মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী কৃষি শ্রমিকরা

নূরে আলম : উপকূলে নারী-অবহেলা, বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার ভাগ্য বিড়ম্বিত এক জীবন। যে জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই সমাধান। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে সংসারের বোঝা চাপে নারীর ওপর। পুরুষবিহীন সংসারে নারী হয়ে ওঠেন পরিবারের প্রধান। অথচ কোথাও নেই এতটুকু স্বীকৃতি। তবুও টিকে থাকার লড়াইয়ে সে শামিল হয়। জাতীয় মহিলা সংস্থার সূত্রে এই সব তথ্য জানাযায়। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ শ্রমশক্তি বিষয়ক এক জরিপ বলছে, কৃষি অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান ৬৪.৪ শতাংশ এবং পুরুষের অবদান ৫২.৮ শতাংশ। বিবিএসের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক দশকের ব্যবধানে দেশের কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০২ শতাংশ। সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে ২ শতাংশ। ২০০০ সালে দেশের কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৫ লাখে। প্রতিবেদন বলছে, ১০ বছরের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ নারী কৃষিতে যুক্ত হয়েছেন। কৃষির বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রমবিভাজনের কারণে নারী শ্রমিকের চাহিদা বেড়েছে। বেশিরভাগ পুরুষ পেশা পরিবর্তন করে অ-কৃষিকাজে নিয়োজিত হচ্ছেন, কিংবা গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন শহরে। এই প্রতিবেদনে উপকূল এলাকার প্রতিফলন রয়েছে।
ক্ষেতে ধান কাটায় ব্যস্ত নারী। পেছনে পাহারায় কয়েকজন পুরুষ। কাজে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে কি না দেখার জন্য নজরদারি করছে তারা। ধানের মৌসুমে মাঠের পর মাঠ পাকা ধান। কাটার লোকের অভাব বলে নারীরা এই কাজে নিয়োজিত হয়। নিম্ন আয়ের পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন কাটিয়ে উঠতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজে যোগ দেন। আমন ধানের মৌসুমে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার তমরুদ্দি ইউনিয়নের বেজুগালিয়া গ্রামে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। উপকূলের আরও অনেক স্থানে ধান ক্ষেতে নারী কৃষকদের চোখে পড়ে।  সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, শুধু ধান কাটা নয়, ধানের চারা রোপণ, ধান শুকানো, ধান মাড়াই, সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে সম্পৃক্ত উপকূলের নারী। পুরুষের অনুপস্থিতিতে নারী প্রধান পরিবারের ব্যক্তি নারী প্রধানত কৃষি কাজের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। শুধু উৎপাদন নয়, একাধারে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত নারীরা। খাঁটুনি বেশি, কাজে ফাঁকির সুযোগ নেই, আবার কাজের সময়সীমাও বেশি- অথচ মজুরি কম। কৃষিতে নারীর অবদানের কোন স্বীকৃতিও নেই।
উপকূলীয় দ্বীপ হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ফসলের মাঠে নারী কৃষকের দেখা মেলে। অন্যান্য স্থানে সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালন, মৎস্য খামার পরিচালনা, হাঁস-মুরগি পালন, ফসলের ক্ষেত নিড়ানি, মাঠের ফসল ঘরে তোলা ইত্যাদি কাজে অসংখ্য নারীকে দেখা যায়। নারী কৃষক সীতা রাণী বলেন, পুরুষের চেয়ে আমরা বেশি কাজ করি। কাজে ফাঁকি দেই না। বিড়ি-সিগারেট টানতে আমাদের সময় অপচয় হয় না। সময় ধরে কাজে আসতে হয়, যেতে হয়। তবুও আমাদের মজুরি কম। মালিক বলে, আমরা নারী, আমরা পুরুষের মত কাজ পারি না। হাতিয়ার তমরুদ্দি, সুখচর, নলচিরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জাতীয় মহিলা সংস্থা বলেন, এখানে নদী ভাঙনের কারণে বহু মানুষ বাপদাদার ভিটে হারিয়ে পথে বসেছেন। অনেকে হারিয়েছেন কাজের সুযোগ। ধারদেনা করে চলা এই অভাবী পরিবারগুলো চালিয়ে নিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বাইরের কাজে নেমেছেন। নারীদের এই রোজগার পরিবারের অনটন ঠেকাতে সহায়তা করে। কিন্তু বাইরে নারীদের কাজের পরিবেশ নেই, তারা পাচ্ছেন না ন্যায্য মজুরি। কোথাও কোথাও পুরুষের অর্ধেক মজুরি দেয়া হয় তাদের। ভূমি মালিকদের অনেক লাঞ্ছনাও সইতে হয়।
ভয়াল নদীতীরের গ্রাম তমরুদ্দিনের কোড়ালিয়া। এখানে বেড়িবাঁধের পাশে বসবাস করে জলদাস সম্প্রদায়ের মানুষ। এই সম্প্রদায়ের নারী সুলেখা জলদাস, শোভা জলদাস, সাবিত্রি জলদাসসহ আরও অনেকেই কৃষি শ্রমিকের কাজের সাথে জড়িত। তারা বলেন, নদীতে মাছধরা আমাদের পূর্ব পুরুষের পেশা। বহুকাল আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজন মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে। কিন্তু নদীর ভাঙনের  কারণে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। নদীতে আগের মত মাছও পাওয়া যায় না। ছেলেপেলে নিয়ে আমরা খাবো কী? তাই ঘরের নারীরা বাইরে কাজ করতে বাধ্য হয়। ক্ষেতখামারের কাজে আমরা অভ্যস্ত নই। তবুও করতে হয়।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর এই এলাকায় অনেক বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, হাতিয়ার কোন কোন এলাকায় শতকরা ৫০ শতাংশ নারী ঘরের বাইরের কাজে নিয়োজিত। কৃষি মাঠে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাসন্তী রাণী দাস কিছুটা ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, কাজের মৌসুমে বাড়তি মজুরি পাওয়ার আশায় এই এলাকার পুরুষেরা ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজে যায়। ফলে এলাকায় পুরুষ কৃষি মজুরের সংখ্যা কমে যায়। তখন ভূমি মালিকেরা মাঠের কাজে টানেন নারীদের। আবার সংসারের অভাব ঠেকাতে নারীরাও সেই ডাকে সাড়া দিয়ে কাজে নামেন। এভাবেই হাতিয়া অঞ্চলে নারী কৃষকের সংখ্যা বেড়ে যায়। পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে পাওয়া যায় বলে ধান রোপণ, ফসলি ক্ষেতে নিড়ানি দেওয়া, ধানকাটা ইত্যাদি কাজে নারী শ্রমিকের চাহিদাও বেড়েছে।
চট্টগ্রামের সীতাকু-, নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরলক্ষ্মী, বয়ারচর, লক্ষ্মীপুরের রামগতির আলেকজান্ডার, ভোলার দ্বীপ কাচিয়া, মদনপুরা, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরাসহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় কৃষি ক্ষেতে নারীদের কাজ করতে দেখা যায় বলে জানায় জাতীয় মহিলা সংস্থা। তবে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্রিকার এক গবেষণাসূত্র বলছে, বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ গ্রামীণ নারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে জড়িত।
গ্রামীণ জীবনযাত্রায় স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান বিষয়ক প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে মোট নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৬২ লাখ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী। যার ৬৮ শতাংশ কৃষিকাজ করে। কাজের মধ্যে রয়েছে পোল্ট্রি, বনায়ন, চাষাবাদ, মৎস্য খাতের বিভিন্ন কাজ ইত্যাদি। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, কৃষি খাতে নিয়োজিত পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি। এছাড়া কর্মক্ষম নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত কৃষি কাজে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্রামীণ ৪১ শতাংশ নারী চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত। শ্রম জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, গৃহপালিত পশু, হাঁস-মুরগির খামার, ধান ভানা, সিদ্ধ করা, শুকানো, ঝাড়া, প্রক্রিয়াজাতকরণ, খাদ্য সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজে জড়িত নারী। কৃষি তথ্য সার্ভিসের উপ-পরিচালক (গণযোগাযোগ) কৃষিবিদ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ফসল উৎপাদনের ২১টি ধাপের ১৭টিতেই নারীর সরাসরি অংশগ্রণ রয়েছে। এত কাজ করার পরও নারীর কাজকে কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় না অনেক ক্ষেত্রে। তবে নারী কৃষকদের দাবি ওঠে ঢাকায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড-বাংলাদেশ আয়োজিত জাতীয় নারী কৃষক সম্মেলনে। এতে বলা হয়, নারী কৃষক ও ক্ষেতমজুরকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা কোনোভাবেই নিশ্চিত ও দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব না। এ কারণে, নারী কৃষকের রাষ্ট্রীয় অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত এখন সময়ের দাবি। নারী কৃষকদের অধিকার নিয়ে স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ হয়। তারা বলেন, জাতীয় কৃষি নীতিমালায় নারী কৃষকের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা সংযুক্ত করে ‘কৃষক’ হিসেবে নারীদের কৃষি উপকরণ সেবা প্রাপ্তিতে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে। তাদের কাছে কৃষি সংক্রান্ত সব তথ্য পৌঁছাতে হবে। প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থায় গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে যথাযথ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তারা বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের ভূমি মালিকেরা যাতে নারী কৃষকদের ন্যায্য মজুরি দিতে বাধ্য হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে নারী কৃষকদের সংগঠন গড়ে তোলাও জরুরি।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।