ক্রাইমবার্তা রির্পোটঃ লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি বিএনপি। যুক্তফ্রন্ট-জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া যৌথভাবে ঐক্যের ঘোষণা এবং গণতান্ত্রিক বাম জোট কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে সক্রিয় হলেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সন্দেহের বাইরে যেতে পারেননি বিএনপির নেতারা। এছাড়া, দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য ও দলটির সাবেক মহাসচিব বি চৌধুরীকে কেন্দ্র করে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। এই জটিলতা কাটিয়ে ঐক্য কত দ্রুত ফলপ্রসূ হবে, বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর ঐক্যের চাপ আছে বিভিন্ন শক্তির। এই ঐক্যে সরকারের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশকে যুক্ত করার বিষয়ও আছে। বিশেষ করে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে ক্রিয়াশীল করতে নাগরিক সমাজের এই অংশটি মানসিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এখানেই মূল ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিগত দিনের ভাবমূর্তি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তার সম্পর্কে বিভিন্ন সমালোচনা তৈরি হওয়ায় নাগরিক সমাজের মধ্যে এখনও সন্দেহ আছে। এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করতে পারছেন না বিএনপি নেতারা।
সূত্রের ভাষ্য, তারেক রহমান বর্তমান নেতৃত্বে আসার পর থেকে দলকে সুসংগঠিত করে রাখার পেছনে অন্যতম ভূমিকা পালন করলেও রাজনৈতিকভাবে তার ভাবমূর্তি ফেরাতে কোনও উদ্যোগই নিচ্ছেন না স্থায়ী কমিটির নেতারা।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, নাগরিক সমাজের এই অংশটিকে বোঝাপড়ায় আনা এখন বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের প্রধান কাজ। যদিও এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটিসহ শীর্ষ নেতারা কোনও কাজই এগিয়ে নিতে পারছেন না। নাগরিক সমাজের এই অংশটির নেতৃত্বে আছেন একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও একজন অধ্যাপক। এছাড়া দু’টি সংবাদপত্রও রয়েছে এই অংশে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, ‘বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখনও আশাবাদী।’
গত সপ্তাহে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার সঙ্গে বৈঠকেও আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করা এবং জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারেক রহমান।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য মঙ্গলবার বিকালে বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে তারেক রহমান আশাবাদী। এই ঐক্যের জন্য যে ছাড় বিএনপিকে দিতে হবে, তা দেওয়ার জন্য দল প্রস্তুত।’ তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই জন সদস্য জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের একজন দলীয় ফোরাম ও স্থায়ী কমিটির বৈঠকে খালেদা জিয়ার কারাবরণের বিষয়টি আবেগের সঙ্গে উপস্থাপন করে বাকি বিষয়গুলোকে পেছনে রাখার চেষ্টা করেন। আর যে অংশটি ঐক্যের জন্য আন্তরিক, তাদের ক্ষেত্রে এই সদস্যের বক্তব্য সমস্যা সৃষ্টি করে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে মতের ভিন্নতা থাকায় এখনও ঐক্য-প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি বিএনপি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সোমবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও ঐক্যপ্রক্রিয়া নিয়ে নেতাদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই বৈঠকটি মুলতবি রয়েছে। বৈঠকটি শিগগিরই শুরু হবে। এই বৈঠকে আশাপ্রদ কিছু থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য।
সূত্র বলছে, বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের আরেকটি সমস্যা তৈরি হয়েছে বি চৌধুরীকে কেন্দ্র করে। বিএনপি নেতারাও এ বিষয়ে কিছু কারণ উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী আগেই বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য রেখে বিএনপির সঙ্গে কোনও ঐক্য করবে না যুক্তফ্রন্ট। গত শুক্রবার (১৪ সেপ্টেম্বর) তৈরি হয়েছে নতুন আরও একটি সমস্যা। যৌথ ঘোষণার প্রাথমিক বক্তব্যে একটি পরিবর্তন এসেছে গোপনীয়তা রক্ষা করে।
এদিন দুপুরে নাগরিক ঐক্যের কার্যালয়ের বৈঠকে চারজনের একটি টিম যৌথঘোষণার ড্রাফট চূড়ান্ত করে। ওই ঘোষণাপত্রের ভূমিকার একপর্যায়ে বলা হয়, ‘মুক্তিসংগ্রামের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, সমাজ শক্তি ও নাগরিক সমাজসহ জনগণকে সুসংগঠিত করে আমরা ‘ যদিও ওই দিন রাত সাড়ে দশটার দিকে বিকল্প ধারার সভাপতি বি চৌধুরীর প্রেস সেক্রেটারি জাহাঙ্গীর আলমের মেইল থেকে ঘোষণাপত্রটি পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। তবে ওই লাইনটি পরিবর্তিত হয়, সেখানে লেখা হয়, ‘প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সকল স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী…।’ এ বিষয়ে জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ঘোষণাপত্র শনিবার প্রেসক্লাবেই প্রকাশ হওয়ার কথা।’
যুক্তফ্রন্টের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে বি চৌধুরীর না যাওয়া, বক্তব্যের রাতারাতি পরিবর্তন, ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং সেখানে কী বক্তব্য আসা দরকার, এসব বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের নেতারা আলোচনা করবেন।
যুক্তফ্রন্টের বাইরে বিএনপিতেও বি চৌধুরী ও মাহী বি চৌধুরীর আচরণ ও বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। ঐক্যপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত দুই নেতার ভাষ্য, মাহী বি চৌধুরীর বর্তমান কর্মসূচি ‘প্ল্যান বি’র কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
মাহী বি চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী বলতে বোঝানো হয়েছে, পরোক্ষভাবেও স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না। বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন দুজনই স্বাক্ষর করেছেন যে, ঐক্যপ্রক্রিয়ায় আসতে হলে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখা চলবে না। আর এই কথাটি এজন্যই বলা হয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ওই ঐক্যের মধ্যে বি. চৌধুরী সাহেবের অবস্থান ও আরও কিছু বিষয়ের জন্য সময় লাগবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দলের চেয়ারপারসনের আহ্বান অনুযায়ী জাতীয় ঐক্যের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও একমত। কিন্তু সময় লাগবে।’
যুক্তফ্রন্টের সিনিয়র দুই নেতা মনে করেন, রাজনৈতিক সমীকরণের কারণেই শেষপর্যন্ত হলেও বি চৌধুরীর বিকল্প ধারা বৃহত্তর ঐক্যে কোনও সমস্যা তৈরি করতে পারবে না। ড. কামাল, আসম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না I নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ সমর্থনে ঐক্য সম্পন্ন হলে বি চৌধুরীও যুক্ত হবেন তাতে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বৃহত্তর ঐক্যে আগ্রহী দলগুলোর ডিমান্ডের ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় আছে। একটি হচ্ছে, দল ও সংগঠন গোছানো। নির্বাচিত হয়ে সংসদে যাওয়া। এক্ষেত্রে দলকে শক্তিশালী করতে বিএনপির বাইরে বিকল্প নেই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ক্ষমতার গুণগত পরিবর্তন ও ক্ষমতার ভারসাম্য।
ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়ে যুক্তফ্রন্টের শরিক দল বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী বলেন, ‘ভারসাম্যের বিষয়ে যত অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে বিএনপির সঙ্গে, তাতে মোটামুটি তারা মেনে নিয়েছেন বলে আমার মনে হয়। সংসদে, সরকারে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার ব্যাপারে বিএনপি একমত।’
যুক্তফ্রন্টের অন্যতম একজন নেতা রবিবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ড. কামাল ও বি চৌধুরীর মধ্যে ঐকমত্য হওয়ায় বিএনপির আস্থা বেড়েছে। এখন প্রয়োজন এই আস্থাকে কার্যকর করা।’
ইতোমধ্যে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার যৌথঘোষণার দাবি ও দফার সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক দাবির অনেক মিল রয়েছে। বিশেষ করে সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা, ইভিএম বাদ দেওয়ার মতো বিষয়গুলো হুবহু এসেছে উভয় দিক থেকেই।
মাহী বি চৌধুরী বলছেন, ‘তাদের ও আমাদের ৫ দাবির মধ্যে অলমোস্ট বেশিরভাগ মিল আছে। ভাষা এক, হুবহু এক। ফলে, সরকারের উদ্দেশে যে দাবি-দাওয়া, তাতে প্রায় এক। আর এটা আমি ইতিবাচক মনে করি।’
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ‘উভয় দিক থেকেই প্রাথমিক ঐক্যপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এখন দরকার দ্রত একমঞ্চে উঠে কর্মসূচি দেওয়া।’ তিনি বলেন, ‘সরকার যেভাবে অতীতে রাজনৈতিক দলগুলোকে দিয়েছে, ঐক্য হলে সে বাধা অনেকটাই কমে যাবে।’
যুক্তফ্রন্টের সূত্রে জানা গেছে, এ সপ্তাহেই যুক্তফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে বিএনপি।
বিএনপির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মনে করেন, বৃহত্তর ঐক্যের দায় ও দায়িত্ব এখন বিএনপির। বাকিদের ঐক্যে আনতে এখন বিএনপিকে কাজ করতে হবে।বাংলা ট্রিবিউন