# ১শ আসনে ইভিএম এ ভোট
# আইন না করেই দেড় লাখ মেশিন কেনার প্রস্তাব
# ভারতে ইভিএম এ কারচুপির অভিযোগ
# ইভিএম মানেই ত্রুটিযুক্ত নির্বাচন -বিএনপি
মিয়া হোসেন: অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তড়িঘড়ি করে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার আগেই প্রায় চার হাজার কোটি টাকার দেড় লাখ মেশিন কেনার প্রস্তাব দিয়েছে ইসি। এ প্রস্তাবের আগে সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হয়নি। ইভিএম এর মাধ্যমে ডিজিটাল ‘কারচুপি’ করা সম্ভব বলে অভিযোগ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ইভিএম ব্যবহারের বিরোধীতা করেছে। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের দু’একটি দল ইভিএম এর পক্ষে মতামত দিয়েছিল। তখন সিইসি কেএম নূরুল হুদা বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো না চাইলে ইভিএম চাপিয়ে দেয়া হবে না।’ কিন্তু এখন হঠাৎ করেই ইভিএম এর জন্য ইসি তোড়জোড় শুরু করেছে।
স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে গিয়ে বেশকিছু ত্রুটিও দেখা দিয়েছে। এর আগের দু’টি কমিশন ত্রুটির কারণে এ মেশিন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত বাদ দিয়েছে। সম্প্রতি ভারতে ইভিএম এ কারচুপির অভিযোগ করেছে সকল বিরোধী দল। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও সময় স্বল্পতার কারণে আরপিও সংশোধন করার উদ্যোগ বাতিল করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে তড়িঘড়ি করে ইভিএমকে যুক্ত করার জন্য আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী কাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে কমিশনের বৈঠকে আলোচনা হবে। আলোচনা শেষে আরপিও সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খসড়া চূড়ান্ত করার পর আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং এর জন্য পাঠানো হবে। পরে তা কেবিনেটে পাস হওয়ার পর চলতি সংসদেই নির্বাচনী আইনের সংশোধনী পাস হবে।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারে তাড়াহুড়া না করতে দাবি জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, বিগত তিন সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত কেন্দ্রগুলোতে ডিজিটাল কারচুপির দৃশ্য দেশবাসী দেখেছে। ইভিএম পদ্ধতিতে ডিজিটাল কারচুপি করতে সুবিধা। তাই তা চাপিয়ে দেয়ার চক্রান্ত হচ্ছে। আরপিও সংশোধন করে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের বিধান প্রয়োগ করে সিইসি একটি মহলকে ডিজিটাল কারচুপির সুযোগ করে দেয়ার চক্রান্ত করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা ছাড়া ইভিএম ব্যবহার না করার জন্য দাবি জানানো হয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হচ্ছে, আইন পাস করার পর ব্যবহারের আগে রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করা হবে। তবে এক তৃতীয়াংশ তথা ১শ আসনে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ইসি সচিব। গতকাল মঙ্গলবার ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে। সে লক্ষ্যে ইসি দেড় লাখ ইভিএম কেনার জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। নির্বাচনের আগে আইন পাস, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতসহ সবকিছু ঠিক থাকলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার মতো কমিশনের সক্ষমতা থাকবে।
তিনি বলেন, ‘আইন পাস হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে কমিশন। তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি হবে না। আর জাতীয় নির্বাচনের পরই সারা দেশের সব উপজেলা পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেখানেও ইভিএম ব্যবহার করা হবে।
ইভিএম মানেই ত্রুটিযুক্ত নির্বাচন – বিএনপি
ইভিএম মানেই ত্রুটিযুক্ত নির্বাচন। ইভিএম দিয়ে কখনও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করে বিএনপি। দলটির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আগামী নির্বাচনকে ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে নেওয়ার জন্য ইভিএম ব্যবহার প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনের সচিবের যৌথ প্রযোজনা। ইভিএম মানেই ত্রুটিযুক্ত নির্বাচন। ইভিএম দিয়ে কখনও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ইভিএমে সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। এ মেশিন দিয়ে ডিজিটাল কারচুপি হওয়া সম্ভব। আগামী নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী সরকারকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর জন্যে বিতর্কিত ইভিএম ব্যবহারের পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন পুরোপুরি জালিয়াতির ওপর সাজাতেই এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কমিশনের সচিব আওয়ামী নেতাদের হুকুম তামিল করেন নির্বাচন কমিশনে। কোনো অবস্থাতেই আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। ইভিএম ব্যবহারের অশুভ তৎপরতা বন্ধ করতে জনগণ প্রস্তুত বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ডিজিটাল কারচুপির জন্য এ আয়োজন – পীর সাহেব চরমোনাই
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই ইভিএম সর্ম্পকে বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে প্রায় সব দলের নেতৃবৃন্দ নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতির বিরোধীতা করে মতামত পেশ করেছিলেন। সে সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দকে আশ^স্ত করে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো না চাইলে ইভিএম চাপিয়ে দেয়া হবে না’।
তিনি বলেন, বিগত তিন সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত কেন্দ্রগুলোতে ডিজিটাল কারচুপির দৃশ্য দেশবাসী দেখেছে। ইভিএম পদ্ধতিতে ডিজিটাল কারচুপি করতে সুবিধা। তাই তা চাপিয়ে দেয়ার চক্রান্ত হচ্ছে। আরপিও সংশোধন করে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের বিধান প্রয়োগ করে সিইসি একটি মহলকে ডিজিটাল কারচুপির সুযোগ করে দেয়ার চক্রান্ত করছে। এ চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করার চক্রান্ত দেশবাসী রুখে দাড়াবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ভারতে ইভিএম এ কারচুপির অভিযোগ
ইভিএম তথা ভোটিং মেশিনে কারচুপি সম্ভব অভিযোগ তুলে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ফের ব্যালট পেপারে ভোটের দাবিতে সোচ্চার হতে শুরু করেছেন। আর ঠিক এ সময়েই নির্বাচন কমিশনের ডাকা এক সর্বদলীয় বৈঠকে সব বিরোধী দল একযোগে নির্বাচন কমিশনের কাছে ইভিএমের মাধ্যমে কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ জানিয়েছেন। সোমবারের সর্বদলীয় বৈঠকে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বহুজন সমাজ পার্টি, সিপিআই, সিপিএমসহ ৫১টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল এই ইভিএমের বিরোধীতা করেছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য কল্যাণ ব্যানার্জি বলেন, আমাদের ইভিএমের ওপর কোনো বিশ্বাস নেই। তাই নির্বাচনে ব্যালট পেপার ফিরিয়ে আনা হোক ? বাকি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোরও একই বক্তব্য থাকায় এদিন বিশেষ কোনো রফাসূত্র বেরিয়ে আসেনি।
সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই ইভিএম কেনা হচ্ছে
প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ইভিএম প্রকল্প গ্রহণের প্রস্তাবটি সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। জাতীয় নির্বাচনের চার মাসেরও কম সময় সামনে রেখে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই কমিশন এ প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বেশ কিছু বিষয় স্পষ্ট করার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) মতামত দিয়েছে।
গত ১৯শে আগস্ট পিইসির সভায় এ মতামত দেয়া হয়। সম্প্রতি ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে ইসি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ১৯শে আগস্টের সভাটি বিশেষ কিছু কারণে মুলতবি করা হয়েছে। পিইসির সভায় প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে মর্মে মতামত এসেছে।
প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আলোচনার তাগিদ দিয়েছে পিইসি। প্রকল্পে ২০৪ জন পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা জানতে চেয়েছে পিইসি। এক্ষেত্রে পরামর্শকের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও কর্মপরিধি ডিপিপিতে উল্লেখের জন্য বলা হয়েছে। দেড় লাখ ইভিএমের যন্ত্রপাতি ও সিস্টেম ক্রয়ের কথা প্রকল্পে বলা হয়েছে। তবে কোথা থেকে কীভাবে এসব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হবে তা প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি। প্রকল্পে ৩১১০ জনের প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ থাকলেও তারা কারা সে বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া ৩০ জনকে বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রদানের কথা বলা হলেও তাদের পরিচয় জানানো হয়নি। প্রকল্পে বিজ্ঞাপন প্রচার, পরিবহন, মোটরযান ক্রয়, কম্পিউটার সফটওয়্যার, আসবাবপত্র ক্রয় বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরিকল্পনা কমিশন থেকে কিছু জানানো হয়নি। মাননীয় মন্ত্রী এর আগে একটা সভা ডেকেছিলেন। ওই সভা মুলতবি হয়েছে। সভার পরবর্তী তারিখ এখনো জানানো হয়নি।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ- আলোচনা ছাড়াই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের লক্ষ্যে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। এজন্য প্রায় দেড় লাখ ইউনিট ইভিএম ক্রয়ের জন্য ৩৮২৯ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের প্রস্তাবও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সারা দেশে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেছে ইসি। এর আগে ইসি জানিয়েছিল, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে সফলতা পেলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করবে ইসি। সিইসি কেএম নূরুল হুদা একাধিকবার বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি নেই ইসি’র। রাজনৈতিক দল ও ভোটাররা সর্বসম্মতি দিলেই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হতে পারে। ইসি’র সঙ্গে সংলাপে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। বাড়তি জনবল, খরচ ও সময় বেশি লাগার কারণে এসব নির্বাচনে নানা সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এরও আগে ২০১৩ সালে সিটি নির্বাচনে বুয়েটের তৈরি ইভিএমে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রাজশাহী সিটির পিটিআই কেন্দ্রে রণক্ষেত্র তৈরি হয়। ইভিএমের কারণে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া বিতর্কিত হয়ে পড়ে।
সর্বপ্রথম এক এগারোর সময়কার এটিএম শামসুল হুদা কমিশন স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএমের প্রচলন ঘটায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সহায়তায় প্রথমে ২০১০ সালে এ প্রযুক্তির ৫৩০টি মেশিন কেনা হয়। ব্যবহার করতে গিয়ে ইভিএমে নানা যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। পরে ২০১১ সালে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) প্রস্তুত করা ৭০০ ইভিএম কেনা হয়। এগুলোও পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত ছিল না। শামসুল হুদা কমিশন ২০১১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ২১ নং ওয়ার্ডে বুয়েটের ইভিএম ব্যবহার করে।
পরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, টাঙ্গাইল পৌরসভা ও নরসিংদী পৌরসভায় এ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় হুদা কমিশনের স্থলে বিধির নিয়মে নতুন কমিশন হিসেবে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদায়ী রকিব উদ্দিন কমিশন দায়িত্ব নেয়। তাদের মেয়াদে রাজশাহী সিটিতে ২০১৩ সালে ইভিএম ব্যবহার করে পুরো বিতর্কের মধ্যে পড়ে যায় ইসি। পরে কমিশনার হিসেবে মেয়াদ পূর্ণের আগে ইভিএম ব্যবহার করেনি। তবে, নতুন ইভিএমের প্রচলন চালু রেখে যায়। আর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেএম নূরুল হুদার কমিশন দায়িত্বে এসে কমিটি করে পুরনো ইভিএমকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।
——–০————–
ভারতে ইভিএম নয়, ব্যালটে ভোট চায় বিরোধীরা
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যখন খুব শিগগিরি সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে, তখন পাশের দেশ ভারতে কিন্তু ইভিএমের বিরোধিতা ক্রমেই আরও তীব্র হচ্ছে।
কংগ্রেস-সহ অনেকগুলো বিরোধী দল ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে জানিয়ে এসেছে, তারা চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইভিএম বাতিল করে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে নির্বাচনের পুরনো পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া হোক।
বিজেপি অবশ্য ইভিএম বজায় রাখারই পক্ষপাতী, আর ভারতের নির্বাচন কমিশন সব দলেরই মতামত খতিয়ে দেখবে বলে কথা দিয়েছে।
গত দু-চার বছরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ইভিএম নিয়ে কারসাজির অজস্র অভিযোগ তুলেছে একাধিক বিরোধী দল।
এমন কী যন্ত্র খারাপ হলেও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে সব ভোটই গিয়ে পড়েছে বিজেপির ঝুলিতে, কংগ্রেস বা আম আদমি পার্টি বহুবার এমন অভিযোগও করেছে।
এবারে নির্বাচন কমিশনের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে গিয়ে কংগ্রেস-সহ একাধিক বিরোধী দল দাবি জানিয়েছে ইভিএম পদ্ধতিটাই বাতিল করে দেওয়া হোক।
কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভি বলছেন, “শুধু আমরাই নই – দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দলই মনে করে যত দ্রুত সম্ভব কাগজের ব্যালট আবার ফিরিয়ে আনা উচিত। এই দাবিতে আমরা অনড় থাকব – কারণ ইভিএমের ওপর আমাদের বিশ্বাস টলে গেছে।”
“সম্প্রতি কৈরানা আসনের উপনির্বাচনেও দেখা গেছে প্রায় ১৩ শতাংশ মেশিন খারাপ বেরিয়েছে। আমরা জানতে চাই, কারা এগুলো সারায়, কীভাবেই বা সারায়?” প্রশ্ন তুলছেন তিনি।
কংগ্রেস ছাড়াও ইভিএম বাতিলের দাবি জানাচ্ছে সমাজবাদী পার্টি, বসপা বা তৃণমূল কংগ্রেসের মতো আরও অনেক দল।
তৃণমূলের সিনিয়র এমপি কাকলি ঘোষদস্তিদার বিবিসিকে বলছিলেন ইভিএম নিয়ে ঠিক কোথায় তাদের আপত্তি।
তার কথায়, “আমাদের এমন একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছে যে যখন ইভিএমে ভোট রেকর্ড করা হচ্ছে তখন ভোটারের মতামত বোধহয় সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। আর সে কারণেই আমরা ব্যালট পেপার ফিরিয়ে আনার কথা বলেছি।”
“আর তা ছাড়া পশ্চিমী দুনিয়ার কোনও আধুনিক ও উন্নত দেশেই তো ইভিএম ব্যবহার করা হয় না। হয় না, কারণ সেখানে ম্যানিপুলেশন বা কারসাজির অবকাশ থাকে। তারা যদি ব্যালট পেপারে ভোট করাতে পারে, তাহলে আমাদেরও ব্যালটে ফিরে যেতে অসুবিধা কোথায়?” বলছিলেন কাকলি ঘোষদস্তিদার।
কিন্তু ভারতে গত প্রায় কুড়ি বছর ধরে ভোটে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে – নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করে তোলার পেছনেও অনেকেই এতদিন ইভিএমকে কৃতিত্ব দিয়ে এসেছেন।
হঠাৎ সেই ইভিএমকে ঘিরে এই যে সন্দেহের ছায়া তৈরি হয়েছে, তার কতটা ভিত্তি আছে?
সাবেক আমলা ও পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা মীরা পান্ডে বলছিলেন, “যতই হোক, ইভিএম একটা যন্ত্র এবং আমি টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ নই যে বলতে পারব ওটাতে কোনও গন্ডগোল হচ্ছে কি হচ্ছে না!”
“তবে এটুকু নিশ্চয় বলতে পারি ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে অনেক সহজ বা স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করা যায়। আগে যে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট করানো হত তাতে কিন্তু গন্ডগোল করানোর অনেক বেশি সুযোগ থাকত।
“ইভিএমে সেটা করা মুশকিল – কারণ এখানে বুথ দখল করেও যদি কেউ মেশিনে একধারসে বোতাম টিপে যেতে থাকে তাহলে পরে মেশিনের মেমোরি চিপ থেকে কিন্তু ধরে ফেলা সম্ভব কখন, কতগুলো ভোট পড়েছে। আর সেই জায়গায় সব ব্যালট পেপারই দেখতে এরকম, কাজেই বাক্সে কোনটা সঠিক ভোট আর কোনটা ফল্স ভোট, তা ধরা খুব মুশকিল!”, বলছিলেন মিস পান্ডে।
ফলে ব্যালট পেপার ফিরিয়ে আনলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট ও রিগিং-ও আবার প্রবলভাবে ফিরে আসবে, এই আশঙ্কাও আছে অনেকের।
তবে ভারতের নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে এখনই কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ওপি রাওয়াত বলছেন, “কয়েকটা দল ইভিএম নিয়ে তাদের আপত্তির কথা তুলেছে ঠিকই – এখন কমিশন তাদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছবে।”
ভারতে শেষ পর্যন্ত কী হবে তা এখনও স্পষ্ট নয় ঠিকই, কিন্তু এই বিতর্কের ফলে প্রতিবেশী বাংলাদেশে ইভিএম চালু করার যে কোনও উদ্যোগও যে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে – তাতে কোনও সন্দেহ নেই।