ক্রাইমবার্তা ডেস্করির্পোটঃ
নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘হু ইজ আফ্রেইড অব শহিদুল আলম’ শিরোনামে এক উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। এই শহিদুল আলম বাংলাদেশি চিত্রসাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী। অনুমান করি, লেখকের এই প্রশ্ন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি। কিন্তু শহিদুল আলমকে কেন এত ভয়?
গত মাসের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশ শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আল-জাজিরা টিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহারের সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য, শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামলেও তাদের আন্দোলনের উৎস অন্যত্র। দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব ও নাগরিক অধিকারের ওপর অব্যাহত আক্রমণে জনজীবন বিপর্যস্ত। তারা এই বিপর্যস্ত অবস্থার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করছিল। অর্থাৎ নিরাপদ সড়কের দাবি আন্দোলনের ‘ট্রিগার’ হলেও মূল কারণ দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি।
অধ্যাপক স্পিভাক লিখেছেন, এ বছর অক্টোবর-ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। বাংলাদেশের শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের একটি দায়িত্ব নিজের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার গঠনমূলক সমালোচনা করা। কিন্তু বর্তমান সরকার শহিদুল আলমের মতো শ্রদ্ধেয় মানুষের সমালোচনায় প্রবল রকম ভীত। দেশের ভেতরে ও বাইরে তাঁর কথা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। সরকারের প্রতি সমালোচনাপূর্ণ সব কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার জন্যই শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। (<https://www.nytimes.com/2018/08/20/opinion/shahidul-alam-prison-bangladesh.html>)
শুধু স্পিভাক নয়, শহিদুল আলমের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করেছেন সারা বিশ্বের অনেক নামীদামি মানুষ, যাঁদের মধ্যে ডেসমন্ড টুটু ও শিরিন এবাদির মতো ১০ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন ভারতের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রঘু রাই, যাঁর ১৯৭১-এর গণহত্যার চিত্রাবলি সেই খাণ্ডবদাহন-এর সেরা ডকুমেন্টেশন। সে দেশের আরও ৪০০ শিল্পী-লেখক তাঁর মুক্তি দাবি করেছেন। এমনকি যুক্তরাজ্যের আইনসভার সদস্য টিউলিপ সিদ্দিকও শহিদুলের মুক্তি দাবি করেছেন। যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় বাংলাদেশি-ব্রিটিশ টিভি ব্যক্তিত্ব কনি হকও বলেছেন এমন এক ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ, লজ্জিত। বাংলাদেশের ভেতরেও লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একাংশ শহিদুল আলমের মুক্তি দাবি করেছেন। তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। একা অথবা অনেকে মিলে পত্রপত্রিকায় তাঁরা সরকারের কাছে আলমের মুক্তির আবেদন করেছেন।
শহিদুল আলমের গ্রেপ্তারের ঘটনাটি অনেকের মনেই কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তিনি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, কোনো দলের সঙ্গে তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই। এ কথা ঠিক, বাংলাদেশের বিভিন্ন চলমান ঘটনায় তিনি নিজের মতামত প্রকাশ করে থাকেন, তার সব যে সরকারের প্রতি সমালোচনাপূর্ণ, তা–ও নয়। কিছুদিন আগে নিউইয়র্কে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তাঁর নির্বাচিত আলোকচিত্রের প্রদর্শনী হয়ে গেল। অধ্যাপক স্পিভাক জানিয়েছেন, তাঁর এক বন্ধু শহিদুল আলমের এই চিত্র প্রদর্শনী দেখেই রোহিঙ্গা সংকটের মানবিক দিকটি সম্পর্কে সচেতন হন। বাংলাদেশ এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আবেদন করেছে, শহিদুল আলমের এই চিত্র প্রদর্শনী তারই সমর্থনে একটি সবল বিবৃতি। চিত্রগ্রাহক, শিল্পী ও সমাজকর্মী হিসেবে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তাঁর হাতে শিল্পকলা পদক তুলে দিয়েছিলেন।
এমন একজন মানুষের কাছ থেকে সরকারের এমন কী ভয়ের থাকতে পারে?
একটা ব্যাখ্যা স্পিভাক নিজে দিয়েছেন। সরকার তার কোনো সমালোচনা শুনতে রাজি নয়, বিশেষত সে সমালোচনা যদি দেশের লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে আসে। তিনি লিখেছেন, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ক্রমে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। প্রমাণ হিসেবে তিনি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের কথা বলেছেন। এই আইনের ৫৭ ধারায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগে কার্যত যে কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব। সরকার অথবা এর যেকোনো সদস্যের বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনাই অপপ্রচার হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। এই আইন এত কঠোর যে একবার কেউ গ্রেপ্তার হলে তাকে জামিন না দেওয়ার বিধানও রাখা হয়েছে।
কোনো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি সর্বজনীন লক্ষণ হলো সমালোচনার সব পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। প্রতিবাদের যেকোনো সলতে একবার জ্বলতে দিলে তা একসময় মশাল হয়ে উঠতে পারে, এই ভয় থেকেই সমালোচনার মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়া। রাজনৈতিক দল বা সে দলের কর্মীরা যখন বিপদ জেনেও প্রতিবাদ করেন, জেলে যান, পুলিশের লাঠির আঘাত সহ্য করেন, তার একটা কারণ থাকে। তাঁদের আশা, একদিন তাঁদের দল ক্ষমতা দখল করবে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী যখন একা অথবা অনেকে মিলে প্রতিবাদ করেন, তার গুরুত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁরা ক্ষমতার ভাগীদার নন, কর্তৃত্ববাদের অবসান হলে তাঁরা ক্ষমতার গদিখানা দখল করবেন, এই চিন্তা তাঁদের হিসাবে থাকে না। তাঁরা প্রতিবাদ করেন, কারণ তাঁদের পক্ষে চলমান অবস্থা আর মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। এটি একটি নৈতিক অবস্থান। ভালো-মন্দ অথবা ঠিক-বেঠিকের একটি কম্পাস তাঁদের মধ্যে সজাগ থাকে। সেই কম্পাসই বলে দেয়, আর আপস নয়, এবার প্রতিবাদ করো।
এই প্রতিবাদের লক্ষ্য সরকার বদল নয়। সরকার বদলে নেতৃত্ব দেয় দেশের রাজনৈতিক দল অথবা আন্দোলন। তেমন পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করলে দেশের নাগরিক হিসেবে যেকোনো বুদ্ধিজীবী তেমন আন্দোলনের সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত হতে পারেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী যখন একা অথবা সম্মিলিতভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, তাঁর লক্ষ্য থাকে ক্ষমতার স্খলনের গ্রহণযোগ্য সীমাটি বেঁধে দেওয়া। বলা যায়, এটাও একধরনের ‘লক্ষণ রেখা’ অথবা ‘রেড লাইন’।
বুদ্ধিজীবীকে এই প্রতিবাদ করতে হয়, অন্যথায় আপসের ভারে তাঁর নিজের নৈতিক কণ্ঠস্বর, তাঁর স্বতন্ত্র পরিচয় হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে। এই নৈতিক প্রয়োজন থেকেই গত শতকের পঞ্চাশের দশকে পূর্ব ইউরোপে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল লেখক, শিল্পী, এমনকি যাজক গোষ্ঠী। ‘আর সম্ভব নয়’—এ কথা তাঁরাই প্রথম বলেছিলেন।
শহিদুল আলমের অপরাধ, তিনিও বলেছিলেন ‘আর সম্ভব নয়’। যেসব ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী তাঁর মুক্তি দাবি করেছেন, তাঁরাও বলছেন, আর সম্ভব নয়।
কী জানি, হয়তো সে জন্যই শহিদুল আলমকে এত ভয়।