িয়ে যায় সাগরের উচ্ছ্বসিত রূপ দেখে। সাগর এমনিতে উত্তাল। উত্তাল ঢেউ দেখে ইচ্ছে করে ঢেউয়ের সাথে গড়াগড়ি করতে। কিন্তু নেমে পড়ার আগেই সাবধান; জোয়ার-ভাটা দেখে সাগরে নামতে হবে! শুনতে হবে উদ্ধারকারীদের সতর্ক বার্তা। নইলে বিপদ হতে পারে গুপ্তখালে পড়ে। ইয়াছির লাইফ গার্ডের ডুবুরি মোস্তফা কামাল জানান, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত কোন সময় কী আকার ধারণ করে তা বোঝা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এসব গুপ্তখাল স্বাভাবিকভাবে বুঝার উপায় নেই কেবল জীবন দিয়েই এই গুপ্তখালের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। গত কয়েক দিনে তারা ১৩ জনকে উদ্ধার করেছেন যারা গুপ্তখালে পড়েছিল।
সি সেফ উদ্ধারকারী দলের ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমদ জানান, এখন সকালে জোয়ার থাকছে তাই সকালে গোসল করতে নামলে তেমন বিপদ নেই তবে দুপুর থেকে ভাটার টান পড়ে তাই এ সময়ে সাগরে নামলেই ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে। সৈকতে উদ্ধারকারী লাইফ গার্ডের সুপারভাইজার মোহাম্মদ সৈয়দ নূর জানান, ঈদুল আজহার পর থেকে তার দল গোসল করতে নেমে সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার প্রাক্কালে ২৫ জন বিপদাপন্ন পর্যটককে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। তারা কাজ করছেন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণি, সিগাল ও সুগন্ধা পয়েন্টে। সৈকতে অন্যতম উদ্ধারকারী দল সি সেভের সুপারভাইজার মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ সিফাত জানান, ওই একই সময়ে তারা উদ্ধার করেছেন ১৫ জন পর্যটককে। এর মধ্যে সাতজন ছিল একেবারে মুমূর্ষু। তাদের উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। তিনি আরো জানান, পর্যটকেরা পানি দেখলেই নামতে চান এবং সারা দিন পানিতে ঢেউয়ের সাথে খেলা করেন। এক সময় তারা দুর্বল হয়ে পড়ায় হঠাৎ বিপদ ঘটে। এসব পর্যটককে সতর্ক করার পরও তারা পানি থেকে ওঠেন না। উল্টো তারা উদ্ধারকর্মীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে খারাপ আচরণ করেন। এ দিকে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার এখন লাখো পর্যটকে ভরপুর। উত্তাল সমুদ্রে গোসল, বালুচরে দৌড়ঝাঁপের পাশাপাশি তারা ছুটে বেড়াচ্ছেন মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে হিমছড়ি ঝরনা, পাথুরে সৈকত ইনানী, টেকনাফ সৈকত, মাথিন কূপ, জালিয়ারদিয়া পর্যন্ত। কেউ যাচ্ছেন রামুর বৌদ্ধপল্লী ও চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক দেখতে। কিন্তু বৈরী পরিবেশের কারণে বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকায় লোকজন প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ও মহেশখালীর সোনাদিয়া ও আদিনাথ মন্দির দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হোটেল মালিকেরা জানান, ঈদের পরদিন থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সৈকত মুখর ছিল লাখো পর্যটকে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় হাজার হাজার মানুষ। আজ শনিবার পর্যন্ত অন্তত পাঁচ লাখ পর্যটক সৈকতে ভ্রমণে থাকবেন বলে আশা হোটেল মালিকদের। শুক্রবার সৈকতের সি ইন পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, হাজার হাজার পর্যটক কোমরসমান পানিতে নেমে গোসল করছেন। উত্তাল সাগরে ঢেউয়ের ধাক্কায় কোনো পর্যটক যেন সমুদ্রে ভেসে না যান, সে জন্য লাইফগার্ডের কর্মী, ডুবুরি ও ট্যুরিস্ট পুলিশ লোকজনকে সতর্ক করছেন। গুপ্তখাল ও ভাটার সময় গোসলে নামলে স্রোতের টানে বিপদ হতে পারে, সে ব্যাপারে লোকজনকে সতর্ক করতে বালুচরে ওড়ানো হচ্ছে লাল পতাকা। লাল পতাকা উড়তে দেখা গেলে গোসলে নামা বিপদ। আর জোয়ারের সময় গোসল নিরাপদ। এ সময় ওড়ানো হয় সবুজ পতাকা। এর আগে ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলে রাব্বী জানান, ঈদের কয়েক দিনের ছুটিতে পাঁচ লাখের বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটবে। বহু পর্যটকের নিরাপত্তার জন্য ১২২ জন ট্যুরিস্ট পুলিশসহ আরো কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কাজ করছেন। হোটেল মালিকেরা জানান, এ সময় হোটেল, মোটেল, কটেজ ও গেস্টহাউজ, রেস্তোরাঁর ব্যবসা হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। বর্ষা মওসুমের ভ্রমণকে কাজে লাগানোর জন্য ইতোমধ্যে হোটেল-মোটেল মালিকেরা ৪০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত ক ভাড়ায় বিশেষ ছাড় দিয়ে যাচ্ছেন। সমুদ্র সৈকতের কলাতলী এলাকার এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় তারকা মানের আটটিসহ হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউজ ও কটেজ আছে প্রায় ৪৫০টি। এসব হোটেলে দৈনিক দেড় লাখ মানুষের রাত যাপনের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে কটেজ আছে ১৬৫টি। নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন কটেজে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ কটেজে একটি ক ৪০০ থেকে ২০০০ টাকায় পাওয়া যায়। কম খরচের খাওয়া এবং বিনোদনের নানা সুযোগও কগুলোতে রাখা হয়। নিরাপত্তার জন্য কটেজগুলোতে আছে সিসিটিভি।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, বিপুল পর্যটক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সন্ধ্যার পর শহরের অলিগলি অন্ধকারে ডুবে থাকে। মেরিন ড্রাইভ সড়ক অরতি। সৈকতের অরতি ৯০ কিলোমিটার সৈকতে পর্যটকদের দেখভালের কেউ নেই। এমনকি সেখানে গোসলে নেমে কোনো পর্যটক বিপদে পড়লে উদ্ধারের কেউ নেই। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ কে এম ইকবাল হোসেন বলেন, লাখো পর্যটকের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর। যে কারণে এ পর্যন্ত কোনো ঘটনা ঘটেনি। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও পুলিশ দায়িত্বপালন করছে। ট্যুরিস্ট পুলিশ সূত্র জানায়, জোয়ার-ভাটা দেখে গোসলে নামার জন্য পর্যটকদের সতর্ক করে প্রতিদিন প্রচারণা চালানো হলেও কেউ তা আমলে নিচ্ছেন না। ভাটার সময়ও অনেকে উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছেন। অনেকে বিপদে পড়ছেন। গত ২০ দিনে সৈকতে গোসলে নেমে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে একজন বিদেশি, তিনি জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তা। অপর দু’জন রাজধানীর দু’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থী।