ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রির্পোটঃএকটি সাদাকালো ছবি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে নদীতে ভেসে আছে দু’টি লাশ। পাশে এক ব্যক্তি কৃষিকাজে ব্যবহৃত একটি যন্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে করা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি বইয়ে স্থান পেয়েছে ছবিটি। ক্যাপশন দেয়া হয়েছে ‘বাঙালিরা স্থানীয় আদিবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে’। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ছবিটি মিয়ানমারের নয়, ছবিটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি ব্যবহার করে এমনই রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সে সময় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যার ছবিকেই মিয়ানমার সেনারা রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের দ্বারা বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী নিধনের ছবি হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছে।
শুধু তাই নয় বইটিতে ব্যবহার করা হয়েছে আরো দুটি ভুয়া ছবি। একটি রুয়ান্ডার এবং অপরটিও বাংলাদেশীদেরই। রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীরা মিয়ানমার ছাড়ছে। অথচ বলা হয়েছে তারা মিয়ানমারে প্রবেশ করছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পাবলিক রিলেশন অ্যান্ড সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার ডিপার্টমেন্ট ১১৭ পৃষ্ঠার ওই বইটি জুলাই মাসে প্রকাশ করে। তারা ওই বইয়ে প্রকাশিত ছবিকে ‘ডকুমেন্টারি ফটো’ বলে উল্লেখ করেছে। অথচ এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধকালীন ছবি। ওই বইয়ে ব্যবহৃত আটটি ঐতিহাসিক ছবি বিশ্লেষণ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, এগুলোর মধ্যে তিনটি ছবি ভুয়া। ছবিগুলো বিকৃত করা হয়েছে।
বইটির অধিকাংশ বিষয়বস্তুর সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে সেনাবাহিনীর ‘ট্রু নিউজ’ বা ‘সত্য খবর’ তথ্য ইউনিটকে। এ ইউনিট রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকে খবর সরবরাহ করে যাচ্ছে, বিশেষত ফেসবুকের মাধ্যমে।
ছবিটির নিচে উল্লেখ করা হয়েছে বাঙালিরা মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রুয়ান্ডার গণহত্যা থেকে বাঁচতে তানজানিয়ায় পালাতে থাকা শরণার্থীদের রঙ্গিন ছবিকে সাদা-কালোয় রূপান্তর করা হয়েছে
বইটিতে প্রকাশিত ছবিগুলো রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের বলে দাবি করা হয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে একটি বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধকালীন ছবি এবং অপরটি তানজানিয়ার ছবি। তৃতীয় একটি ছবির বর্ণনায় দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে প্রবেশ করছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে তা দেখাচ্ছে যে তারা ওই এলাকা ত্যাগ করছে।
একটি ছবিতে দেখা গেছে, এক ব্যক্তি কৃষিকাজে ব্যবহৃত একটি সরঞ্জাম নিয়ে দুইটি মৃতদেহের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। ওই ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ১৯৪০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় রোহিঙ্গা কর্তৃক বৌদ্ধদের হত্যার ছবি এটি।কিন্তু ওই ছবিটি বিশ্লেষণ করে রয়টার্স বলছে, প্রকৃতপক্ষে এটি বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো গণহত্যার ছবি। যখন হাজার হাজার বাংলাদেশিকে হত্যা করেছিল পাক হানাদার বাহিনী। অথচ সেই ছবিকে বলা হচ্ছে রাখাইনের ছবি।
অন্য একটি ছবিতে দেখা গেছে, লং মার্চ করে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। ছবির ক্যাপশনে দাবি করা হয়েছে, মিয়ানমারের নিম্নাঞ্চলীয় এলাকা ব্রিটিশ উপনিবেশের দখলে যাওয়ার পর বাঙালিরা মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করছে। ঔপনিবেশিক যুগে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ হিসেবে ছবিটি দেখানো হয়েছে।
পানি পথে বাঙালিরা মিয়ানমারে প্রবেশ করছে বলে এই ছবিটিতে উল্লেখ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি অভিবাসীরা মিয়ানমার ছাড়ছে
১৯৪৮ সালে ঔপনিবেশিক যুগের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু ওই ছবিটি বিশ্লেষণ করে রয়টার্স নিশ্চিত করেছে যে, ১৯৯৬ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যা থেকে বাঁচতে তানজানিয়ায় পালাতে থাকা শরণার্থীদের রঙ্গিন এই ছবিটিকে সাদা-কালো রূপ দেওয়া হয়েছে। পিটসবার্গ পোস্ট গেজেট পত্রিকার জন্য ওই ছবিটি তুলেছিলেন মারথা রিয়াল। তবে ওই ছবিটি মিয়ানমারের এভাবে ব্যবহারের প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও পিটসবার্গ পোস্ট গেজেটের তরফ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এছাড়া আরও একটি সাদা কালো ছবি প্রকাশিত হয়েছে যেখানে একটি ভাঙ্গাচোরা নৌকায় অনেক মানুষকে দেখা যাচ্ছে। নৌকার এই ছবিটি উল্টো করে দেয়া হয়েছে। পানি পথে বাঙালিরা মিয়ানমারে প্রবেশ করছে বলে দাবি করা হলেও রয়টার্স বলছে, এটি ২০১৫ সালের ছবি। সেসময় রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি অভিবাসীরা মিয়ানমার ছাড়ছে। নৌপথে হাজার হাজার মানুষ মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।