হতাশায় খুলনাঞ্চলের পাটকল শ্রমিকরা

মৌসুম ভিত্তিক দেয়া
হয় মজুরী-বেতন !
এইচ এম আলাউদ্দিন : চলতে চলতে থেমে গেলো শ্রমিক আন্দোলন। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ শ্রমিকরা। ঈদের পর থেকে খুলনা-যশোর অঞ্চলের কোন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলেই মজুরী-বেতন দেয়া হয়নি। সংসার চালাতে পাটকল শ্রমিকরা রিক্সা-ইজিবাইক চালাতেও বাধ্য হচ্ছেন। স্থায়ী শ্রমিকরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লেও বদলী শ্রমিকদের কেউ ঋণ বা দোকানে বাকীও দিচ্ছে না। ফলে তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। পাটকল শ্রমিকরা বলছেন, তাদের মজুরী যেন মৌসুমী মজুরীতে পরিণত হয়েছে। একবার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে সামনে রেখে আর একবার ঈদকে সামনে রেখেই দেয়া হচ্ছে পাটকল শ্রমিকদের মজুরী। বর্তমানে নয়টি পাটকলে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরী রয়েছে ৩২ কোটি ৫৬ লাখ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন ১০ কোটি ৮১ লাখ টাকা। পক্ষান্তরে নয়টি পাটকলে উৎপাদিত প্রায় তিনশ’ কোটি টাকার পণ্য পড়ে আছে বলে বিজেএমসির আঞ্চলিক সমন্বয়কারী জানিয়েছেন। তবে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের বকেয়া পরিশোধ করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার।
মজুরী কমিশন বাস্তবায়ন, পাটক্রয়ের অর্থ বরাদ্ধসহ ছয় দফা দাবিতে খুলনঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকলের শ্রমিকরা সর্বশেষ লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচী শুরু করে ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে। আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত এ কর্মসূচী চলার কথা। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের ব্যানারে ঘোষিত কর্মসূচীর মধ্যে ছিল ২০ সেপ্টেম্বর রাজপথে লাঠি মিছিল, ২১ সেপ্টেম্বর এক সাথে নরসিংদি ও খালিশপুরে শ্রমিক সমাবেশ, ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জুট মিলের সামনে গেট সভা ও শ্রমিক বিক্ষোভ, ২৩ সেপ্টেম্বর হাফিজুট মিলে সারা দেশের পাটকল শ্রমিক নেতাদের বৈঠক, ২৪ সেপ্টেম্বর আমিন জুট মিলে একই কর্মসুচি, ২৭ সেপ্টেম্বর রাজপথে কফিন মিছিল, ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল ৮ থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত রাজপথ, রেলপথ অবরোধ, ২ অক্টোবর আবারো রাজপথ রেলপথ অবরোধ এবং ৫ অক্টোবর পিপলস গোল চত্বরে শ্রমিক জনসভা ও পরবর্তি কর্মসুচি ঘোষনা। কিন্তু গত ২০ সেপ্টেম্বর লাঠি মিছিলের পর আর কোন কর্মসূচী পালিত হয়নি। ২০ সেপ্টেম্বরের পর পরিষদের আহবায়ক ও পাটকল শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সরদার মোতাহার উদ্দিন উদাসীন থাকেন। পরিষদের কার্যকরী আহবায়ক সোহরাব হোসেনও দায়িত্ব নিয়ে কোন কর্মসূচীর দিকে এগিয়ে আসতে পারেননি। সাধারণ শ্রমিকদের কাছে তিনি এ ব্যাপারে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন বলে শ্রমিকরা জানিয়েছেন। এ অবস্থায় সাধারণ শ্রমিকরা অনেকটা অভিভাবকহীন বলেই মনে হচ্ছে।
তবে পাটকল সিবিএ-ননসিবিএ পরিষদের ব্যানারের কর্মসূচীতে যোগ না দিলেও এ পরিষদের আহবায়ক সরদার মোতাহার উদ্দিন গতকাল সোমবার ঢাকায় পাটকল শ্রমিক লীগের একটি মিটিংয়ে যোগ দিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। পরিষদের বাইরে গিয়ে সরকারের সাথে যোগাযোগ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে পাকটল শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে পাটকল শ্রমিক লীগ ভূমিকা নিয়ে কৃতিত্ব দেখানোর চেষ্টা করছে বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। যেটি হতে পারে পারে আগামী নির্বাচনের আর একটি হাতিয়ার।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের সার্বিক অবস্থা দেখতে রোববার খালিশপুর প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল গেটে গিয়ে কথা হয় সাধারণ শ্রমিকদের সাথে। তারা জানান, পত্র-পত্রিকা বা মিডিয়াতে পাটকলের যে উন্নয়ন দেখা যায় বাস্তবে তা’ ভিন্ন। ঈদের ছুটির ১১ দিন পর মিলগুলোতে উৎপাদন শুরু হলেও মজুরী বেতনের কোন খবর নেই। পাটকল শ্রমিকরা যখনই আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে তখনই নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের দমিয়ে রাখা হয়। এখন আবার আন্দোলন কর্মসূচী শুরু করেও নেতারা পিছিয়ে গেলেন। এ অবস্থায় ‘সাধারণ শ্রমিকরা কোথায় যাবে’ এমন প্রশ্ন করে স্থায়ী শ্রমিক নুর ইসলাম বলেন, আসলে সাধারণ শ্রমিকদের যাওয়ার কোন জায়গা নেই। পাটকলগুলো পরিচালনার জন্য যে কোন প্রশাসন বা সরকারের নিয়ন্ত্রণে এটি পরিচালিত হয় বাস্তবে তা’ মনেই হয় না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
একই মিলের বদলী শ্রমিক নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রতিদিনই বদলী শ্রমিকরা এসে কান্নাকাটি করছে। তাদের কেউ বাকীতেও বাজার দিতে চায়না। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের আরও দুরবস্থা চলছে। বাসায়ও কাজ নেই। পুরুষ শ্রমিকরা যারা রিক্সা ইজিবাইক চালাতে চায় তাদের অনেকে পাচ্ছেও না। কেননা গ্যারেজগুলোতে রিক্সা-ইজিবাইকের চেয়ে চালক বেশি হয়ে গেছে। মোটা তাঁত বিভাগের বদলী শ্রমিক এমদাদুল হক কিডনি রোগে আক্রান্ত। বাসায় আয়ের অন্য কোন লোক নেই। প্রতি সপ্তাহে একবার ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে। সংসার, চিকিৎসা সবই চলছে ধার-দেনার ওপরে।
এ মিলের স্থায়ী শ্রমিক জাফর আহমেদের পাঁচ সদস্যের সংসারে চলছে চরম টানাপোড়েন। সকালে তিনি মিল গেটে আসেন না খেয়ে। দোকান থেকে একটি রুটি কিনে খেয়েই কাটিয়ে দেন পুরোদিন। মজুরী না পেয়ে রিক্সা চালিয়ে সংসার চালান বদলী শ্রমিক রুহুল আমিন। এলাচী নামের এক বদলী শ্রমিক জানান, ছেলে-মেয়ে বাঁচানোর কোন পথ নেই। না খেয়ে দিন চলছে। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিউলি নামের অপর বদলী শ্রমিকের। দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর ধরে বদলী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে এখন প্যারালাইসিসে আক্রান্ত নও মুসলিম মো: ওমর আলী। তিনি এখন মিলগেটেই কাটিয়ে দেন দিনের অধিকাংশ সময়। অন্যান্য শ্রমিকদের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়েই দিন চলছে তার।
এভাবে নানা দুর্ভোগ আর দুরাবস্থার মধ্যদিয়েই খুলনাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকদের দিন অতিবাহিত হচ্ছে। শ্রমিকদের পাশাপাশি শিল্পাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও চলছে হতাশা। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যেও ধস নেমেছে। খালিশপুরের চা দোকানদার জামাল হোসেন বলেন, মিলের মজুরী বেতন বন্ধ থাকায় তারও বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। সংসার চলছে না। অনেকে চা খেয়ে যাচ্ছেন পয়সা দিতে পারছেন না। শ্রমিকদের পাশাপাশি তারাও অনেকটা হতাশায় রয়েছেন বলেও জানান।
বিজেএমসির আঞ্চলিক অফিসের মহাব্যবস্থাপক(আরসিও) শে রহমতউল্লাহ বলেন, তিনশ’ কোটি টাকার পাটজাত পণ্য পড়ে থাকলেও নয় মিলে শ্রমিকদের মজুরী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া রয়েছে ৪৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে আলিম জুট মিলে ৮ সপ্তাহের মজুরী ও ৫ মাসের বেতন বাবদ মোট তিন কোটি ৩৮ লাখ, কার্পেটিংয়ে ৫ সপ্তাহের মজুরী ও ২ মাসের বেতন বাবদ এক কোটি ৩৪ লাখ, ক্রিসেন্টে ৬ সপ্তাহের মজুরী ও ২ মাসের বেতন বাবদ নয় কোটি ১০ লাখ, দৌলতপুর জুট মিলে ৫ সপ্তাহের মজুরী ও ৩ মাসের বেতন বাবদ এক কোটি ১৭ লাখ, ইষ্টার্ণ জুট মিলে ৮ সপ্তাহের মজুরী ও ৩ মাসের বেতন বাবদ চার কোটি ২৪ লাখ, জেজেআইতে ৭ সপ্তাহের মজুরী ও ২ মাসের বেতন বাবদ চার কোটি ৭৭ লাখ, খালিশপুর জুট মিলে ৩ সপ্তাহের মজুরী ও ২ মাসের বেতন বাবদ ২ কোটি ৭৫ লাখ, প্লাটিনাম জুট মিলে ৭ সপ্তাহের মজুরী ও ৩ মাসের বেতন বাবদ ৯ কোটি ৫১ লাখ এবং স্টার জুট মিলে ৭ সপ্তাহের মজুরী ও ২ মাসের বেতন বাবদ ৭ কোটি ১২ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে বলেও তিনি জানান।
বকেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, বিজেএমসির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। সেখান থেকে বলা হচ্ছে পণ্যবিক্রির টাকা দিয়ে ম্যানেজ করার জন্য। কিন্তু বিপুল পরিমান উৎপাদিত পণ্য পড়ে আছে অবিক্রিত অবস্থায়। তার পরেও সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আশা করছেন তিনি।
শ্রমিকদের পাওনার ব্যাপারে খুলনা বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক মো: মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক এবং বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেনের সাথে কথা হয়েছে। সব দিক দিয়েই সরকারের সাথে আলোচনার চেষ্টা চলছে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী দেশে ছিলেন না সেহেতু একটু সমস্যা হয়েছে। এখন দ্রুত একটি সমাধান আসবে বলেও তিনি আশা করছেন।
তবে বিজেএমসির পণ্য বিক্রির বিষয়টি আরও ত্বড়িত হওয়ার ব্যাপারেও সরকারের পক্ষ থেকে তাগিদ আসা উচিত বলেও অপর একটি সূত্র মনে করছে। যেখানে দেশের ব্যক্তি মালিকানাধীন পাটকলগুলোতে কোন পণ্যই পড়ে থাকে না, সেখানে রাষ্ট্রীয় মিলগুলোতে এমন অবস্থা কেন সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত বলেও সংশ্লিষ্ট মনে করেন।
শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-ননসিবিএ পরিষদের কার্যকরী আহবায়ক সোহরাব হোসেন বলেন, যেহেতু আহবায়ক সরদার মোতাহার উদ্দিন নিজে থেকেই কর্মসূচীর দিকে এগিয়ে আসছেন না সেহেতু তিনি এখন অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তার পরেও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী করনীয় নির্ধারণ করা হবে।

Please follow and like us:

Check Also

“নলতায় শ্রমিক দিবস পালিত “

প্রভাষক মামুন বিল্লাহ (কালিগঞ্জ সাতক্ষীরা)১লা মে বিকাল পাঁচটার সময় বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।