ক্রাইমবার্তা ডেক্স রিপোর্টঃ সিরিয়া ইস্যুতে বৈঠক করতে ইরানে যাচ্ছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। সিরিয়া সংকট সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার জন্য তিন নেতার মধ্যে ৭ সেপ্টেম্বর ইরানে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ডেইলি সাবাহ।
সিরিয়া যুদ্ধের সাড়ে সাত বছরের মধ্যে বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইদলিব শহরের সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য এই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈঠকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আলোচনা হবে।
এর আগে তিন প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার সোচি শহরে এবং তুরস্কের রাজধানী আংকারায় বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠক থেকে তিন প্রেসিডেন্ট সিরিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এছাড়া, সিরিয়ায় টেকসই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার বিষয়েও তিন নেতা অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
গত বছরের ২২ নভেম্বর রাশিয়ার সোচি শহরে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট রুহানি সিরিয়া ও ইরাকে উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশের পরাজয়ের প্রশংসা করেন তবে সিরিয়ায় সম্পূর্ণভাবে এ গোষ্ঠীর পতন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রাখার কথা বলেন।
এছাড়া চলতি বছর এপ্রিলে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় এই তিন নেতা বৈঠকে মিলিত হন।
আর তেহরানে এমন সময় বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন যখন ৩৫ লাখ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ইদলিবে সিরিয়ার সরকার ( আসাদ বাহিনী) হামলার সর্বাত্মক প্রুস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে সেখানে ৬ দফা রাশিয়ান বিমান হামলা হয়েছে। ২০ বেসমারিক নাগরিক মারা গেছেন। সিরিয়ার অন্যান্য শহরের ভয়াবহতা দেখে ভীত-সন্ত্রস্থ বেসামরিক জনগন ইদলিবে পালিয়ে এসেছেন।
বিভিন্ন সূত্রগুলো জানাচ্ছে যে, ইরানে উত্তরাঞ্চলের তাবরেজ শহরে তিন নেতার শীর্ষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ৩১ আগস্ট বলেছেন, ইরান তেহরানে বৈঠকের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এএফপি।
ইরান এবং রাশিয়ার সরকার ইদলিবে বহিরাগত চরমপন্থী গ্রুপের উপর সিরীয় সরকারের হামলাকে সমর্থন দিয়েছেন, তুরস্ক এখনো দরকষাকষি করছে যেন আলেপ্পোর মতো ভয়াবহতা বন্ধ হয় যাতে অন্য প্রদেশ থেকে আসা ও বেসামরিক নাগরিকদের হতাহত কম হয়।
তিন নেতা পর্দার অন্তরালে ইদলিবের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যাপারে কাজ করে যাবে। যা বিদ্রোহীদের সর্বশেষ শক্ত ও বড় ঘাটি। সেখানে বিদ্রোহী চরমপন্থী গ্রুপের উপর হামলা চালাতে গিয়ে যেন বেসামরিক মানুষদের হত্যা করা না হয়। আর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহযোগিতা ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের উপর জোর দেয়া উচিত বলে মনে করেন।
ইমাম জাফর সাদেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইরানের তিনবারের সংসদ সদস্য ড.গোলাম মির্জা মিসবাহ মোগাদম ডেইলি সাবাহের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রুহানি, এরদোগান এবং পুতিন সিরিয়ার রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা করবেন। এছাড়া তারা অর্থনীতি সম্পর্কিত বিষয়াদি, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক একতরফাভাবে এই তিন দেশের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কিভাবে মোকাবেলা করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা করবেন।
সিরিয়ার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও ঐক্য সমুন্নত রাখতে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
এরদোগান ও রুহানির মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উভয় দেশের অর্থনৈতিক বিষয়াদি গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিবে। গত অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সফরের সময় দুই নেতা ত্রিশ বিলিয়ন বাণিজ্যের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। যা বর্তমানে দশ বিলিয়নে সীমাবদ্ধ আছে। এছাড়া নিজ দেশের মুদ্রাকে বাণিজ্যিক লেনদেনে ব্যবহারের বিষয়ে ও দুই নেতা আলোচনা করবেন।
ড. মোগাদাম জোর দিয়েছেন যে, ইরান ও তুরস্ক উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজ দেশের জাতীয় মুদ্রাকে আরো বেশি গুরুত্ব দিবে।
শীর্ষ বৈঠকটি এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন তিনটি দেশই তাদের জাতীয় মুদ্রা নিয়ে সংকটে আছে। তুরস্ক, রাশিয়া এবং ইরানের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাপ সৃদষ্টি করার কারণে সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়েছে।
তুরস্কের মুদ্রা লিরা এ বছরের প্রথম দিকের হিসেবে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৪৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে। আর অধিকাংশ দরপতন হয়েছে গত মাসে উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের সময়।
আর ইরানি রিয়াল ও মার্কিন মুদ্রার বিপরীতে অর্ধেকেরও বেশি দরপতন বা মূল্যহ্রাস হয়েছে।
নিজ দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়নের বিষয়টি মোকাবেলায় তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়া একসাথে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ডলারের মোকাবেলায় এই দেশগুলো তাদের মধ্যকার জ্বালানি বাণিজ্যে ও সাধারণ বাণিজ্যে তাদের জাতীয় মুদ্রাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গণনা করবে বলে তিন দেশের সরকারি সূত্রগুলো আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। আর এটাই সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে পরিণত হয়েছে।
এপ্রিলে তুরস্ক ও ইরান পরস্পর লেটার অব ক্রেডিট ইস্যু করেছে। উভয় দেশই বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ইরানিয়ান রিয়াল ও তুরস্কের লিরা গ্রহণ করবে। এতে উভয় দেশের বাণিজ্য, বিনিময় ব্যবস্থা সহজ হবে। উভয় দেশের মুদ্রার অব্যাহত অবমূল্যায়নের বিপরীতে নিম্ন বৈদেশিক মুদ্রা ঝুঁকি হ্রাস করবে। আর এখানে ডলার বা ইউরোর মতো তৃতীয় কোন মুদ্রার ভূমিকা থাকবে না।
ড. মোগাদাম তুরস্ক ও ইরানের অর্থনীতির সার্বিক একটি চিত্র তুলে ধরে বলেন, ইরানের জ্বালানি সম্পদ তুরস্কের অর্থনীতিকে সচল রাখবে আর ইরানের ব্যবসা-বাণিজ্য তুরস্কের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধি হবে।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত থাকা এই অঞ্চলের জন্য
ড.মোগহাদামের পরামর্শ হল, তুরস্ক ও ইরানের উচিত এই অঞ্চলের উপলভ্য সম্পদগুলির মূলধনকে সংহতির মাধ্যমে সচল রাখা। ১৬০ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর এই দেশ দুটির রয়েছে বিশাল মানব সম্পদ।
তিনি বলেন, বৃহত্তর অঞ্চলে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সংগঠনকে উন্মোচন করার সম্ভাব্যতা নিরসনে সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষার অভাব রয়েছে।
প্রবল ইচ্ছা ও সহযোগিতার পরিকল্পনা তুরস্ক, ইরান ও এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও আর্থিক সমস্যা উপশম করতে সহায়তা করবে।
তুরস্ক, ইরান এবং পাকিস্তান ১৯৮৫ সালে অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা ( ইসিও) প্রতিষ্ঠা করেন। যাতে এই অঞ্চলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একক পণ্য ও সেবার বাজার গড়ে উঠে। মোগাহাদাম উল্লেখ করেন যে, পরবর্তীতে এই জোটে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো যোগ দেয়। বর্তমানে এই জোটে দশটি সদস্য দেশ রয়েছে। আফগানিস্তান, আজারবাইজান, কাজাখাস্তান, কিরগিজিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান পরবর্তীতে এই জোটে যোগ দেয়।
১৯৯৬ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যকার সহযোগিতার জন্য ডি-৮ নামে আরেকটি জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিশর, নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এই জোটের সদস্য। আর এই জোট গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন প্রফেসর নেকমিথিন এরবাকান যিনি পরবর্তীতে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ড. মোগহাদাম এই জোটটিকে সক্রিয় করার উপর জোর দেন। যাতে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রি ব্যবসা-বাণিজ্য করা যায়।
তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়া যৌথভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করবে।
তেহরান সামিটে তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়া বিরুদ্ধে একতরফাভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলার বিষয়টি আলোচনা করা হবে। লক্ষ্যবস্তু ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা এবং পণ্য বাণিজ্য, এইভাবে তাদের অর্থনীতি লক্ষ্য অর্জন করবে।
ইরান-চীন চেম্বারস অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আসাদুল্লাহ আসগারলাদি বলেন, তেহরান সামিটে তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়া যৌথভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলার পাশাপাশি সিরিয়া বিষয়ে ঐক্যমতে পৌছাবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ইরান ১৯৭৯ সাল থেকে ৪০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে। ১৯৮৪ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ বুশ ২০০২ সালে, বারাক ওবামা ২০১২ সালে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বর্তমানে ক্ষমতাসীন। তারা প্রত্যেকেই ইরানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখেন।
তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
৮ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, তিনি ইরানের সাথে পাঁচ বিশ্ব শক্তি ও জার্মানির করা পারমাণবিক চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিবেন।
১ আগস্ট, মার্কিন প্রশাসন তুর্কি সরকারের দুই কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরেপ করেন। জারি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সোয়লু এবং বিচারমন্ত্রী আবদুল্লমৎ গুয়েল উপর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা যুক্তরাষ্ট্রের যাজক আন্দ্রে ব্রুনসনকে গ্রেফতার করেন। যিনি তুরস্কে গৃহবন্দী হয়ে আছেন।
আঙ্কারার দৃষ্টিতে তিনি দুটি জঙ্গি গ্রুপের হয়ে কাজ করেন। এ দুটি গ্রুপ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা ফেতহুল্লাহ গুলেনের দল ও কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি। তবে ইজমির শহরের একটি প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জার প্রধান ব্রুনসন এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার ৩৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। ১২ অক্টোবর তার মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
এ মামলা নিয়ে এখন ন্যাটোর দুই মিত্র আঙ্কারা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের বিচার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও বলেছেন, তিনি আশা করছেন এ নিষেধাজ্ঞার ফলে তুরস্ক বুঝবে আমরা ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।
অন্যদিকে ট্রাম্প তুরস্ক থেকে আমদানিকৃত স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর ৫০ ও ২০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করেন। আর এর মাধ্যমে তুরস্কের মুদ্রা ও অর্থনীতিকে দুর্বল করার টার্গেট করা হয়েছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সাবেক গুপ্তচর সার্গেই ও ইউলিয়া স্কেপেইলকে হত্যা চেষ্টায় রাশিয়ার সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেন। এছাড়া বিভিন্নভাবে রাশিয়ার অর্থনীতিকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।