ক্রাইমবার্তা রিপোর্ট: জালিয়াত চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মূল্যবান সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন মন্ত্রীপত্নী * জুলুমবাজির হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ফকিরের সেই আকুতি এখনও উদ্বেলিত করে নেতাকর্মীদের
ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফের হাত থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতাও রক্ষা পাননি। জালিয়াত চক্রের সঙ্গে আঁতাত করে বিতর্কিত মন্ত্রীপত্নী ঈশ্বরদীতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ও মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত ফকির মো. নুরুল ইসলামের মূল্যবান জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন।
যিনি ছিলেন এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ কর্মী। এভাবে ভূমিমন্ত্রীর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ও ভাতিজার নামেও প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতার জমি রেজিস্ট্রি করে নেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। চরম এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেন নুরুল ফকির। কিন্তু তিনি মামলার ফলাফল দেখে যেতে পারেননি।
প্রভাবশালী মন্ত্রী পরিবারসহ জালিয়াত চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি মামলা ৯ বছর ধরে বিচারাধীন। ২০০৯ সালে পাবনায় দলীয় কর্মী সভায় তৎকালীন সংসদ সদস্য ও বর্তমানে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর বিরুদ্ধে দেয়া একটি লিখিত বক্তব্য অনুসন্ধান করতে ভয়াবহ জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর এই তথ্য পাওয়া যায়।
জানা যায়, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত ফকির মো. নুরুল ইসলাম ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সহায়তায় গঠিত ঈশ্বরদী পৌরসভার প্রথম পৌর প্রশাসকও ছিলেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে শামসুর রহমান শরীফের বিরুদ্ধে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখলের অভিযোগ উত্থাপন করেন এই বর্ষীয়ান নেতা।
শুধু তাই নয়, তৃণমূল আওয়ামী লীগের ওই কর্মী সভায় এলাকার নিরীহ মানুষকে জালিয়াত চক্রের হাত থেকে বাঁচানোর দাবিও জানিয়েছিলেন তিনি। জীবনের শেষ কর্মী সভায় জাল-জালিয়াত চক্রের যে তালিকা তিনি প্রকাশ করেছিলেন সেখানে ভূমিমন্ত্রীর স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফের নাম পাওয়া যায়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার পৈতৃক সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার সব চেষ্টাই করা হয়েছে।
জমি দখলের এই অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া যায় আরও একাধিক ঘটনা। শুধু নুরুল ফকিরের জমিই নয়, ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সভাপতি আকবর বিশ্বাসেরও প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তিও জবরদখল করে রেখেছেন শামসুর রহমান শরীফ। নিজের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে প্রতি মাসে তার পৈতৃক সম্পত্তিতে থাকা স্থাপনা থেকে ভাড়াও তুলে নেয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি ঈশ্বরদী-আটঘরিয়ায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে দেয়া বরাদ্দ লুটপাটের অভিযোগ প্রকাশ হয় যুগান্তরে। এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে পৈতৃক সম্পত্তি দখলের অভিযোগ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কামরুন্নাহার শরীফ বলেন, ‘আপনার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।’ এরপর মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরবর্তী সময়ে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।
২০০৯ সালের ১২ ডিসেম্বর দলীয় কর্মী সভায় নুরুল ফকির যে লিখিত বক্তব্য দিয়েছিলেন তথ্যানুসন্ধানে তার একটি ফটোকপি পাওয়া যায়। দলীয় সরকারের আমলে ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে কিভাবে শামসুর রহমান শরীফ মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ফকিরের পৈতৃক সম্পত্তি দখল করে নেন তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায় এক পৃষ্ঠার ওই বক্তব্যে। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে নুরুল ফকিরের দুই ছেলেমেয়ে জয়ী হন ঠিকই। তবে দখল করতে গিয়ে তারা শামসুর রহমান শরীফের ক্ষমতার কাছে বারবার হেরে গেছেন। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতা।
নুরুল ফকির জীবনের শেষ কর্মী সভায় দেয়া লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সৈনিক হিসেবে তার অতি কাছের মানুষ ছিলাম। মূল্যায়নও করতেন। ছোট ভাই হিসেবে ভুল-ত্র“টিতে আদর-শাসনও করতেন। তার অতি আদরের অকুতোভয় কন্যা বাংলাদেশকে কালিমামুক্ত করার সিপাহশালার শেখ হাসিনা দিনবদলের আশার বাণী শুনিয়ে একঝাঁক ত্যাগী বীরকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বরত আছেন।
বয়সের কারণে মনের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দিনবদলের কাজে নিজেকে সক্রিয় করতে পারছি না। সবার জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করা ছাড়া কোনো শক্তি নাই।’ এরপরই বক্তব্যে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন নুরুল ফকির। তিনি বলেন, ‘বিগত সাত বছর জমি দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, জুলুমবাজিসহ এমন কোনো অন্যায় কাজ নেই যা দেশবাসী দেখেনি। সেসব জুলুমবাজের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্যই দেশবাসী ’৭০ সালের নির্বাচনের মতো শেখ হাসিনাকে ম্যান্ডেট দিয়েছে দিনবদলের আশায়।
আজও যদি সেসব অত্যাচারের পুনরাবৃত্তি দেখি তবে মনটা ছোট হয়ে যায়। আজ এই বৃদ্ধ বয়সে নিজের অত্যাচারিত হওয়ার একটি উদাহরণ দিয়ে বিদায় নিব।’ পিতা তফিজ উদ্দিনের পরিচয় তুলে ধরে নুরুল ফকির এ বিষয়ে বলেন, ‘তিনি (তফিজ উদ্দিন) রেলওয়েতে চাকরিকালীন সময়ে ১৯৩৬ সালের ২৯ এপ্রিল রেজিস্ট্রি কবলামূলে ১৮ একর ৯৯ শতক জমি কিনেন।
এই জমি ভোগদখল থাকাবস্থায় কিছু ভূমি ঈশ্বরদী কৃষি ফার্ম, ঈশ্বরদী ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী রেশম বোর্ডসহ রাস্তার জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণ করা ছাড়া বাকি জমি আরএস রেকর্ডে যথাযথভাবে রেকর্ড হয়। পিতার মৃত্যুর পর ওয়ারিশ হিসেবে আমরা দুই ভাইবোন এই সম্পত্তি ভোগদখল করতে থাকি। এরপর হঠাৎ জালাল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি জনৈক ভুয়া মহিলার কাছ থেকে নকল আমমোক্তারনামাবলে ওই সম্পত্তির অর্ধেক পত্তন দিয়েছেন বলে দাবি করেন।’
তিনি বলেন, ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছি যে, বর্তমান দিনবদলের সময়েও নিজের পৈতৃক সম্পত্তির অংশ এভাবে জালিয়াতি হবে তা মানতে পারছি না। ওই জালাল উদ্দিন ভূমি রেজিস্ট্রির সব নিয়ম-কানুন উপেক্ষা ও সাবরেজিস্ট্রারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই কামরুন্নাহার শরীফ (ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের স্ত্রী), তরিকুল ইসলাম, আবদুস ছালাম খান এবং ওই একই বছরের ৩০ জুলাই খায়রুল কবির লিটন ও জমিরন নেছার নামে রেজিস্ট্রি দলিল হয়। যার কারণে আমি নিগৃহীত হওয়ার পথে। এই যদি দিনবদলের নমুনা হয় তাহলে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী কাদের নিয়ে দিনবদল করবেন? আপনাদের কাছে আকুল আবেদন, এসব জালিয়াত চক্রকে চিহ্নিত করুন। এ দেশের মানুষকে এসব দস্যুর হাত থেকে বাঁচান।’
নুরুল ফকিরের লিখিত বক্তব্যে উল্লেখিত তথ্য তালাশ করতে গিয়ে জমি জালিয়াতির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। ঈশ্বরদীর একটি শক্তিশালী জমি জালিয়াত চক্র এভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এই চক্রটি আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা প্রয়াত নুরুল ফকিরের পৈতৃক সম্পত্তি হাতিয়ে নিতেও জালিয়াতির আশ্রয় নেয়।
প্রতারণার ভয়াবহ তথ্য : সরেজমিন ঈশ্বরদীতে গিয়ে দেখা যায়, পৌর এলাকার আলীবর্দী খাঁ সড়কে সুরম্য বাড়ি করেছেন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। তার বাড়িসংলগ্ন উত্তর পাশে অরনখোলা মৌজায় আরএস রেকর্ড অনুযায়ী নুরুল ফকিরের পিতা তফিজ উদ্দিনের নামে ১৪২৪নং দাগে ৬৭ শতাংশ জমির একটি প্লট আছে।
২০০৯ সালে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ, ছোট ভাই লক্ষীকুণ্ডা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান শরীফের স্ত্রী রুবিনা ইয়াসমিন, ছেলে আশিকুর রহমান শরীফের নামে তিনটি দলিলে ৪৫ শতক জমি রেজিস্টি দলিল পাওয়া যায়।
জমির মালিকানা হিসেবে আরএস রেকর্ড অনুযায়ী তফিজ উদ্দিনের ওয়ারিশ নুরুল ফকির ও তার ছেলেমেয়েরা এ জমি বিক্রি করার কথা। কিন্তু ঈশ্বরদী সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ভূমিমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পন্ন হওয়া জমি বিক্রির তিনটি দলিলের বিক্রেতা ভিন্ন।
রেকর্ডপত্রে দেখা গেছে, ১৯৯৯ সালের ৪ এপ্রিল জালাল উদ্দিন নামে এক প্রতারক ঈশ্বরদী সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ১৪৫৭নং দলিলে তৎকালীন সংসদ সদস্য ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের ভাতিজা আশিকুর রহমান শরীফকে একই দাগ থেকে মূল্যবান এই জমি ১ লাখ টাকায় ২০ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে দেন। ওই একই বছরের ৭ এপ্রিল অর্থাৎ তিন দিন পর ১৫৬৪নং দলিলে ভূমিমন্ত্রীর ছোট ভাই আনিসুর রহমান শরীফের স্ত্রী রুবিনা ইয়াসমিনের কাছে ৫০ হাজার টাকায় ১৫ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে দেন জনৈক মাহাবুব আলম।
এই মাহাবুব আলমের ঠিকানা ঈশ্বরদীর পৌর এলাকার পূর্ব টেংরি গ্রাম দেয়া হলেও বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই ৩৩২২নং দলিলে কামরুন্নাহার শরীফ ওই একই দাগে ১০ শতক জমির মালিক হন।
তাকে রেজিস্ট্রি করে দেন জালাল উদ্দিন। প্রায় ১০ বছর পর জালাল উদ্দিন ভূমিমন্ত্রীর স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফের কাছ থেকে ১০ শতক জমির মূল্য নেন ৫০ হাজার টাকা। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই দাগে প্রতি শতক জমির মূল্য অন্তত ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। কামরুন্নাহার শরীফের নামে যে দলিল রেজিস্ট্রি হয় তাতে তার পিতার নাম উল্লেখ রয়েছে গোবিন্দ কুমার মজুমদার, আর স্বামীর নাম হিসেবে শামসুর রহমান শরীফের নাম রয়েছে।
হিন্দু ও মুসলিম নামের তথ্য তালাশ করতে গিয়ে জানা যায়, কামরুন্নাহার শরীফ পিতৃকুল থেকে পালিয়ে এসে শামসুর রহমান শরীফকে বিয়ে করেন। মৃত গোবিন্দ কুমার পাকশি রেলওয়ে গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
এদিকে শুধু ভূমিমন্ত্রীর পরিবারই নয়, নুরুল ফকিরের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি কামরুন্নাহার শরীফের সঙ্গে একই সময়ে হওয়া আরও কয়েকজনের নামে দলিল পাওয়া যায়। ঈশ্বরদীতে তারা জমি প্রতারক হিসেবে পরিচিত।
এর মধ্যে ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল ৩৩২৩নং দলিলে নকশাল পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচিত সালাম খান ১৪২৪নং দাগ থেকেই ৯ শতক জমি রেজিস্ট্রি করেন। এই ৯ শতকের দামও নেয়া হয় ৫০ হাজার টাকা।
২০০৯ সালের একইদিন ৩৩২৪নং দলিলে শেরশাহ রোডে অন্য আরেকটি দাগ থেকে সাবেক যুবলীগ নেতা খায়রুল কবির লিটন ৫ শতক জমি কিনে নেন মাত্র ৩০ হাজার টাকায়। অথচ শেরশাহ রোডই হচ্ছে ঈশ্বরদীর অভিজাত এলাকা।
যেখানে প্রতি শতক জমির দাম অন্তত ২০ লাখ টাকা। ৩৩২৫নং দলিলে ঈশ্বরদীর জালিয়াতির গডফাদার হিসেবে পরিচিত জালাল উদ্দিন তার স্ত্রী জামিরুন নেসার নামে আলোচিত ১৪২৪নং দাগে ১১ শতকসহ তিনটি দাগে মোট সাড়ে ৩৬ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে নেন। এই সাড়ে ৩৬ শতক জমির দাম দেখানো হয় ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। জমি জালিয়াত চক্রের আরেক গডফাদার তৈয়ব আলী ভূমিমন্ত্রীর বাড়ির প্লট অর্থাৎ ১৪২৪নং দাগ থেকে ৯ শতকসহ ১১টি দাগ থেকে ৩ একর সাড়ে ৭৬ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে নেয়।
তরিকুল ইসলাম নামে আরেক প্রতারক জালিয়াত চক্রের মূল হোতা তৈয়ব আলীকে সঙ্গে নিয়ে ১৪২৪নং দাগ থেকে ২৮ শতকসহ ৬টি দাগ থেকে আরও ৩ একর ৩ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে নেয়। এরপর তৈয়ব আলী ও তরিকুল ইসলামের কাছ থেকে হাবিবুর রহমান হাবিব ও মুজিবুর রহমান ভেগল কিছু জমি কিনে নেয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
রেকর্ডপত্রে ৬৭ শতক, দলিল হয় ১১৬ শতক : আরএস রেকর্ড অনুযায়ী ভূমিমন্ত্রীর বাড়ির পাশের ১৪২৪নং দাগে জমির পরিমাণ ৬৭ শতক। অথচ তৎকালীন সাবরেজিস্ট্রারের সহায়তায় জালিয়াত চক্র বিভিন্ন নামে ১১৬ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে নেয়। এসব সন্দেহজনক দলিল যখন রেজিস্ট্রি হয় তখন ঈশ্বরদীর সাবরেজিস্ট্রার ছিলেন নজরুল ইসলাম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই ছিল তার চাকরি জীবনের শেষ কর্মদিবস। এই সন্দেহজনক দলিলগুলো রেজিস্ট্রি করতে তিনি ওই দিনটিকেই বেছে নেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে একজন দলিল লেখক যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতিবাজ সাবরেজিস্ট্রার হিসেবে পরিচিত নজরুল ইসলাম বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। এরপর কামরুন্নাহার শরীফসহ ৫ জালিয়াতের নামে ৮১ শতক জমি নামজারিও হয়ে যায়। ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদীর এসি ল্যান্ডের দায়িত্ব থাকাবস্থায় এই নামজারি সম্পন্ন করেন শামীম আহমেদ। বর্তমানে তার অবস্থান কোথায় তা জানা যায়নি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- এই শামীম আহমেদের হাত ধরেই ওই সময় জমি জালিয়াত চক্র ঈশ্বরদীতে স্বর্ণযুগ অতিক্রম করে। ওই একই সময় ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (তহশিলদার) আরিফুল ইসলাম বিতর্কিত দলিল গ্রাহকদের নামে নামজারি সম্পন্ন করতে প্রতিবেদন দেন। বর্তমানে এই তহশিলদার কর্মরত আছেন পাবনার ডাপুনিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে।
জানতে চাইলে আরিফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে, তৎকালীন এডিসির একটি নির্দেশনা অনুযায়ী ওই জমি নামজারি করার সুপারিশ করা হয়। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দেখেন সরাসরি বস যখন কোনো আদেশ দেন তখন সেটি পালন করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প থাকে না।’
এদিকে এই নামজারি আদেশের পর সন্দেহজনক দলিলগুলো বাতিলের মামলা করেন নুরুল ফকিরের ওয়ারিশরা। আর দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গত ৫ মার্চ বিতর্কিত সেই নামজারি আদেশ বাতিল করে সমুদয় সম্পত্তি মূল আরএস খতিয়ানভুক্ত (নুরুল ফকিরের পিতার নামে) করার আদেশ দেন ঈশ্বরদীর সম্প্রতি বিদায়ী এসি ল্যান্ড মো. শিমুল আকতার। তবে এখনও ওই দলিল বাতিলের মামলাটি বিচারাধীন আছে।
এদিকে এসব সন্দেহজনক দলিল কীভাবে সম্পন্ন হয় তা জানতে যোগাযোগ করা হয় তৎকালীন সাবরেজিস্ট্রার বর্তমানে অবসরে থাকা নজরুল ইসলামের সঙ্গে। ৬৭ শতক জমির স্থানে ১১৬ শতক জমি দফায় দফায় কীভাবে রেজিস্ট্রি হল জানতে চাইলে যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘ঈশ্বরদী খুব খারাপ জায়গা। তবে যতদূর মনে পড়ে নিয়মকানুন মেনেই রেজিস্ট্রি করে দিয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে এ কাজ করিনি।’
সখিনা সমাচার : দলিল দস্তাবেজে দেখা গেছে, নুরুল ফকিরের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির অধিকাংশই বিক্রি করেছেন সখিনা খাতুনের পক্ষে আমমোক্তার (জমি বিক্রির ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি) জালাল উদ্দিন। এই সখিনা খাতুন সম্পর্কে তথ্য তালাশ করতে গিয়ে জানা যায়, আরও ভয়াবহ তথ্য। নুরুল ফকিরের পিতা তফিজ উদ্দিন জমি কিনেছেন ডিএস রেকর্ডের মালিক শ্রী নিবাস চক্রবর্তী ও তার ভাতিজা রাধারমন চক্রবর্তী এবং বসন্ত কুমার চক্রবর্তীর কাছ থেকে।
১৯৩৬ সালে তফিজ উদ্দিনের কাছে সব সম্পত্তি বিক্রি করে এই পরিবার ভারতে চলে যায়। রেজিস্ট্রি দলিল মূলে এই জমি বিক্রি হওয়ার পর ১৯৬২ সালে এসএ রেকর্ড অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বিপুল এই সম্পত্তি ক্রেতা তফিজ উদ্দিনের নামে এসএ রেকর্ড হয়নি। সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয় তফিজ উদ্দিনের বৈমাত্রেয় বড় ভাই মজির উদ্দিন, আপন বড় ভাই মফিজ উদ্দিন ও কফিল উদ্দিনের নাম।
কিন্তু সবার ছোট ভাই তফিজ উদ্দিনের নাম এসএ রেকর্ডে না থাকলেও সখিনা খাতুন নামে একজনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তফিজ উদ্দিনের কাছ থেকে পত্তন (জমিদারকে টাকা দিয়ে জমির স্বত্ব নেয়া) নেয়ার কথা বলে সখিনা খাতুন এই সম্পত্তির দাবি নিয়ে সামনে আসেন। কিন্তু তফিজ উদ্দিন জমিদার ছিলেন না। তিনি নিবাস চক্রবর্তী গংয়ের কাছ থেকে রেজিস্ট্রি মূলে কিনেছেন। শ্রী নিবাশ চক্রবর্তী গং রাজা প্রমদানাথ রায় বাহাদুরের কাছ থেকে পত্তন সূত্রে জমির মালিক হয়েছিলেন।
১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সংসদ সদস্য ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের স্ত্রী, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ও ভাতিজাসহ বিভিন্ন নামে ধারাবাহিকভাবে রেজিস্ট্রি দলিল সম্পন্ন শুরু হলে সখিনা খাতুনের পত্তন সংক্রান্ত সন্দেহজনক নথিপত্র নুরুল ফকিরের সামনে প্রকাশ পায়। ওই নথিপত্রে সখিনার ঈশ্বরদীর কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি।
সাবরেজিস্ট্রি অফিসে পত্তন নেয়ার রসিদপত্রও জমা দেয়া হয়। সেখানে সখিনা খাতুন মোহাম্মদ সিদ্দিককে স্বামী পরিচয় দিয়ে ঢাকার সূত্রাপুরের যোগীনগর লেনের ২২নং বাড়ির ঠিকানার বাসিন্দা হিসেবে তৎকালীন ওয়ার্ড কমিশনার কাজী আবুল বাশার স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্র জমা দেন। খবর পেয়ে নুরুল ফকিরসহ তার ছেলেমেয়েরা সূত্রাপুরের ঠিকানায় এসে সখিনা খাতুনকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে সখিনার কোনো অস্তিত্ব তারা পাননি।
একপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা। তখন ওয়ার্ড কমিশনার সখিনা খাতুনের নামে যে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে জমি রেজিস্ট্রি দেয়া হয় তা বাতিল করে সংশোধন করে দেন। এ পর্যায়ে ওয়ার্ড কমিশনার নিজে যোগীনগর লেনের ঠিকানা যাচাই করে ২০১০ সালের ১০ মার্চ প্রত্যয়নপত্রে বলেন, ‘আমার জানামতে সখিনা খাতুন ১৯৭৫ইং সাল থেকে পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত ভোটার তালিকায়ও তার নাম নেই।’
এদিকে ওয়ার্ড কমিশনারের এ তথ্য প্রকাশের পর পাওয়া যায় সখিনা খাতুনের নামে নেয়া একটি আমমোক্তারনামা। ১৯৮৫ সালের ৬ আগস্ট স্বাক্ষরিত আমমোক্তারনামা নিয়ে জালাল উদ্দিন একের পর এক জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে থাকেন। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এই জালাল উদ্দিনই ঈশ্বরদীতে জমি জালিয়াত চক্রের হোতা হিসেবে পরিচিত। ভূমিমন্ত্রীর স্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যসহ কয়েকজনকে আমমোক্তারনামা ক্ষমতাবলেই জালাল উদ্দিন নুরুল ফকিরের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ফকির মো. নুরুল ইসলামের ছেলে রুহুল ইসলাম (স্বপন ফকির) যুগান্তরকে বলেন, ঈশ্বরদীর একটি চিহ্নিত জালিয়াত চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কামরুন্নাহার শরীফ আমাদের মূল্যবান জমি রেজিস্ট্রি করে নেন।
তিনি বলেন, এলাকায় জমি জালিয়াত চক্রের হোতা হিসেবে পরিচিত তৈয়ব আলী, আবদুস সালাম খান, জমিরন নেছা, তরিকুল ইসলাম ভাদু, হাবিবুর রহমান হাবিব, মজিবর রহমান ভেগল ও খাইরুল কবির লিটনের নামেও রেজিস্ট্রি দলিল পাওয়া যায়। জালিয়াত চক্র নিজেদের প্রভাব বিস্তারের অংশ হিসেবে তৎকালীন সংসদ সদস্য ও বর্তমানে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের স্ত্রীর নামে ফাঁকা প্লটটি রেজিস্ট্রি করে দেয়। ভূমি অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সহায়তায় এরা এলাকার সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে।
স্বপন আরও বলেন, জালিয়াত চক্রটি শুধু রেজিস্ট্রি দলিল করেই ক্ষান্ত ছিল না, তারা পদে পদে কামরুন্নাহার শরীফকে সামনে নিয়ে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের নামে নামজারিও সম্পন্ন করে ফেলে, যা বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, দলিল বাতিলের মামলাটির বিষয়ে আমি ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি। আর যে এসি ল্যান্ড ও ভূমি সহকারী কর্মকর্তার (তহশিলদার) সুপারিশে এই জমি নামজারি করে প্রায় ১০ বছর আমাদের হয়রানি করা হয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। যুগান্তর