বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য মঞ্চ নিয়ে আতংকে আ’লীগ

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের যাত্রা শুরু

পাঁচ দফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, দেশ পরিচালনায় ৯ দফা * ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ ফিরিয়ে আনার জন্য সবাইকে পাহারা দিতে হবে -ড. কামাল * আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন * গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন * নির্বাচন পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার না করা * নির্বাচনের এক মাস আগে ম্যাজিস্ট্রেসিসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন * ইভিএম ব্যবহারের চিন্তা ও পরিকল্পনা বাদ দেয়া

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার সাথে তারা দেশের সকল গণতান্ত্রিক সংগঠন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অংশ গ্রহণের আহ্বান জানায়। গতকাল শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই ঘোষণার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, একটা বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে আমরা যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যৌথ ঘোষণা তুলে ধরলাম। এটাতে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই ঐক্য করতে চাই। পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে , ঘরে ঘরে এই ঐক্য গড়ে উঠুক যাতে দেশের জনগণ তার মালিকানা ফিরে পায়। আমি বলতে চাই, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য আজকে শুরু হলো। আপনাদের সকলকে নিয়ে ইনশাল্লাহ আমরা সফল হবো এবং বাংলাদেশে একটা কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবেই হবে।
সূত্র মতে, শুরু থেকেই ড. কামালের নেতৃত্বে গঠিত এই জাতীয় ঐক্যের চরম বিরোধিতা করে আসছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি নেপাল সফর শেষে গণভবনে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যের সাথে জড়িত ড. কামাল হোসেন, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্নার কড়া সমালোচনা করেন। জানা গেছে, ড. কামালের নেতৃত্বে এ জাতীয় ঐক্য ও তাদের কার্যক্রম নিয়ে ‘টেনশনে’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যেভাবে দেশের সর্বস্তরে জাতীয় ঐক্যের উত্তাপ ছড়াচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত কি হয় সেটি নিয়ে দলটি আতংকিত। এজন্য তারা পাল্টা জোট গঠনেরও উদ্যোগ নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে গতকাল নতুন জোট ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’র আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এ জোটের নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের (একাংশ) চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী ও তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল।
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারপন্থি বলে পরিচিত নাম সর্বস্ব ১৫টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’ গঠিত হয়েছে। এই দলগুলো জোটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ‘নির্বাচনি প্রাপ্তি’র আশায় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকেও বেছে নিয়েছে। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স প্রসঙ্গে এম এ আউয়াল বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে জোটটি আত্মপ্রকাশ করেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে জোট হলেও সামনের দিকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সামনের দিনের কর্মকান্ড নির্ধারিত হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রথমদিকে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও এখন সবাই বুঝতে পারছেন, একটা সাফল্যজনক প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। গতকাল তারা যে ৫ দফা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় ঘোষণা করেছে তা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। জতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার সাথে বিএনপি জামায়াতসহ বিশ দল থাকায় সরকার আতংক বোধ করছে।
সূত্র মতে, আগামী ২২ সেপ্টেম্বর মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয় ঐক্যের সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। এর আগে ১৮ সেপ্টম্বর খুলনায় সমাবেশ করবে তারা। এছাড়া অন্য বিভাগীয় শহরে সমাবেশের উদ্যোগ নিলেও সরকারের অনুমতি নিয়ে সংকিত তারা। যদিও ঘোষিত কর্মসূচি নিয়ে শংকায় রয়েছে জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গতকাল শহীদ মিনারে যেভাবে বাধা দেয়া হয়েছে তাতে সরকার তাদের কর্মসূচি পালনে বাধা দিবে এটাই সত্য। এ ব্যাপারে ড. কামাল, রবসহ সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অনুমতি না পেলে দরকার নেই, বসে পড়বেন। সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে, সমাবেশের জন্য অনুমতি নিতে হবে। বরং সংবিধানে এটা বলা আছে, গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সভা-সমাবেশ করার সুযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগ সংবিধানের দোহাই দেয় কথায় কথায়। সংবিধানের এই অধিকার নিশ্চিত করার বিধান লঙ্ঘন করলে এরজন্য অবশ্যই তাদের মাশুল দিতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. কামাল, আ স ম রব, বি চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের বড় সমাবেশ করার মতো জনসমর্থন নেই। কিন্তু এই সমাবেশ সফল করার দায়িত্ব নিয়েছে বিএনপি। সরকারের জন্য এটাই বড় চিন্তার কারণ। সরকার মনে করছে, গত দু’বছরে বিরোধী জোট বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত ঢাকা নগরীর আশপাশে লাখ লাখ মানুষের ঘাঁটি করেছে। কয়েক ঘন্টার ঘোষণায় তারা লাখো মানুষের সমাগম ঘটাতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ইস্যুতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ফলে সমাবেশের ডাক দেয়ার পর কি অবস্থা হবে তা নিয়ে শংকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১ সেপ্টেম্বর দলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বিএনপির সমাবেশ মাথা খারাপ হয়ে গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই মাত্র কয়েক ঘন্টার ঘোষণায় এতো বিপুল সংখ্যক লোকের সমাবেশ! এতেই হতাশ হয়ে পড়েছে সরকারি দল। তার পর থেকেই ধর-পাকড় শুরু হয়েছে সারা দেশে। কিন্তু এতে খুব একটা সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সরকার যে সব ক্ষেত্রে সফল হতে পারছে না এবং অনেক কিছুই প্রকৃত তথ্য সরকারের হাতে নেই তার বড় প্রমাণ হলো গত ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া জেলে যাবার দিনের অপ্রতিরোধ্য শোডাউন, এপ্রিলের কোটা আন্দোলন এবং তারপর আগস্টের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অভাবিত পরিস্থিতি। বিরোধীদের দাবি, এরপর যা ঘটবে সেটি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের থাকবে না। এর সাথে যদি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যোগ দেয় তাহলে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
এদিকে সরকারের আতংক বাড়াচ্ছে বিদেশীরা। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যের প্রতি বিদেশীদের প্রায় সবারই সমর্থন রয়েছে। এই ঐক্য সফল করার প্রচেষ্টায় কূটনৈতিকরা নিজেরা ছাড়াও রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করছেন। সরকার অভিযোগ করছে, বিদেশী কূটনীতিকরা তাদের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেও সরকার পতনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এর সঙ্গে বিদেশীরা জড়িত। বিএনপির জুনিয়র-সিনিয়র নেতারা সবাই এখন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা সবকিছু ছাড় দিয়ে হলেও জাতীয় ঐক্য চাচ্ছেন। আর এটাই সরকারের জন্য মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় ঐক্যের পাশাপাশি বর্তমান সময়ে নিজেদের মধ্যকার অবিশ্বাস ও অনাস্থা নিয়ে বড় টেনশনে সরকারি দল। তারা আশঙ্কা করছেন, আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ ড. কামালের প্রক্রিয়ার সঙ্গে গোপনে জড়িত রয়েছে। বিশেষ করে যেসব আওয়ামী লীগ নেতা বিগত সময়ে ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত হয়েছেন অথবা আশানুরূপ সুযোগ-সুবিধা পাননি। আবার যারা এবারের প্রার্থী তালিকায় নাম লেখানো থেকে বাদ পড়তে পারেন তাদেরও একটি অংশ নেপথ্যে ড. কামালদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে কী হতে পারে- এই আতঙ্কেও অনেক নেতা ড. কামালের ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে ড. কামাল এক সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের বরেণ্য নেতা ছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর দেশে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুসারী ও সহচর হিসেবে দেশের প্রধান আইনবিদ ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাকর্মীদের কাছে এখনো শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের এমপি হয়ে আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন ড. কামাল। শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগকে সংগঠিত রাখতে ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে গিয়ে ড. কামাল হোসেন গণফোরাম দল গঠন করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে বরাবরই তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তাকে নিয়ে কোনো বিতর্কও নেই। বরং ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার। দেশের প্রধান আইনবিদ হিসেবে তিনি নতুন প্রজন্ম ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। এসব কারণে ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য হলে ভবিষ্যতে তার নেতৃত্বে বিকল্প আওয়ামী লীগও গঠিত হতে পারে বলে সরকারের কেউ কেউ মনে করছেন। তাই সরকার যেকোনো মূল্যে জাতীয় ঐক্য মঞ্চ ঠেকাতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
কিন্তু এরই মধ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবে একমঞ্চে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মিলিত হয়েছিলেন। কথা বলেছেন সবাই একই সুরে। জাতীয় ঐক্য সফল করার পক্ষে সবাই একাট্টা। তারা কেবল নির্ধারিত ডেটলাইন তথা ২২ সেপ্টেম্বরের অপেক্ষায় আছেন। সেদিন জাতীয় ঐক্য মঞ্চ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক স্থান- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কিন্তু সরকার সেখানে অনুমতি দেয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে মহানগর নাট্যমঞ্চে এই কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। নির্বাচনে সুবিধা লাভের একটা পথ হিসেবে সরকার চেষ্টা করছিল জাতীয় ঐক্য থেকে জামায়াতে ইসলামীকে কোনওভাবে বাদ দেয়া যায় কিনা। ঐক্য প্রক্রিয়ার কাউকে কাউকে দিয়ে এ চেষ্টা সরকার করেছিলো, কিন্তু হালে পানি পায়নি। সরকারের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সবাই ওয়াকিফহাল।
নির্বাচন নিয়ে নানা মহলের সন্দেহ সংশয়ের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ বলছে, গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হবে। অগণতান্ত্রিক কোনো শক্তিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না। অপরদিকে, জাতীয় ঐক্যের নেতারাসহ বিএনপি বলছে, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিতে এ মুহূর্তে কোনোভাবেই সম্মত নয়। এমনকি বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন বা কোনো ইস্যুতেই আলোচনায় রাজি নয় বলে সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। যদিও ভেতরে ভেতরে উভয় দলের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে গুঞ্জন আছে। বিএনপির দাবি অনুযায়ী, নির্দলীয় কোনো সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরা যে আর সম্ভব নয়, সেটা ভালো করেই বুঝে ক্ষমতাসীনরা। ফলে প্রধান দু’দলের পর্দার অন্তরালে আলোচনা হলেও এর কোনো সুফলের আশা করছেন না কেউ-ই।
এদিকে ভারত থেকে আওয়ামী লীগ আর আগের মতো সুবিধা পাচ্ছে না। দেশটি বাংলাদেশের নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার পক্ষে তাদের মতামত স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। আর ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হারানোর কারণে ভারতও ড. কামালের নেতৃত্বে নতুন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় নেপথ্যে থেকে সমর্থন দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ভূমিকা ও দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই স্পষ্ট। চীন এ মুহূর্তে অনেকটা নিরপেক্ষ ভূমিকায় রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম হলেও তাদেরকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাশিয়ার খুব একটা সহযোগিতার সুযোগ নেই বলে বিশ্লেষকদের মত। রাজনৈতিক একাধিক সূত্র ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী লীগ যে ধরনের সমর্থন চাচ্ছে তা কোনো দেশই এখন আর দিতে চাচ্ছে না। যা আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে। এর মধ্যে নেপালে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ৩০ আগস্ট ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে। এর আগে ২৯ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনেও ২ নেতার বৈঠকের কর্মসূচির কথা জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তবে বৈঠকে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে মোদির জোরালো সমর্থন দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত মেলেনি বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
একই কথা বলছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। দেশের সুশীল সমাজের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক যে ভালো যাচ্ছে না তা ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা-বিবৃতিতেই। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেলেই সুশীল সমাজকে তুলোধুনো করছেন। তাই সুশীল সমাজও এ মুহূর্তে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া সফল করার পক্ষে কাজ করছেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ গত ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে দি ঢাকা ফোরামের ব্যানারে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মিলিত হন। সেখানে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দেশবাসীকে আন্দোলনে নামার আহ্বানও জানিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি দেশবাসীকে ৫২, ৬৯ ও ৭১ সালের মতো আন্দোলন করার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় ঐক্য ও বিএনপি নেতাদের মতো একইভাবে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ গোলটেবিল বৈঠকে বলেছেন, ‘আগে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচন করার বিধান ছিল। এখন আইন করে সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। তারা এখন ইভিএম প্রকল্প হাতে নিয়ে আছে। প্রকল্প পাস হওয়ার আগেই একটি প্রতিষ্ঠানকে ইভিএম কিনতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যারা ইতিমধ্যে এলসিও খুলে ফেলেছে। কাজের অর্ডার পাবার আগেই কীভাবে এলসি খোলা হলো- তা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।’ বিতর্কিত ইসির চলে যাওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন সুশীল সমাজের এই প্রতিনিধি।
‘উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও সুশাসন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সেখানে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে আরও বক্তব্য রেখেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময়ের মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদ তিতুমীর, অধ্যাপক আবু আহমেদ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক ড. ম. ইনামুল হকের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। হঠাৎ তাদের নতুন ব্যানারে একমঞ্চে উপস্থিতি ও আন্দোলনের আহ্বান সরকারের ভেতর ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিবে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন।
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে হয়ে গেছে জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সরকার চাইবে যাতে জাতীয় ঐক্য না হয়। কিন্তু এই ঐক্য হবে। সব রাজনৈতিক দল যারা গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে চায়, আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতে চায়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে চায়, আজকে একটি পয়েন্টে তারা একমত। মওদুদ বলেন, আগামী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ হয় সে জন্য দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে চায়। সুতরাং আমি বলবো এই ঐক্য হয়ে গেছে। আজকে ড. কামাল হোসেন, বি চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম আব্দুর রব, এমনকি বাম জোটের নেতারা একই কথা বলছেন। সুতরাং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়ে গেছে।

Check Also

ঘোনা ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন

আবুল হোসেন সদর প্রতিনিধি : ঘোনা ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।