নূরে আলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে: মোমেনা ও রশিদ দু’জনই চাতাল শ্রমিক। নিজেদের মাঝে রয়েছে আত্মীয়তার সম্পর্কও। দিন-রাত সমান তালে একসঙ্গে চাতালের ধান সিদ্ধ-শুকানো, চাল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করেন। কিন্তু মোমেনার মজুরি রশিদের অর্ধেকেরও কম। শুধু মোমেনাই নন-এরকম অর্ধেক মজুরি নিয়েই কাজ করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৫ শতাধিক চাতালের প্রায় ২৫ হাজার নারী শ্রমিক। বিষয়টি বুঝলেও তা নিয়ে নারী শ্রমিকরা কখনও প্রতিবাদ করেননি কিংবা করার ইচ্ছাও পোষণ করেননি। ফলে নারী শ্রমিকদের এ বঞ্চনার কথা অজানা সংশ্নিষ্টদেরও। এমনকি শিক্ষা স্বাস্থ্য মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত চাতাল নারীদের সন্তানেরা। মজুরিবৈষম্যে চাতালের ৬০ শতাংশ নারী শ্রমিক। মজুরি বৈষম্যের এ তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) সাম্প্রতিক এক গবেষণায়ও। তারা দেখিয়েছে, চাতালে নারী শ্রমিকের ৬০ শতাংশই উচ্চমাত্রার মজুরি বৈষম্যের শিকার। এসব নারী শ্রমিক দৈনিক গড়ে ১৩৬ টাকা মজুরি পেলেও পুরুষরা পাচ্ছেন ১৮৫ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত।
জানা গেছে, দেশের সর্ববৃহৎ চাল উৎপাদনের কেন্দ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তিতাস নদীর পাড়ে ও আশুগঞ্জে রয়েছে ৫ শতাধিক চাতালে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিকের অর্ধেকই নারী। তারা হতদরিদ্র ও প্রায় সবাই নিরক্ষর। চাতালের সার্বক্ষণিক শ্রমিক হলেও সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে তারা বেশির ভাগ নারী শ্রমিক স্বামী, পুত্র বা পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে কাজ করেন। তবে এককভাবে কাজ করেন এমন নারী শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক। সাধারণত চাতালে শ্রমিকরা অগ্রিম দাদন নিয়ে মিল মালিকদের সঙ্গে ‘কাজ নেই মজুরি নেই’ এ চুক্তিতে কাজ করে। ধানের মাঠ হিসেবে মাঠ-সর্দাররা শ্রমিকদের মজুরি বণ্টন করে। জানা গেছে, পুরুষ শ্রমিকদের দৈনিক হাজিরা ২শ’ টাকা হলেও নারী শ্রমিকের মজুরি হাজিরা পড়ে ৫০ টাকার কম। পুরুষ শ্রমিকদের কথা, নারী শ্রমিকরা ট্রাকে ধান-চাল ওঠানামা বা বোঝা বহনের কাজ করতে পারে না। আর নারী শ্রমিকরা তাদের নিজেদের লোক। তবে নারী শ্রমিকদের দাবি, তারা বোঝা বহনের কাজ না করলেও মাঠের কাজ যেমন- ধান শুকানো, চাল তৈরি বা প্রক্রিয়াকরণে বেশি সময় দেন। আবার লট হিসেবে চুক্তিতে একজন নারী শ্রমিক ২০০ থেকে ৪০০ মণ পর্যন্ত ধান সিদ্ধ ও শুকানোর কাজে সহযোগিতা করে মজুরি হিসেবে পান ১৫০ টাকা ও সাত কেজি চাল। এ চুক্তিতে পুরুষ শ্রমিকরা পান লট হিসেবে ৭০০-৮০০ টাকা।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ধানের চাতাল খ্যাত জেলার অন্যতম চাতালের ব্যবসা এক সময় জমজমাট ভাবে চলতো। মাত্র ৩-৪ বছর আগেও অত্র এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে আগ্রহ ছিল মিল চাতাল ব্যবসার মধ্যে। ৩-৪ বছরের ব্যবধানে এলাকার কিছু মিল চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। এসব মিল চাতালে নারী শ্রমিকরাই বেশি কাজ করে থাকে। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারী শ্রমিকরা শ্রম দিলেও মজুরি পায় মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। তবুও কাজের অভাবে এলাকার নারী শ্রমিকরা মিল চাতালগুলোতে তাদের শ্রম বিক্রয় করে থাকে। অনেক মিল চাতালে চুক্তিভিত্তিক শ্রম বিনিময় হয়ে থাকে। অর্থাৎ ধান হাউজে ভিজানো থেকে শুরু করে ধান ভাঙিয়ে চালে পরিণত করা পর্যন্ত মন প্রতি একটি নির্দিষ্ট রেটে অনেক মিলে শ্রমিকদের কাজ করানো হয়। ক্ষেত্রে বিরূপ আবহাওয়ার জন্য কাজে ব্যাঘাত ঘটে বিধায় দৈনিক শ্রম বিক্রিতেই শ্রমিকরা বেশি ঝুঁকে পড়ে।
এদিকে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, মজুরি বৈষম্য কখনো কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে আইনের পাশাপাশি প্রত্যেকের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ জাগাতে হবে। এ ব্যাপারে হিমেল রাইস মিলের নারী শ্রমিক রহিমা, ছোফেরা, আবেদিন রাইস মিলের রতœা, কহিনূর, হক রাইস মিলের বাসনা ও অঞ্জনা জানান, বোঝা বহনের কাজটি পুরুষরা করে বলে আমরা কাজ কম করি তা ঠিক নয়। আমরা তো মাঠের কাজ বেশি করি।
চাতাল শ্রমিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আব্বাস সরদার জানান, নারী শ্রমিকরা কিছু কাজ না করায় হাজিরা কম দেওয়া হয়। তবে তাদের হাজিরা বাড়ানো দরকার।
মানবাধিকার আইনজীবি শেখ মকবুল হোসেন মনে করেন মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হলে শ্রম বৈষম্য নিরসন হবে। জেলার চাতাল মালিক সমিতির সভাপতি জিয়াউল করিম সাজু খান বলেন, মিল মালিকরা নির্ধারিত চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করেন। নিজেদের মাঝে কীভাবে এ মজুরি বন্টন হবে সেটা শ্রমিকদের একান্ত ও নিজস্ব বিষয়।
Check Also
২০২৫-২০২৬ সেশনের কালিগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের ০৯টি ইউনিয়নের আমীরগণের শফথ গ্রহণ
ড. মিজান সাংবাদিক কালিগঞ্জ: আজ ২২ ডিসেম্বর বিকাল ০৪ টায় উপজেলা জামায়াত অফিসে ০৯ টি …