ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রির্পোটঃসাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার সদ্য প্রকাশিত ‘এ ব্রোকেন ড্রিম’ বইয়ে লিখেছেন আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সরকার রায়ের আগে বিচারপতিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের আপিল শুনানি শেষে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বেঞ্চের সব বিচারপতিকে তার চেম্বারে ডাকেন। সরকার যাতে বিচারপতিদের ওপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ না পায় সে জন্য তার আগেই তিনি এ মামলার রায় দিতে চেয়েছিলেন।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সাবেক এ প্রধান বিচারপতি তার বইয়ে ২৭তম অধ্যায় ‘সংবিধান : ষোড়শ সংশোধনী মামলা এবং পরবর্তী ঘটনা’ শিরোনামে তুলে ধরেছেন ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। তিনি লিখেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আপিল মামলার সর্বশেষ শুনানি হয় ২০১৭ সালের ১ জুন। ৩ জুলাই আমি রায়ের তারিখ ঘোষণার দিন ঠিক করলাম। কোর্ট মুলতবি করার পর আমি বেঞ্চের অপর বিচারপতিদের আমার চেম্বারে ডাকলাম তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য। যেহেতু আমরা শুনানি মাত্র শেষ করেছি, শুনানি বিষয়ে আমাদের স্মৃতি এখনো উজ্জ্বল তাই আমরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে পারি এবং তারা যদি তাদের মতপ্রকাশ করে তাহলে ৩ জুলাই চূড়ান্ত রায় দিতে পারি। আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম, বিচারপতি নাজমুন আরা অল্প কয়েক দিনের মধ্যে অবসরে যাবেন। আমরা তার অবসরে যাওয়ার আগে রায়ে তার স্বাক্ষর নিতে পারব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, সরকার বিচারপতিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে রায়ের বিষয়ে। এ ধরনের চেষ্টার আগেই যদি আমরা চূড়ান্ত রায় দিয়ে দিতে পারি তাহলে একটি সর্বসম্মত মত তুলে ধরা আমার জন্য সহজ হবে। আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বললেন, তিনি ৩ জুলাইয়ের আগে কিছুই বলবেন না। ওই দিনই আমাদের মত তুলে ধরার জন্য নির্ধারিত ছিল। আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম ফ্যাক্টস ও আইনগত পয়েন্ট ছাড়া আর কোনো কিছু প্রকাশ করতে বাকি নেই। তা ছাড়া এ ধরনের জটিল মামলা এবং এর দীর্ঘ শুনানির পর যদি রায় অপেক্ষমাণ রাখা হয় তাহলে সাধারণত রায় বিচারপতিদের স্বাক্ষরিত রায় দেয়া হয়। এটি বিশ্বব্যাপী মেনে চলা হয়। কিন্তু তারা রাজি হলেন না এবং বড় ধরনের একটা ভুল করলেন তারা।
বিচারপতি সিনহা উল্লেখ করেন, ২০১৭ সালের ১ জুলাই সকালে আমি আমার ব্যক্তিগত মোবাইলে একটি ফোন পেলাম। ফোনটি এসেছে বঙ্গভবন থেকে। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব আমাকে জানালেন ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রাষ্ট্রপতি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বঙ্গভবনে আলোচনার জন্য। আমি একটু বিস্মিত হলাম, কারণ এর আগে আমার সাথে সরাসরি সামরিক সচিব বা উচ্চপদস্থ কেউ যোগাযোগ করেননি এভাবে। সাধারণত এর আগে সামরিক সচিব সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে ফোন করতেন এবং রেজিস্ট্রার জেনারেল আমাকে জানাতেন। এরপর আমার পক্ষ থেকে আবার রেজিস্ট্রার জেনারেল যোগাযোগ করতেন। এমনকি আমি হাইকোর্টে থাকাবস্থায়ও সামরিক সচিব রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে অনুরোধ করেছেন রাষ্ট্রপতির সাথে চায়ের দাওয়াতের জন্য। এবার তার ব্যতিক্রম হলো। রাষ্ট্রপতির সাথে আমার আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। এর আগে তিনি আমাকে সস্ত্রীক রাতের খাবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি আমাদের সামনে সাধারণভাবে হাজির হয়েছেন এবং আমরা তার সাথে স্বাভাবিক সুন্দর সময় কাটিয়েছি।
বইয়ে এস কে সিনহা বলেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের ক্ষমতা এর আগে ছিল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে। তিন সদস্যের এ কাউন্সিলে অপর দুই সদস্য হলেন আপিল বিভাগের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিচারপতি। ১৯৭৭ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় এ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। বর্তমান সরকার বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদের ওপর ন্যস্ত করে সংবিধানে ষোলোতম সংশোধনী পাস করে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ গত বছর ৩ জুলাই সর্বসম্মতিক্রমে সরকারের আপিল খারিজ করে দেন। ফলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। ১ আগস্ট প্রকাশিত হয় ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়। রায়ে তিনি বাংলাদেশের সংসদ, গণতন্ত্র, দলীয়করণ, প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তীব্র সমালোচনা করেন। রায় প্রকাশের পর গত বছর দেশব্যাপী আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয় এ রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পর্যবেক্ষণ। এরই ধারাবাহিকতায় তাকে অসুস্থ সাজিয়ে পদত্যাগ ও দেশান্তরী হতে বাধ্য করা হয় মর্মে অভিযোগ করেছেন তিনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার সদ্য প্রকাশিত বইয়ে সেই সময়কার ঘটনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল অধ্যায়টি তিনি শুরু করেছেন ১৯৯১ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রসঙ্গ টেনে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়।
Check Also
ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়
দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …