কুরআন হলো একটি আসমানি কিতাব। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে এবং ফেরেশতা জিবরাইল আমিনের মাধ্যমে নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে পর্যায়ক্রমে ওহিরূপে প্রেরিত সর্বশেষ কিতাব। কুরআন শব্দের অর্থÑ যা পঠিত হয়; যা বেশি বেশি পঠিত হয়। সমগ্র মানবজাতির জীবনবিধান তথা জীবন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিবিধান সংবলিত একটি অপরিবর্তনযোগ্য ও অনুপনোদনযোগ্য কিতাব। এ কিতাবে কোনো প্রকার ভুল নেই, ত্রুটি নেই; সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের সুযোগবিহীন একটি পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ কিতাব। সমগ্র মানবজাতির হিদায়াত বা পথপ্রদর্শনের লক্ষ্যে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কর্তৃক নাজিলকৃত একটি অলৌকিক কিতাব।
ইল্মি দ্বীন বা দ্বীনি জ্ঞান আহরণের প্রধানত পাঁচটি উৎস রয়েছে। সেগুলো হলোÑ আল্লাহর কুরআন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর হাদিস, ফুকাহাদের ইজমা, মসজিদ ও মাদরাসাসহ সব দ্বীনি প্রতিষ্ঠান এবং ওলামায়ে কিরামের লেখা ইসলামি বই-পুস্তক ও তাদের দেয়া দ্বীনি বক্তব্য। এগুলোর মধ্যে প্রথম ও প্রধান উৎস হলো আল-কুরআন। তাই দ্বীনি ইলমের জ্ঞান অর্জন করতে হলে কুরআন শিক্ষাকে কিছুতেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন, ‘একজন চক্ষুষ্মান লোক আর একজন অন্ধ ব্যক্তি কখনো সমান হতে পারে না; আর না আঁধার ও আলো সমান হতে পারে’। (সূরা ফা’তির : ১৯-২০)
কুরআন আল্লাহ প্রদত্ত একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। আর মানুষ হলো জমিনে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সৃষ্টি। (সূরা বনি ইসরাইল : ৭০) জমিনে সৃষ্ট সব সৃষ্টিমালা মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। এমনকি আকাশের চাঁদ-তারাও মানুষের কল্যাণেই নিয়োজিত। দিন-রাতের পরিবর্তনও মানুষেরই সুবিধার্থে উদ্ভাবিত। (সূরা নাবা : ১০ ও ১১) সর্বোপরি এ জমিনকেও মানুষের বসবাস, রিজিক আহরণ ও গ্রহণ এবং চলাচলের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন পরম দয়ালু ও পরম করুণাময় আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা। (সূরা মুলক : ১৫ ও জুখরুফ : ১০) যেসব সৃষ্টিকে আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে হয় সেগুলোও প্রকৃত-প্রস্তাবে কল্যাণকরই বটে। হয়তো বা আজ আমাদের বুঝে আসছে না; কিন্তু কাল ঠিকই বুঝে আসবে; প্রকৃত সত্যটা নিশ্চিত বেরিয়ে আসবে। (সূরা আল-ইমরান : ১৯১, আহকাফ : ০৩)
কুরআনকে মেনে জীবন পরিচালনার বাস্তব নমুনা হলো স্বয়ং নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহু সা:, খোলাফায়ে রাশেদিন এবং সাহাবায়ে কিরাম। এ ছাড়া রয়েছেন তাবেইন, তাবে-তাবেইন, ওয়ালিয়ে কিরাম, হাক্কানি উলামায়ে কিরাম। উল্লেখ্য, দুনিয়াতে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে নবীজী হলেন আমাদের জন্য একমাত্র অনুকরণীয়-অনুসরণীয় আদর্শ আর সাহাবায়ে কিরাম হলেন নবীজীকে কিভাবে অনুকরণ-অনুসরণ করে দুনিয়ার জীবন গঠন ও পরিচালনা করতে হবে তারই বাস্তব নমুনা।
কুরআন না বুঝে তিলাওয়াত করলেও অনেক সওয়াব আছেÑ প্রতি হরফ বা অক্ষরে ১০ নেকি। এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই। কুরআনই একমাত্র কিতাব যা শুধু পড়লেই সওয়াব হয়। বস্তুত নিয়মিতভাবে কুরআন তিলাওয়াত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। কিন্তু বুঝে পড়লে উল্লিখিত সওয়াবত হবেই, উল্লিখিত ইবাদত ত হবেই- অধিকন্তু এতে আরো অনেক বেশি উপকারিতা লাভ করাও সম্ভব হবে। যেমন আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধগুলো জানা যাবে, বোঝা যাবে। আল্লাহ তায়ালার প্রতি আস্থা-ভরসা বৃদ্ধি পাবে। জানলে-বুঝলে সেগুলো মানাও যাবে। মানাটা সহজ ও সম্ভব হবে। আবার অন্যের কাছে প্রচারও করা যাবে অর্থাৎ কুরআনের তাবলিগও করা যাবে। ফলে ইসলামী সমাজ বা পরিবেশ গঠনে অবদান রাখা যাবে।
বিদায় হজের ভাষণে রাসূলে-পাক সা: বলেছিলেন, আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি : কিতাবুল্লাহ তথা আল-কুরআন আর সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ তথা আল-হাদিস। যত দিন তোমরা এ দু’টিকে আঁকড়ে ধরবে, তত দিন পথভ্রষ্ট হবে না। আঁকড়ে ধরে রাখার অর্থ শুধু তিলাওয়াত নয়। বরং আঁকড়ে ধরার অর্থ হলো কুরআন শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত, পরিমাণ মতো তিলাওয়াত, কুরআন বোঝার উদ্দেশ্যে অধ্যয়ন, কুরআনি বিধিবিধান নিজের জীবনে বাস্তবায়ন এবং যথাসাধ্য অন্যের কাছে পৌঁছানো।
দ্বীনে হক্কের তাবলিগ করতে হলে তার প্রধান ভিত্তি বা উপকরণই হলো আল-কুরআন। (সূরা মায়েদা : ৬৭, নাহল : ৪৪) কুরআন না বুঝে কুরআনের তাবলিগ কিভাবে সম্ভব হতে পারে? উম্মতে মুহাম্মদিকে সৃষ্টি করা হয়েছে সৎ কাজের আদেশ দিতে এবং অসৎ কাজে বাধা দিতে। (সূরা আলে-ইমরান : ১০৪ ও ১১০) কুরআন না বুঝলে কোনটা সৎ কাজ আর কোনটা অসৎ কাজ তা জানব কী করে? তা বিচার করব কিসের ভিত্তিতে? কুরআনের আরেক নাম ফুরকান। (সূরা বাকারা : ১৮৫) ফুরকানের অর্থ হলো সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা। কুরআন না বুঝলে কী করে নির্ণয় করা যাবেÑ কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা, কোনটা হক্ক আর কোনটা বাতিল। কুরআনের জ্ঞান মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসে। (সূরা বাকারা : ২৫৭) কিন্তু কুরআন না পড়ে, কুরআন না বুঝে কুরআন থেকে এ সুবিধা লাভ করা কী করে সম্ভব হতে পারে!
শুধু তাই নয়। ঈমানকে যথার্থরূপে অনুধাবন করতে হলেও কুরআনের জ্ঞান আবশ্যক। ঈমানের মূল বিষয়গুলো যেমন তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, তাকদির, কিয়ামত ইত্যাদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা আয়ত্ত করতে হলে কমবেশি কুরআনি ইলম থাকা জরুরি। কুরআন এসব বিষয়ের আলোকপাত করেছে অলৌকিক জ্ঞানের মাধুরী দিয়ে, ঐশ্বরিক ভাষার সুনিপুণতা দিয়ে, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, অনেক ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে এবং আকর্ষণীয় দৃষ্টান্তের মাধ্যমে।
আল-কুরআন হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। (সূরা মায়েদা : ৩) অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে একজন মানুষের জীবন কিভাবে পরিচালিত হবে, একটি পরিবারে যে ক’জন সদস্য-সদস্যা আছে সামষ্টিকভাবে তাদের জীবন কিভাবে চলবে, অনুরূপভাবে একটি সমাজে বা দেশে যেসব লোক বসবাস করে কিভাবে তারা তাদের সমাজ বা দেশকে পরিচালনা করবে; জীবন, পরিবার, সমাজ ও দেশ পরিচালনায় কোন পন্থা সঠিক কোন পন্থা বেঠিক, কোনটা গ্রহণীয় আর কোনটা বর্জনীয়Ñ তারই পরিপূর্ণ বিধিবিধান হলো আল কুরআন।
কুরআন মেনে জীবন গড়তে চাইলে সব মানুষকেই কুরআন বুঝতে হবে। অন্তত কুরআন সম্পর্কে এ পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করতে হবে, যে পরিমাণ জ্ঞান থাকলে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে কুরআনি জিন্দেগি অনুসরণ করা সহজ ও সম্ভব হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় জীবনযাপন করতে হলে কুরআনি শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। বলছি না যে প্রতিটি মানুষকে বা প্রতিটি মুসলিমকে কুরআনে হাফেজ বা মুফাসসিরে কুরআন অথবা শায়খুল হাদিস হতে হবে; তাকে মুফতি হতে হবে বা কামিল পাস করতে হবে। এটা ফরজ বা আবশ্যকীয় নয়। তবে কোনো মানুষের পক্ষেই কুরআনের বেসিক নলেজ বিবর্জিত থাকা জীবন চলার দিক থেকে নিরাপদ নয়।
বলতে চাচ্ছি, কুরআন কী, কুরআনে কী আছে, কুরআন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কী জন্য মানবজাতির ওপর নাজিল করলেন, কুরআনি জিন্দেগি বলতে কী বুঝায়Ñ এসব বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান বা সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করা প্রতিটি মুসলিমের জন্যই অতীব জরুরি। প্রতিটি মুসলিম যেন বুঝতে শেখে- দ্বীন মানে কুরআন, কুরআন মানে দ্বীন। এবং এ বুঝটি যেন প্রতিটি মুসলিমের অন্তরে গ্রথিত থাকে। তার মানে একজন মুসলিমের শিক্ষাজীবন শুরুই হবে কুরআন তথা দ্বীনি ইলম শিক্ষা দিয়ে। এ জন্য আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন: ‘ইলম অন্বেষণ করা প্রতিটি মুসলিমের (নর ও নারী) জন্য ফরজ।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, এখানে ইলম বলতে প্রধানত কুরআনি বা দ্বীনি ইসলামকেই বোঝানো হয়েছে। অবশ্য মানবকল্যাণে অবদান রাখে যেমনÑ চিকিৎসা, প্রকৌশল, আইন, কৃষি, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞানও এর বহির্ভূত নয়।
সত্যিকার মুসলিম হতে হলে কুরআন শিখতে হবে, আখিরাতকে বিশ্বাস করলে কুরআন শিখতে হবে, কবরে শান্তি চাইলে কুরআন শিখতে হবে, কেয়ামতে নাজাত পেতে হলে কুরআন শিখতে হবে। কুরআন শিক্ষার বিকল্প নেই। কারণ জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে কুরআনকেই জীবনসাথী বানাতে হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘আমরা এ কুরআনকে উপদেশের জন্য সহজ মাধ্যম বানিয়ে দিয়েছি। উপদেশ গ্রহণ করতে প্রস্তুত এমন কেউ আছে কি’? (সূরা আল-কামার : ১৭, ২২, ৩২, ৪০) আল্লাহ আরো বলেন, ‘আমরা এই কুরআনে নানাভাবে বুঝিয়েছি যেন তারা শিক্ষা গ্রহণ করে’। (সূরা বনি ইসরাইল : ৪১) তিনি বলেন, ‘আমরা উহাকে আরবি ভাষায় কিতাব বানিয়েছি যেন তোমরা তা বুঝতে পারো’ (সূরা জুুখরুফ : ৩) ‘হে মানুষ! আমরা তোমাদের প্রতি এমন একখানা কিতাব পাঠিয়েছি যাতে তোমাদেরই বর্ণনা রয়েছে’। (সূরা আম্বিয়া : ১০) তারা কি কুরআন সম্বন্ধে চিন্তা-গবেষণা করে নাÑ নাকি তাদের দিলসমূহে তালা পড়ে গেছে। (সূরা মুহাম্মদ : ২৪) ‘হে নবী! আমরা এ কিতাবকে তোমার ভাষায় খুব সহজ বানিয়ে দিয়েছি যেন এ লোকেরা নসিহত গ্রহণ করে’। (সূরা : দোখান-৫৮) রাসূলুল্লাহ সা: বলেন: ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই সবচেয়ে উত্তম যে কুরআন নিজে শিক্ষা করে এবং অন্যকেও কুরআন শিক্ষা দেয়।’
আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান ইসলামের প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে মানুষকে কুরআনের কাছাকাছি আসতে হবে, কুরআনকে বন্ধু বানাতে হবে, কুরআনি জিন্দেগি অবলম্বন করতে হবে।
কুরআনকে ব্যক্তিগত জিন্দেগিতে বা পারিবারিক জীবনে মেনে চলতে হলেও কুরআন বুঝতে হবে; সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনুসরণ করতে হলেও কুরআন বুঝতে হবে। আখিরাতে সফলতা অর্জনের জন্য তো বটেই। অর্থাৎ কুরআন পড়া, অধ্যয়ন করা, অনুধাবন করা এবং কুরআনি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করাÑ এ সবের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : প্রবন্ধকার
Check Also
তাবলীগ জামায়াতের সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ-সমাবেশ
মুহাম্মদ হাফিজ, সাতক্ষীরা : তাবলীগ জামাতে সাদপন্থীদের বর্বোরিচত হামলার প্রতিবাদ ও সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগের সহসভাপতি …