ক্রাইমবার্তা ডেস্করির্পোটঃ
নূরুল ইসলাম ম্যাইগা, পিতা :মৃত ওহাব আলী। সাং :পশ্চিম হাজারীবাগ, ঢাকা। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানায় গত ৫ সেপ্টেম্বর দায়ের করা ১৩ নম্বর মামলার ৩১ নম্বর আসামি তিনি। পুলিশের করা এ মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ওই আসামিসহ আরও কয়েকজন ৫ সেপ্টেম্বর রাতে কামরাঙ্গীরচরে রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। তারা ইট-পাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করে এবং লাঠিসোটা দিয়ে মেরে পুলিশকে আহত করেছে।
পুরান ঢাকার চকবাজারের বাসিন্দা আবদুল আজিজুল্লাহ। গত ৫ সেপ্টেম্বর চকবাজার থানায় পুলিশের করা মামলার আসামি তিনি। অভিযোগ, অন্য আসামিদের সঙ্গে তিনি পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়েছেন। এমনকি ককটেলের বিস্ম্ফোরণও ঘটিয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন দু’জন পুলিশ। অথচ অনুসন্ধানে জানা গেছে, নূরুল ইসলাম মারা গেছেন গত ৩১ আগস্ট। স্বজনরা তাকে ওই দিনই আজিমপুরের পুরনো কবরস্থানে দাফন করেছেন। আর আজিজুল্লাহ মারা গেছেন ২০১৬ সালের মে মাসে। যদিও পুলিশের মামলার নথি অনুযায়ী, নূরুল ইসলাম মৃত্যুর পাঁচ দিনের মাথায় এবং আজিজুল্লাহ মৃত্যুর প্রায় আড়াই বছর পর পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছেন!
মামলার এজাহারে দলীয় পদবি না থাকলেও পুরো এজাহার আর অভিযোগ পড়ে দেখা গেছে, তারা দু’জনেই স্থানীয় বিএনপির নেতা ছিলেন। নূরুল ইসলাম কামরাঙ্গীরচর থানা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি এবং আজিজুল্লাহ চকবাজার থানা বিএনপির আহ্বায়ক।
শুধু এই দু’জন মৃত ব্যক্তিই নন; সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি থানায় পুলিশের করা মামলায় এমন অনেক ভুতুড়ে আসামির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কোনো কোনো মামলায় এমন ব্যক্তিদের নামও যুক্ত করা হয়েছে, যারা ঘটনার সময় বা অনেক আগে থেকেই বিদেশে আছেন। এমনকি সৌদি আরবে হজে গেলেও দেশের থানায় মামলার আসামি হচ্ছেন কেউ কেউ।
অবশ্য মৃত ব্যক্তির নামে মামলার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি সমকালকে বলেন, মৃত ব্যক্তির নামে মামলা হয় কেমন করে!
আইজিপি বলেন, মৃত ব্যক্তির নামে কেউ মামলা দিয়ে থাকলে তার দায়-দায়িত্ব বাদীই নেবেন। কারণ পুরো পুলিশ বিভাগ তো মামলার বাদী নয়। কেউ যদি এমন মামলা করে থাকে, তাহলে তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। মামলা করার কারণ জানতে চাওয়া হবে।
কামরাঙ্গীরচর থানায় করা মামলাটির বাদী সেখানকার উপপরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। তিনি এজাহারে উল্লেখ করেছেন, তিনি ৫ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৯টার দিকে দায়িত্ব পালনের সময় গোপনে জানতে পারেন, থানার ঝাউলাহাটি চৌরাস্তার সামনে বেআইনিভাবে একত্রিত হয়ে আসামিরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিচারিক আদালত স্থানান্তরের প্রতিবাদে রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। থানা এলাকায় বসবাসরত মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতির সৃষ্টি করেছে। রাত ৯টা ৫ মিনিটে সেখানে পৌঁছলে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত ১০ থেকে ১২ জন আসামি তাদের হাতে থাকা ইট-পাটকেল ও লাঠিসোটা পুলিশের দিকে হত্যার উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করে। এতে জখম হয় পুলিশরা। আসামিদের ধাওয়া দিলে তারা দুই থেকে তিনটি ককটেল নিক্ষেপ করে ও একটি ইজি বাইকে আগুন দিয়ে স্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে যায়।
এসআই মাহফুজুর রহমানের মামলার এজাহারে মৃত নূরুল ইসলাম ছাড়া আরও ৩১ আসামির নাম রয়েছে।
এজাহারে তিনজন সাক্ষীর নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের দু’জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সাক্ষী সমকালকে বলেন, তিনি একটি গাড়ি পুড়তে দেখেছেন। তবে কারা আগুন দিয়েছে, তা তিনি দেখেননি। তা তার জানাও নেই। লোকজন দেখে ঘটনাস্থলে দাঁড়ালে পুলিশ তার নাম জিজ্ঞেস করে এবং একটি কাগজে স্বাক্ষর নেয়। তিনি আসামিদের কাউকে চেনেন না। অপর এক সাক্ষী এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
থানার ওসি মো. শাহীন ফকির সমকালকে বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শুনে মামলার আসামি করতে হয়। এতে ভুল হতে পারে। নূরুল ইসলাম ম্যাইগা মারা গেছেন- তা তিনিও জানেন। এর পরও তার নাম কীভাবে এজাহারে গেল, তা তিনি খতিয়ে দেখবেন। আদালতে আবেদন করে এজাহার থেকে নামটি বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
তবে কামরাঙ্গীরচর থানা বিএনপি সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন দাবি করেছেন, নূরুল ইসলামের মৃত্যুর পরও তাকে পুরনো মামলায় গ্রেফতারের জন্য থানার ওসির নেতৃত্বে এক দল পুলিশ বাসায় অভিযান চালায়। তিনি মারা গেছেন শুনে পুলিশ চলে যায়। এর পরও তাকে নতুন মামলায় আসামি করা হয়েছে। মৃত একজনকে আসামি করার ঘটনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এটি মিথ্যা মামলা।
চকবাজার থানায় করা মামলার বাদী থানার উপপরিদর্শক কামাল উদ্দিন। তিনি এজাহারে অভিযোগ করেছেন, পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিচারকাজে প্রতিন্ধকতা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিএনপির নেতাকর্মীরা বেলা ১১টার দিকে বেচারাম দেউড়ি আজগরি মঞ্জিলের (কারাগারের অদূরে) সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এতে পুলিশ বাধা দিলে নেতাকর্মীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় তিনি (পুলিশের উপপরিদর্শক) সহ দু’জন আহত হন। পুলিশ হামলাকারীদের আটক করতে গেলে তারা পরপর দুটি ককটেলের বিস্ম্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। মামলায় বিএনপির ৩৭ নেতাকর্মীর নাম দিয়ে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে একজন আসামি প্রায় আড়াই বছর আগে মৃত আজিজুল্লাহ।
আজিজুল্লাহর স্বজনরা বলছেন, মামলার পর মৃত আসামিকে পুলিশ গ্রেফতারের জন্য খোঁজ নিতেও এসেছে। এটা আসলে পরিবারের সদস্যদের হয়রানির জন্যই করা হয়েছে।
এই মামলার আরেক আসামি বিএনপি সমর্থক আবদুল মান্নাফ ওরফে চাঁন মিয়া। পুলিশের ৫ সেপ্টেম্বরের মামলায় তাকে আসামি হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে স্বজনরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট তিনি হজে যান। মামলায় যে সময় ও তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে, ওই সময়ে তিনি সৌদিতেই অবস্থান করছিলেন।
৫ সেপ্টেম্বরের দুই দিন আগে চকবাজার থানাতেই বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করে পুলিশ। এতে অভিযোগ করা হয়, ১৪ আগস্ট রাতে বিএনপির মিছিল থেকে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। মামলায় বিএনপির ৩৯ জন নেতকর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৩১ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ৪ নম্বর আসামির নাম খতিবুর রহমান। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক। তার স্বজনরা বলেছেন, খতিবুর গত ১০ আগস্ট হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যান। অর্থাৎ এটি সুস্পষ্ট- ঘটনার সময় তিনি দেশে ছিলেন না অথচ পুলিশ মামলায় বলেছে, তিনি নাকি চকবাজারে মিছিল করেছেন।
মৃত ব্যক্তি ও বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিকে আসামি করার বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানার একটি মামলার বাদী উপপরিদর্শক কামাল উদ্দিন বলেন, তার জানা মতে, মৃত কোনো আসামি নেই। প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষীদের ভাষ্যমতেই আসামি করা হয়েছে। এজাহার নামীয় কোনো আসামি আগেই মৃত হলে তা তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তের সময়ে দেখবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুরাদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি জানা নেই তার। তবে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
ঢাকার বিভিন্ন থানা ছাড়াও কুমিল্লার মুরাদনগর, ফেনীর ছাগলনাইয়া এবং গাজীপুরের পৃথক দুটি থানায় পুলিশের করা মামলায় এমন ভুতুড়ে আসামির সন্ধান মিলেছে।
স্বজন ও বিএনপি দলীয় সূত্র বলছে, কুমিল্লার মুরাদনগরের আহাদ খলিফা থাকেন বাহরাইনে। গত বছরের অক্টোবরে তিনি সর্বশেষ দেশে এসেছিলেন। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি বাহরাইনে ফিরে যান তিনি। তবে গত ৮ সেপ্টেম্বর মুরাদনগর থানায় ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনার অভিযোগে পুলিশের দায়ের মামলায় ৩৩ আসামির মধ্যে তিনিও একজন!
গত ১ সেপ্টেম্বর ফেনীর ছাগলনাইয়া থানায় পুলিশ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ১৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আজাদ হোসেন। কিন্তু তিনি হজ পালনের জন্য ১৮ জুলাই হজে গিয়েছিলেন। ফিরেছেন ৪ সেপ্টেম্বর।
আজাদ হোসেন সৌদি আরবে অবস্থানের কাগজ দেখিয়ে বলেন, হজ শেষে দেশে ফিরে জানতে পারেন- তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে!
গত ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুর শহরে বিএনপির মিছিল থেকে গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে- এমন অভিযোগে পুলিশ জয়দেবপুর থানায় ১৪০ জনের নামে মামলা করে। এই মামলার ৩৪ নম্বর আসামি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম। তবে তার স্বজনরা জানিয়েছেন, ছেলের চিকিৎসার জন্য ওইদিন সকাল ৮টায় তিনি সিঙ্গাপুরে যান। অন্যদিকে মামলায় ঘটনার সময় দেখানো হয়েছে বেলা ১১টা।
একই জেলার শ্রীপুর থানায় গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে নাশকতার অভিযোগে বিএনপির ৪৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিস্ম্ফোরণ ও গাড়ি পোড়ানোর মামলা করে পুলিশ। ওই মামলার ১৭ নম্বর আসামি উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সিরাজ কাইয়া। কিন্তু তার স্বজনরা নিশ্চিত করেছেন- ঘটনার এক সপ্তাহ আগে থেকেই চিকিৎসার জন্য তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, বিএনপিকে দুর্বল করার জন্যই এ ধরনের ভুতুড়ে মামলা করা হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে সরকার বিএনপির সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করছে। তিনি বলেন, সরকার আতঙ্কিত হয়ে এমন ভুয়া ও গায়েবি মামলা দিয়ে দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।