ক্রাইমবার্তা ডেক্স রিপোর্ট;
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) দুই দফায় নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও একসময় দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগ ছেড়ে গঠন করেছেন নাগরিক ঐক্য।
সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচনের নানা দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
মাহমুদুর রহমান মান্নাপ্রথম আলো: আপনারা যাঁরা জাতীয় ঐক্যের কথা বলেন, সেই যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের মধ্যে সম্প্রতি একটি বৈঠক হয়েছে এবং সেই সূত্রে দুই পক্ষের মধ্যে ঐক্যের কথা আমরা জানলাম। এই বৈঠকের বাড়তি গুরুত্ব কী?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আমরা জাতীয় ঐক্যের কথা বলছি ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত অর্থে জাতীয় ঐক্য বলতে যা বোঝায়, তার সঙ্গে এর কিছু পার্থক্য রয়েছে। আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে স্বৈরাচারী আচরণ করলেও তারা দেশের একটি বড় দল। তাদের সমর্থক রয়েছে। এই দল আমাদের ঐক্য থেকে দূরে থাকছে। জামায়াতকেও আমাদের সঙ্গে নিচ্ছি না। সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদ বা তাঁর দলকেও আমরা চাই না। আমাদের উদ্যোগকে আসলে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক ঐক্য বলা যায়। আমরা যুক্তফ্রন্টের চারটি দল ও গণফোরাম পাঁচ বছর ধরেই বিকল্প একটি রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি। কিন্তু ঐক্য গড়ে ওঠেনি। ড. কামাল হোসেন দলের ঐক্যের চেয়ে জনগণের ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে আসছেন। এদিকে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড ও কারাগারে যাওয়ার পর পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে গেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির পক্ষে আওয়ামী লীগের এই স্বেচ্ছাচারকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও কিশোরদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে দেশের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠী দেশের মূলধারার দলগুলোর কাছে যাবে না। ভয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারি দল মনে করেছিল, সবকিছুই নিজেদের জন্য নিরাপদ। এসব আন্দোলন সেই পরিস্থিতিকে নাড়া দিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা সবাই অনুভব করছেন। ড. কামাল হোসেনও করেছেন। তিনি আলোচনায় বসেছেন।
প্রথম আলো: এ ধরনের ঐক্য কি ফল দেবে বলে মনে করেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: ড. কামাল হোসেন আমাদের থেকে আলাদা থেকেছেন, আবার আমাদের সঙ্গে বসেছেন। আমি মনে করি, এটি একটি বৃহত্তর ঐক্যের পথ তৈরি করবে। এর আগে আমরা বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখেছি। তারাও স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়েছে। আমরা যে ঐক্যের কথা বলছি, তা যেনতেন ঐক্য নয়। আমরা সব ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে এবং এর ওপর ভিত্তি করেই ঐক্য গড়তে চাইছি, যাতে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা যায়। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ঐক্যের পথ তৈরি হবে বলে মনে করি। সাংগঠনিক শক্তি কম হলেও যুক্তফ্রন্ট এখন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হাজির হয়েছে।
প্রথম আলো: আমরা বি. চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছি। সেখানে বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রয়েছে। বিএনপি একটি বড় দল। আসন ভাগাভাগির যে প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন, তা কি বাস্তবসম্মত?
মাহমুদুর রহমান মান্না: এটাতে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই যে বিএনপিকে ১৫০টির কম আসন দেওয়ার বিষয়টি হয়তো এখনো বাস্তবসম্মত নয়। ভবিষ্যতে কখনো এই পরিস্থিতি হবে কি না জানি না। বাংলাদেশে এখনো আওয়ামী লীগের বাইরে মানুষ বিএনপিকেই বোঝে। রাজনীতিতে তৃতীয় কোনো শক্তি বলতে যা বোঝায়, তা এখনো গড়ে ওঠেনি। আমরা যে প্রক্রিয়া শুরু করেছি বা চেষ্টা করে যাচ্ছি, তার মধ্য দিয়ে তৃতীয় শক্তির বিষয়টি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। কিন্তু তৃতীয় শক্তি হিসেবে আমরা দাঁড়িয়ে গেছি—এটাও এখন বলা যাবে না।
প্রথম আলো: বিএনপিকে আপনাদের সঙ্গে চাইছেন, কিন্তু কোন বিবেচনা থেকে চাইছেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: বিএনপি ১০ দফা কর্মসূচি দিয়েছে। এর লক্ষ্য একটি গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করা। আমাদের দলও একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণায় বিশ্বাস করে, সমাজতন্ত্রের ধারণায় নয়। সাধারণ মানুষের কল্যাণ, বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটানো ও ধনবৈষম্য কমানো—এসব আমাদের নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আমাদের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ও যোগাযোগ রয়েছে এবং হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তাকে বড় মনে করছি। আমরা আসলে সব ক্ষেত্রেই ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার অবসান চাই—পার্লামেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও বিরোধী দলের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য চাই। বি. চৌধুরী যে ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেছেন, তা হচ্ছে কেউ যেন কোনোভাবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে না পারে। এ জন্য আমাদের মধ্যে সংবিধান সংশোধনের চিন্তাভাবনাও রয়েছে।
প্রথম আলো: এসব ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা মেনে বিএনপি আপনাদের সঙ্গে আসবে বলে মনে করেন কি?
মাহমুদুর রহমান মান্না: নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতায় বিএনপিকে ১৫০-এর নিচে আসন দেওয়ার চিন্তাভাবনা অনেকের মধ্যে রয়েছে। আগেই বলেছি, এটা হয়তো খুব বাস্তবসম্মত নয়। অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। বিএনপি বড় দল। দেখা যাবে দলের অনেক লোক নানা জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছেন। ফলে আসনের চেয়ে ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। নানা কারণে বিএনপি এখন বেশ বেকায়দায় আছে। ফলে দলটির এ ধরনের বৃহত্তর সমঝোতায় আসা উচিত। আমরা এ জন্য চুক্তি করতে পারি। মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে নির্বাচনের আগে যে চুক্তি হয়েছিল, তা তো আনোয়ার ইব্রাহিমের মানার কথা নয়। কিন্তু তিনি তা করেছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের এসব বিষয় অজানা নয়। আমাদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ আছে, তাঁরা আমাদের ধারণা বা প্রস্তাবকে নাকচ করে দেননি।
প্রথম আলো: যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের মধ্যে সেদিন যে বৈঠক হলো, সেখানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। তিনি কার প্রতিনিধিত্ব করেছেন? বিএনপির?
মাহমুদুর রহমান মান্না: সেদিনের বৈঠকে বিএনপির তরফে কেউ ছিলেন না। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। তিনি একজন বুদ্ধিজীবী।
প্রথম আলো: আপনি মালয়েশিয়ার মাহাথির-আনোয়ার ইব্রাহিম চুক্তির কথা বললেন। বি. চৌধুরীও তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ওই চুক্তির কপি তিনি আনতে পাঠিয়েছেন। তা কি আনা হয়েছে?
মাহমুদুর রহমান মান্না: চুক্তির কপি আনা হয়েছে কি না জানি না। তবে চুক্তিটি আমরা যাচাই করে দেখতে পারি।
প্রথম আলো: কোনো কারণে যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়, সে ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী হবে? আপনারা কি নির্বাচনে যাবেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তবে কোনো না কোনো কারণ থাকবে। বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া না-যাওয়ার সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তি বা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের কী দণ্ড হয়, তার সঙ্গে সম্পর্কিত। বিএনপি যে সিদ্ধান্তই নিক, তারা নিশ্চয়ই তা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলবে। পরিস্থিতির বাস্তবতা ও যৌক্তিকতা বিবেচনা করেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব।
প্রথম আলো: নির্বাচনে গিয়ে আপনারা কি বিরোধী দলের আসনে বসতে প্রস্তুত?
মাহমুদুর রহমান মান্না: সরকারের অন্যায়-অবিচার, স্বেচ্ছাচারিতা, গুম-খুন ও দুঃশাসন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যাংক লুট থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে যে মাত্রায় লুটপাট হয়েছে, তাতে এই সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার আর সুযোগ রেখেছে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে যদি আপনারা নির্বাচনে যান, তবে কি ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করবেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: সমঝোতা হলে আসন ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন হবে। আমরা ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করব না।
প্রথম আলো: বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে গিয়ে যদি আপনারা বিজয়ী হন, তাহলে সেই জোট বা সরকারে নেতৃত্ব দেবেন কে?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আমরা যৌথ নেতৃত্বে বিশ্বাস করি। তবে এই যৌথ নেতৃত্বের মধ্যেও ব্যক্তিত্বের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, ডা. বি. চৌধুরী বা ড. কামাল হোসেন—যে কেউ নেতৃত্ব দিতে পারেন।
প্রথম আলো: ডা. বি. চৌধুরী তো বলেই দিয়েছেন যে তিনি নির্বাচন করবেন না আর কোনো পদও নেবেন না।
মাহমুদুর রহমান মান্না: এসব বিষয় নিয়ে আসলে এখনো চূড়ান্ত কিছু ঠিক হয়নি। যে-ই হোক, আমরা সবাই মিলে ধরলে নিশ্চয়ই তাঁদের কেউ না কেউ দায়িত্ব নিতে রাজি হবেন। আর যদি তা না হয়, তবে আমরা যাঁরা আছি, তাঁরা সবাই মিলে ঠিক করব কে নেতৃত্ব দেবেন।
প্রথম আলো: আপনারা ক্ষমতায় যেতে চাইছেন, দেশ পরিচালনা করতে চাইছেন, আপনাদের প্রস্তুতি কী? ছায়া মন্ত্রিসভা ধরনের কিছু করেছেন কি? ক্ষমতায় গেলে কে কী দায়িত্ব পালন করবেন—এমন কোনো ভাবনা আছে কি?
মাহমুদুর রহমান মান্না: এখনই আমরা এমন কিছু দিতে পারছি না। আমরা আলাদা বা একদম এককভাবে নির্বাচন করব—এমন সম্ভাবনা কম। আবার আইনিভাবে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান নির্বাচন করতে পারবেন কি না, তা অনিশ্চিত। ফলে আমাদের মূল ফোকাস হচ্ছে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করা। ফলে এখন আমাদের সব চেষ্টা ঐক্যের দিকে।
প্রথম আলো: বাম দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য করার কোনো ভাবনা আছে কি?
মাহমুদুর রহমান মান্না: এখন আর নেই। আমরা আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের বৃহত্তর ঐক্যের ধারণায় বিশ্বাস করে না। সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনে বাম দলগুলো অংশ নিয়েছিল—এভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা ভালো কিছু করতে পারেনি।
প্রথম আলো: হঠাৎ করে নির্বাচনে ইভিএম প্রচলনের যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে, তাকে কীভাবে দেখছেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: নির্বাচনে কারচুপির যতগুলো পথ আছে, তা সরকার এরই মধ্যে ব্যবহার করেছে। এরপরও আমরা দেখলাম যে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তারা জিততে পারেনি। জাতীয় নির্বাচন দেশের ৩০০ আসনে অনুষ্ঠিত হবে। এতগুলো আসনে একসঙ্গে কারচুপি করা কঠিন হবে, তাই কিছু আসনে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করে আসনগুলো নিশ্চিত করতে চায়। কারণ, এই প্রযুক্তিকে হ্যাক করা সম্ভব। এমনভাবে সাজানো সম্ভব, যে মার্কায়ই ভোট দেওয়া হোক, তিনটি নৌকায় পড়বে আর একটি ধানের শীষে। এভাবে তারা শ খানেক আসন নিশ্চিত করতে চায় আর বাকি ৭০-৮০টি আসন সাধারণভাবে জিততে চায়।