আসাদুজ্জামান সরদার: সদর উপজেলা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ও প্রকৃতি ঘেরা দেবহাটা। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী এই উপজেলায় আছে ঐতিহ্যবাহী বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান আর প্রাচীন ও প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। এখানে ইছামতি নদী ও রূপসী দেবহাটা ম্যানগ্রোভ পর্যটন কেন্দ্রের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন পর্যটকরা। এছাড়া বিস্তীর্ণ বটগাছ আর ১৮ জমিদারের স্মৃতিবিজড়িত টাউন শ্রীপুর গ্রামে দর্শণার্থীদের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
দেবহাটা উপজেলায় সীমান্ত ঘেঁষে বাংলাদেশ-ভারতের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা ইছামতি নদী পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। এই নদীর তীরে টাকির ঘাটে প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় দুই বাংলার মিলনমেলার তরী ভাসে। ভ্রমণপিপাসুরা এখানে পিকনিক ও বেড়ানোর জন্য ভিড় জমায়।
দেবহাটা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শিবনগর গ্রামে ৩১ দশমিক ৪৬ একর জমির ওপর প্রায় পাঁচ বছর আগে চিত্তবিনোদনের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয় ‘রূপসী দেবহাটা ম্যানগ্রোভ পর্যটন কেন্দ্র’। পিকনিক স্পট হিসেবে সুন্দরবনের আদলের এই জায়গা বেশ জনপ্রিয়। তৎকালীন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার এটি উদ্বোধন করেন। সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এনে রোপণের পাশাপাশি এখানে খনন করা হয় একটি দীঘি। এছাড়া আছে একটি রেস্টহাউজ।
বর্তমান ইউএনও’র উদ্যোগে এই পর্যটন কেন্দ্রকে আরও নয়নাভিরাম করে তুলতে ট্রেইল নির্মাণ, দীঘিতে প্যাডেল বোট রাখা, পাকা বেঞ্চ নির্মাণসহ বাঘ, হরিণ, কুমির, বানরসহ বিভিন্ন পশু-পাখির কৃত্রিম ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। শিশু কর্নারে বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী ও পর্যটকদের বসার জন্য রয়েছে ১০টি গোলঘর। আগামীতে এখানে শিশুদের উপযোগী ট্রেন, ক্যাবল কার ও মিনি চিড়িয়াখানা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে উপজেলা প্রশাসনের।
বনবিবির বটতলা দেবহাটার কাছেই প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমির ওপর একটি বিস্তৃত বটগাছ দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা আসে। এর শাখা-প্রশাখা শিকড় থেকে বিরাট রূপ লাভ করেছে। এই জায়গা স্থানীয়ভাবে ‘বটতলা’ ও ‘বনবিবিতলা’ নামে পরিচিত। স্থানীয়দের ধারণা, সাধু-সন্ন্যাসীরা এখানে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তারা দেবদেবীর পূজা-অর্চনা করতেন। বর্তমানে সাধু-সন্ন্যাসীদের ধ্যান আর পূজা-অর্চনা দেখা না গেলেও স্থানীয় জনসাধারণের উদ্যোগে বটগাছের নিচে প্রতি বছর পহেলা মাঘে হাজত মেলা হয়ে থাকে। এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে এখানে জমে ওঠে বৈশাখী মেলা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাফিজ-আল আসাদ জানান, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে দেবহাটার গুরুত্ব অনেক। একসময়ের দেবহাটা গ্রাম এখন উপজেলা সদর।
সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে ইছামতি নদীর তীর ঘেঁষা গ্রামটির নাম টাউন শ্রীপুর। সেখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের পৈতৃক নিবাস ছিল। ১৮৬৭ সালে টাউন শ্রীপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত দেবহাটা হলো খুলনা বিভাগের প্রাচীনতম পৌরসভা। তখন খুলনায়ও পৌরসভা ছিল না। ব্রিটিশ শাসনামলে টাউন শ্রীপুরকে বলা হতো এখানকার বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। এই জায়গা এখন পৌরসভা থেকে অনুন্নত গ্রামে রূপ নিয়েছে।
১৮ জমিদারের বাস ছিল টাউন শ্রীপুর গ্রামে। তবে কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে গেছে। জনশ্রুতি আছে, এখানকার কোনও কোনও জমিদার ছিলেন অত্যাচারী, আবার কেউ কেউ মানবদরদী হিসেবে সুনাম কুড়ান। তাদের অনেকে জমিদার সমাজে কিছু অবদানও রেখে গেছেন। দেবহাটার টাউন শ্রীপুরে জমিদারদের বিশাল অট্টালিকা, পূজা, মন্দির ও থিয়েটার রুমের এখন কোনও অস্তিত্ব নেই।
ইছামতি নদীর তীরঘেঁষে টাউন শ্রীপুর, সুশীলগাঁতী ও দেবহাটা পাশাপাশি তিনটি গ্রাম। ইছামতির ওপারে ভারতের হাসনাবাদ রেলস্টেশন। মূলত এজন্যই ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলে মানুষের দ্বিতীয় ঠিকানা ছিল কলকাতা।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. ইফতেখার হোসেন আশ্বাস দিয়েছেন, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মুগ্ধ করতে আরও সৌন্দর্যময় করা হবে রূপসী দেবহাটা ম্যানগ্রোভ। পাশাপাশি ঐতিহাসিক নিদর্শন, বনবিবির বটতলা, টাকির ঘাটসহ অন্যান্য পর্যটক কেন্দ্রগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করতে পর্যটন করপোরশনের সহযোগিতা চেয়েছে ডিসি। এসব স্থান ঘুরে যেতে পর্যটকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।