এম আকতার : রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে অর্থনীতিতে ধস নামার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই আশঙ্কা থেকে ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। এতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে কিছুটা ধীরগতি দেখা দিয়েছে। সরকারি হিসেবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লেও বিনিয়োগে গতি আসেনি। বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা কোনভাবেই কাটছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, গত অর্থবছরে চূড়ান্ত হিসাবে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৪১১ কোটি ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ২৩ লাখ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। কিন্তু চূড়ান্ত হিসাবে অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছওে প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি, রপ্তানির অবস্থাও ভালো নয়, রেমিট্যান্সে কিছুটা উন্নতি মনে হলেও কাক্সিক্ষত নয়। ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়লেও টাকা কোথায় যাচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই।
তিনি আরও বলেন,দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হবে। দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দেখা দিবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে। কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সবমিলিয়ে মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন ছিল তা দীর্ঘায়িত হবে।
বিবিএসের তথ্য মতে, জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ এখন ৩১ দশমিক ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ। এ ছাড়া গত অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে সরকারি বিনিয়োগ ৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর অংশ ছিল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে দশমিক ৫৬ শতাংশ। আগের অর্থবছরে জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র দশমিক ১৬ শতাংশ।
বিনিয়োগ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগে খুব বেশি অগ্রগতি নেই। এখনো সরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধিই চালিকাশক্তি।
তিনি বলেন, দেশে যখন ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ হয় না, তখন সরকারকে চালকের আসনে বসতে হয়। আমাদের অবস্থা এখন সে রকম হয়েছে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ হচ্ছে না দেশে। তাই সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা, অর্থের অপচয়সহ এমন নানা কারণে মূলধারার অর্থনীতিতে তার প্রকৃত সুফল মেলে না। বরং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়লে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে গতিশীল করে তোলে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগ লক্ষ্য জিডিপির অন্তত ৩৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও তা হয়েছে ৩১ দশমিক ২৩ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে এবং কাক্সিক্ষত মাত্রায় নয়।
বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগে গতিশীলতা না থাকায় এ নিয়ে হতাশার কথা বলছেন অনেকেই। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, মে ২০১৮ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৭৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা বিগত এক বছর আগেও ছিল তিনগুণেরও বেশি।
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ গত এক দশকে হতাশাজনকই ছিল। গত দুই বছরে জিডিপির অনুপাতে সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে ১ দশমিক ৩১ শতাংশ, বিপরীতে বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র দশমিক ২৭ শতাংশ।
এ ছাড়াও কাক্সিক্ষত হারে আসছে না বৈদেশিক বিনিয়োগও। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখনো বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে আস্থা সংকট কাটেনি বেসরকারি খাতের। প্রতিযোগী ও প্রতিবেশী দেশের চাইতে বিনিয়োগ আকর্ষণে পিছিয়ে বাংলাদেশ। ইজি অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে এখনো কাক্সক্ষতি উন্নয়ন ঘটেনি বাংলাদেশের। এ ছাড়াও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারা, অবকাঠামো দুর্বলতাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বাড়ছে না বেসরকারি বিনিয়োগ। আবার নির্বাচনী অর্থবছরে আরও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে বিনিয়োগ নিয়ে অনেকেই সিদ্ধান্তহীনতায় থাকেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে অর্থনীতিতে ধস নামার আশঙ্কা করছেন। ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। এতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে কিছুটা ধীরগতি দেখা দিয়েছে। মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী রাজ্জাক মোল্লা এভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি হুমকিতে ব্যবসায়ীরা সবাই উদ্বিগ্ন। এ দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক সংকট অতীতে আর কথনও দেখা যায়নি বাংলাদেশে। দেশে এই চলমান রাজনৈতিক সংকটে কি করবে ব্যবসায়ীরা তা বুঝতে পারছে না তারা। বিনিয়োগ না কলে হাত গুটিয়ে বসে থেকে আর কত সময় কাটাবে তারা।
তারা বলেন,এরকম রাজনৈতিক সংকটে বিনিয়োগ করা ঝুকি। তাই ভেবে চিন্তে তারা বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু এভাবে আর কত াদন যাবে। সংকট সমাধানে কোন পথ নেই। আপাতো দৃষ্টিতে দেশের প্রবৃদ্ধি হলেও বেসরকারি বিনিয়োগ তেম নেই বললেই চলে। সরকারি বিনিয়োগেই জিডিপি বাড়ছে। এতে করে তেমন কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদদের অভিমত, খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কায় ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক লেনদেনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে এরই মধ্যে এক ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু করেছে। যা রাজনৈতিক অস্থিরতার মেয়াদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কতটা দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতা সৃষ্টি হবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত পর্যবেক্ষকরা। তাদের ধারণা, খালেদা জিয়া কারাবন্দীর পরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ বেশখানিকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন হলে বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মর্যদা ক্ষুণœ হবে। যার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিকভাবে পড়বে। গোটা দেশ অনিবার্য সংঘাতের পথে এগোবে।
বিশিষ্টজনরা বলেছেন, একতরফা নির্বাচন হলে দেশে বড় ধরনের সংঘাত তো বটেই, যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা চিন্তাও করা যাচ্ছে না। আর সত্যিকার অর্থে সে পরিস্থিতি তৈরি হলে তাতে কেবল দেশের জনগণই নয়, বড় রাজনৈতিক দলগুলোকেও চড়া মূল্য দিতে হবে। দেশের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র এবং জনগণের জান-মাল ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দেবে। গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। দেশের অর্থনীতির চাকা এখন শ্লথগতিতে ঘুরলেও তা স্থবির হয়ে পড়ারও শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে প্রয়োজন বড় দুই রাজনৈতিক দলের সমঝোতা। এতদিন ব্যবসায়ীরা সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। অথচ সেদিকে পরিস্থিতি তো এগোইনি, উল্টো বিএনপি চেয়ারপারসনের দুর্নীতির মামলার রায় নিয়ে তা আরও ঘোলাটে হচ্ছে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র এক সাবেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কায় আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। কেননা আত্মর্জাতিক বাণিজ্য নির্ভর করে ইমেজের ওপর। রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল কোনো দেশে বায়াররা কাজ দিতে চান না। তাই তারা খালেদা জিয়ার রায় পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি হয় তা পর্যবেক্ষণ করছেন।
এদিকে আশু পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠায় রয়েছেন পরিবহন মালিকরা। তারা বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার ঘোষণা দিলেও তাতে কেউ নিরাপত্তা বোধ করছেন না। ১৯১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে-পরে সরকার সাজ সাজ নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করলেও তার মধ্যেই দুষ্কৃতকারীরা বিপুলসংখ্যক যানবাহন ভাঙচুর করে। যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা ঘটে।
অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, দেশের রাজনৈতিক সংকট অর্থনৈতিক সংকটে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। যদি দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটে, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মধ্যমেয়াদি সংকটে ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।
তারা মনে করেন, বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বলতম বিষয় হলো বিনিয়োগ হারের পতন। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ। তবে ব্যক্তি খাতে পতন হলেও সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে মোট বিনিয়োগ কিছুটা স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে। অথচ নির্বাচনী বছরে সরকারি খাতের বিনিয়োগও নিম্নমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই চলতি বছরে মোট বিনিয়োগে হারের পতন ঘটতে পারে।
Check Also
তাবলীগ জামায়াতের সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ-সমাবেশ
মুহাম্মদ হাফিজ, সাতক্ষীরা : তাবলীগ জামাতে সাদপন্থীদের বর্বোরিচত হামলার প্রতিবাদ ও সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগের সহসভাপতি …