দিনমজুর থেকে ‘খুনে জলিল’ সর্বশেষ ইউপি চেয়ারম্যানকে হত্যা

সুভাষ চৌধুরী, সাতক্ষীরা থেকে:নয় বছর আগে চাঞ্চল্যকর একটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে খুনের জগতে পা রেখেছিল সে। এরপর একাধিক হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি আর দখলবাজি করে স্থানীয়ভাবে নাম পেয়েছে ‘খুনে জলিল’।

সর্বশেষ সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির নেতা মোশাররফ হোসেনকে হত্যা করে জলিল গাইন।

দশ বছরে জলিল তিনবার দল পরিবর্তন করে। প্রথমে জাতীয় পার্টি, তারপর বিএনপি, সবশেষে আওয়ামী লীগে যোগ দেয় জলিল গাইন। বর্তমানে সে কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও কৃষ্ণনগর ইউপির সদস্য। চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনকে হত্যার পর জলিল গাইন এখন পলাতক।

২০১৬ সালে কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে প্রার্থী হয় জলিল। তার প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকবারের সদস্য রামনগর গ্রামের হাবিবুল্লাহ সরদারকে ভোট না দেয়ার জন্য হুমকি-ধমকি দিতে থাকে জলিল। এতে আতঙ্কিত ভোটাররা তাকে ভোট দিতে বাধ্য হয়। ভোটে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয় জলিল। অনেকের ধারণা ছিল, এবার বোধ হয় সে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু সে আশা বৃথা। সর্বশেষ তার পরিষদেরই চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনকে ৮ সেপ্টেম্বর রাতে কালিগঞ্জের কৃষ্ণনগর বাজারে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে সে। পুলিশ তাকে খুঁজছে।

কালিগঞ্জ থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার সকালে মোশাররফ হত্যায় ব্যবহৃত জলিলের মালিকানাধীন একটি মোটরসাইকেল ও ধারালো অস্ত্র শ্যামনগরের কাশিমাড়ি ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যদিকে মামলার অপর আসামি মোজাফফর বিশ্বাস মঙ্গলবার সাতক্ষীরার আমলি আদালত-১ এর বিচারক হারুনার রশীদের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছে, জলিলই চেয়ারম্যানকে হত্যা করেছে।

জলিলের বাড়ি কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের শঙ্করপুর গ্রামে। ছোটবেলায় মাঠে দিনমজুরের কাজ করত সে। বাবা হাবিবুল্লাহ গাইন পারিবারিক দারিদ্র্যের কারণে তাকে লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। এখন জলিল জমি কিনে ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়িতে বসবাস করে। তার গ্রামে বিদ্যুৎ গেলেও সোলার প্যানেলের মাধ্যমে গ্রামের বাড়িতে এসি লাগিয়ে বসবাস করছে তার পরিবার।

২০০৯ সালে কাশিমাড়ি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামে আওয়ামী লীগ কর্মী কৃষক মাজেদ পাড় খুন হয়েছিলেন পারিবারিক বিরোধের জেরে। তাকে খুন করে লাশ সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেয়া হয়। এ হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল ভাড়াটে খুনি জলিল গাইন। মামলাও হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু এলাকার একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি তাকে মুক্ত করে নেন। ২০১২-১৩ সালের দিকে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জড়িত ছিল জলিল। ২০১৩ সালে সরকারবিরোধী সহিংসতার সময় এতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণও ছিল।

এছাড়া বিএনপির বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে সরকারবিরোধী বক্তব্যও রাখে সে। সে সময়ে মিছিলে অংশগ্রহণকারী বিএনপি নেতা ওলিউর রহমান ওরফে ওলি মোল্লা পরবর্তীতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ওলির পরিবারের দাবি, জলিল গাইন টাকা খেয়ে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল।

অথচ এই ওলিই ছিলেন তার সে সময়কার রাজনৈতিক নেতা। এমনকি যে মোশাররফ চেয়ারম্যানকে সে হত্যা করেছে বলে পুলিশ বলছে, জলিল তারও লোক ছিল দীর্ঘদিন। এরপর আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগে যোগদান করে জলিল। পরবর্তীতে কাশিমাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মো. আনিছুর রহমানকে হত্যার ব্যর্থ পরিকল্পনাও করেছিল সে। স্থানীয়রা জানান, মূলত জলিল একজন ভাড়াটিয়া খুনি। বিভিন্ন স্থানে ভাড়ায় গিয়ে খুন করে আসে সে। মোশাররফ হত্যার কয়েক দিন আগে কৃষ্ণনগর বাজারে মহসিন ডাকাতকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছিল জলিল ও তার সহযোগীরা।

একসময় সেই মহসিনের সঙ্গেও ছিল তার দহরম মহরম। শ্যামনগরের কাশিমাড়ি ইউনিয়নের একজন সাবেক চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করে বলেন, কৃষ্ণনগর ও কাশিমাড়ি পাশাপাশি এলাকা। দুই ইউনিয়নে খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত জলিল।

পুলিশ বলছে, জলিল গাইন দুই এলাকার ডাকাতদের সর্দার। বছর কয়েক আগে প্রকাশ্যে সাত লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় সে ধরা পড়েও পাড় পেয়ে যায়। কালিগঞ্জ থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান বলেন, জলিল গাইনের অপরাধের অন্ত নেই।

সে ধরা পড়লে তার অপরাধ জগতের আরও অনেক জানা-অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে। এদিকে জলিল গাইন পলাতক থাকায় এসব বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।