আবু সাইদ বিশ্বাসঃ সাতক্ষীরা: কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচনে জেলাতে আখ চাষের গুরুত্ব বেড়েছে। অন্য যে কোন ফসলের তুলনায় আখের পরিচর্যায় অধীক শ্রমিকের চাহিদা থাকায় পেশাটি দারিদ্র্য বিমোচনে বেশ ভূমিকা রেখে চলেছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে লক্ষাধীক বেকার মানুষের। কৃষিবিদের মতে হেক্টর প্রতি আখ জমি লাগানো থেকে কাটা পর্যন্ত প্রায় ৬০০ শ্রমিক-দিবসের প্রয়োজন হয়। এবছর জেলাতে ১৫০ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। এতে ৯০ হাজার হাজার শ্রমিকের কাজের পরিধি বেড়েছে। এছাড়া সারা বছর কাঁচা আখের রশ ও গুড়,পাটালি সহ আভজাত পণ্য বিক্রয় করতে আরো কয়েক হাজার শ্রমিকের দরকার হয়। বর্তমানে জেলাতে আখের পরিচর্যা ও আখের রস বিক্রয় করতে ব্যস্ত সময় পার করছে এ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা। ভারতীয় চিনি আসা হ্রাস পাওয়াতে জেলাতে আখের উৎপান বেড়েছে।
আখ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন সহজেই সম্ভব। শুধু এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের তৎপরতা দরকার। কৃষিবিদরা বলনে আখ এমন একটি ফসল যার রোপণকাল থেকে পরিপক্বতা পর্যন্ত ১০-১৪ মাস সময় প্রয়োজন হয়। আখের পরিচর্যা শ্রমিক নির্ভরশীল বিধায় আখচাষের মাধ্যমে কৃষি শ্রমিকদের সারা বছর কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। এক হেক্টর আখের জমি লাগানো থেকে কাটা পর্যন্ত প্রায় ৬০০ শ্রমিক-দিবসের প্রয়োজন হয়। অন্য কোন ফসল আবাদের জন্য এত শ্রমিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। সাতক্ষীরাসহ দেশের দারিদ্র পীড়িত এলাকা, যেখানে কৃষি শ্রমিকদের কাজ ধানচাষের উপর নির্ভরশীল ,আগস্ট থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তারা (কৃষি শ্রমিকরা) কাজের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করে, সেখানে আখচাষের মাধ্যমে বেকার কৃষি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।
আখ চাষীরা জানান, আখ ফসলের কোন অংশই ফেলনা নয়। আখক্ষেত পরিচর্যাকালীন যে সমস্ত শুকনো পাতা ও মরাগাছ মাঠ থেকে অপসারণ করা হয় তা বিক্রি করে কিছু নগদ অর্থ উপার্জন করা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আখের পাতা খাওয়ানোর ফলে গবাদি পশুর দুধের পরিমাণ বেড়েছে কয়েক গুণ।
কৃষিবিদ জাহিদুল ইসলাম জানান, যে সমস্ত পরিবার দৈনিক মজুরির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে যাদের বসতভিটা ছাড়া আবাদি কোন জমি নেই। পরিবারের কর্তা-ব্যক্তিটি সকালে কাজের সন্ধানে বের হয়ে যায়, কাজের বিনিময়ে পাওয়া মজুরি দিয়ে পরিবারের সবার চাল-ডালের সংস্থান করতেই হিমশিম খায়; তার পক্ষে সন্তানদের জন্য ১টি আখ ২০ টাকা দিয়ে কেনা খুবই কষ্টকর। ওই ব্যক্তিটি যদি তার বসতভিটার আশেপাশে ১০০টি চিবিয়ে খাওয়ার আখের চারা সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে লাগিয়ে রাখে এবং পরিবারের সদস্যরা সঠিক পরিচর্যা করে তবে রোপণকৃত ১০০টি চারা থেকে কমপক্ষে ৬০০টি সুস্থ সবল আখ পাওয়া সম্ভব, যা সর্বনিম্ন বাজারদরে বিক্রি করে ১২,০০০/- টাকা আয় করা সম্ভব। আর এজন্য যে পরিচর্যা দরকার তা বাড়ির মহিলারাই করতে পারে। অর্থাৎ মাসে ১০০০ টাকা আয় করতে বাড়ির কর্তা ব্যক্তিকে কোন চিন্ত করতে হয় না। অথবা ৬০০টি আখের মধ্যে কিছু আখ বিক্রি করে টাকা আয় করতে পারে এবং অবশিষ্টগুলো শিশুদের খেতে দিলে তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়।
বর্তমানে জেলার উপজেলা শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত প্রতিটা বাজারের চিবিয়ে খাওয়া আখ বিক্রি হচ্ছে। এলাকা ভেদে প্রতিটা আখ ২০ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ছোট ছোট হস্ত চালিত মাড়াই মেশিনে তৎক্ষণিকভাবে আখ মাড়াই করে রস বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতি গ্লাস আখের রস স্থান ভেদে ১০-১৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এতে কয়েকশ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আখ পরিবহনে, গুড় তৈরিতে, এবং গুড় বাজারজাতকরণে যে পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থান হয়, অন্য কোন একক ফসলে এত কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ নেই।
অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশ এখন আখের রস বোতলজাত করে বাজারজাত করার উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আখের রসের ভেষজ গুণ, পুষ্টিমান এবং স্বাদের কারণে এর চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা যে কোন কোমল পানীয়ের চেয়ে অনেক বেশি। এক্ষেত্রেও অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। এমনকি তা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জনেরও সুযোগ রয়েছে।
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরাতে পরীক্ষামূলকভাবে লবণ সহিষ্ণু নতুন জাতের আখ চাষ করা হচ্ছে। আখ গবেষণা ইন্সটিটিউট ইশ্বরদীর ব্যবস্থাপনায় জেলার লবণাক্ত এলাকাতে উচ্চমাত্রার লবণ সহিষ্ণু নতুন ৩৯ ও ৪৬ জাত চাষ করা হয়েছে। কৃষকরা ইতোমধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলায় ১৫০ হেক্টর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫ হেক্টর, কলারোয়ায় ২ হেক্টর, তালায় ৭৫ হেক্টর, দেবহাটায় ৩৫ হেক্টর, কালিগঞ্জে ২৫ হেক্টর, আশাশুনিতে ৫ হেক্টর এবং শ্যামনগর উপজেলাতে ৪ হেক্টর পরিমাণ জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সমজিত কুমার পাল জানান, উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার ৭টি উপজেলার সবচেয়ে বেশি লবণাক্ততা এমন ৫টি উপজেলাতে পরীক্ষামূলকভাবে লবণ সহিষ্ণু নতুন ৩৯ ও ৪৬ জাতের আখ চাষ করা হয়েছে।
আব্দুল্লাহ। তালা উপজেলার খলিষখালি এলাকার মঙ্গলানন্দকাটী গ্রামের একজন আখ চাষী। ৫০ বছর ধরে তিনি চলতি মৌসুমে আখ বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান। আখ নির্ভও তার পরিবার।
পাটকেলঘাটার আচিমতলা গ্রামের মুনছুর। এলাকা থেকে আখের ক্ষেত ক্রয় করেন। সেই আখ কেটে সাতক্ষীরা শহরে পাইকারী বিক্রয় করেন। এতে তিনি বছরে ২-৩ লক্ষ টাকা লাভ করেন।লাভের টাকয় প্রতি বছর তিনি বিঘা খানিক জমি ক্রয় করেন। এমন
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ কাজী আব্দুল মান্নান জানান, সাতক্ষীরাতে আখ চাষে আবার চাষীরা আগ্রহী হচ্ছে। কৃষি খামার বাড়ির পক্ষ থেকে সার্বিক খোজখবর নেয়া হচ্ছে। এছাড়া আখ চাষে বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।