ক্রাইমবার্তা রিপোটঃনির্বাচনের দামামা বাঁজছে। সংবিধানের বিধান অনুয়ায়ী আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন দাবী করছে তারা রোডম্যাপ অনুযায়ী ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার বিরোধের সুরাহা এখনো হয়নি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অংশিজনের বিরোধ মেটানো দূরের কথা; বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ইভিএম ব্যবহারের একগুয়েমি, নানামুখী কথাবার্তা এবং ইসি’র অভ্যন্তরীণ মতভেদ এখন ওপেন সিক্রেট। ইসির চারজন কমিশনার অভিযোগ করেছেন তাদের না জানিয়ে সিইসি ও কমিশন সচিব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। যা তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় তারা ইসির স্বচ্ছতার জন্যই ওই সব অজানা বিষয়ে জানতে লিখিত ভাবে আবেদন করেছেন। এরই মধ্যে আগামী ১৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন সভা ডেকেছে। ওই সভায় কমিশনারদের নির্বাচনে প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করা হবে। অন্যদিকে সিইসি নিজেই কর্মের চেয়ে বেশি কথাবার্তা বলছেন বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তাদের শঙ্কা এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে তো? এই ইসি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবো তো?
সুত্র জানায়, একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২২ সেপ্টেম্বর ইসি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। এই বিষয়ে চার কমিশনারকে আড়াল করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিইসি ও সচিব থাকলেও অন্য চার কমিশনারের কাউকে দেখা যায়নি। এই প্রশিক্ষণের বিষয়ে তাদের মতামত গ্রহণ এবং আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বর্তমান ইসির নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক নিবার্চন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমরা পত্রিকায় দেখতে পেয়েছি আর পিও সংশোধন করবেন। এটাই সংশোধন করলে হবে না, আগে দেখতে হবে সমস্যা কি কি রয়েছে। সেগুলো আগে আমলে আনতে হবে। বর্তমান একাদশ জাতীয় নির্বাচন কি ভাবে কমিশন করবে তা আমার জানা নাই। গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন করতে হলে আগে ইসি’র পলিসি ঠিক করতে হবে। রাজনীতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা অর্জন করতে হবে। তা না করে যদি শুধু ব্যালেট পেপার ছাপানো ভোট হয়ে থাকলে তা করবে।
ইসি সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ গত ৩০ আগস্ট কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় আরপিওতে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার সরাসরি বিরোধিতা করেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। এর পরে ইসি সচিবালয়ের কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করে চার কমিশনার নোট দেন। এতে তারা ইসি সচিবালয়ের কার্যপ্রণালি বিধি মেনে সব ফাইল কমিশনারদের কাছে উপস্থাপনের নির্দেশনা দেন। পাঁচ সদস্যের কমিশন সদস্যদের মধ্যে নানা বিষয়ে বিরোধের কারণে গত এক মাসে নিজেদের মধ্যে মুখ দেখাদেখিও প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে গত মঙ্গলবার সিইসি অন্য চার কমিশনারকে চায়ের দাওয়াত দেন। পাশাপাশি ইসি সচিবালয়ের সব কার্যক্রম পরিচালনায় আইন ও বিধিমালা অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে একটি অফিস আদেশও জারি করা হয়।
ইসির সিনিয়র সহকারী সচিব মোঃ শাহ আলমের সই করা অফিস আদেশে বলা হয়, ইসি সচিবালয়ের সব কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন বিধি-বিধান, রীতি, পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। সচিবালয়ের কিছু কিছু কার্যক্রম ইসি সচিবালয় আইন ও কার্যপ্রণালি বিধিমালা এবং এর বিধি-বিধানের ব্যত্যয় ঘটেছে, যা চার নির্বাচন কমিশনারের নজরে এসেছে। এ-সংক্রান্ত বিধি-বিধান প্রতিপালন করে ইসি সচিবালয়ের সব কাজ পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন নির্দেশনা দিয়েছে। এরপর বরফ গলতে শুরু করলেও নতুন করে নির্বাচনকালে এমপিদের ক্ষমতা খর্ব করার প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছেন কমিশন সদস্যরা। তবে এ নিয়ে তারা প্রকাশ্যে কেউই মুখ খুলছেন না। সন্দেহ করছেন একে অপরকে। এর আগে অভিযোগ উঠেছিল, ইসি সচিবালয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে সিইসি ও সচিব ছাড়া অন্য কমিশনারদের এড়িয়ে চলা হচ্ছে। কিছু কিছু কার্যক্রমে ‘বিধি-বিধানের ব্যত্যয় ঘটেছে› উল্লেখ করে চার নির্বাচন কমিশনারের আন-অফিসিয়াল (ইউও) নোট দিয়েছিলেন। ওই নোটে বলা হয়, যে পদ্ধতিতেই নিষ্পত্তি করা হোক না কেন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে বিষয়াদি নিষ্পত্তি করার বিধান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
জানতে চাইলে ব্রতির চেয়ারম্যান শারমীন মুর্শিদ বলেন, আমার মনে হয় নির্বাচনের জন্য কমিশন একাদশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়। সিলেট ও সুনামগঞ্জে দেয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য শুনে আমি অবাক হয়েছে। তার বক্তব্য মানুষের মাঝে খুব চিন্তায় ফেলেছে। কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে দেশে নির্বাচন কবে হবে তা স্পষ্ট দেশের জনগণকে জানা। সেটা না করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই বলেন, নির্বাচন কবে হবে তা জানেন না, যদি তিনি না জানেন, তা হলে জানে কে? সেটা দেশের জনগনকে বলতে হবে। আসলে কমিশন কি করতে চায়ও সেটা স্পষ্ট করতে হবে। এই সময়ে এসে তিনি কেন এধরণের কথা বলছে। তা জনগণের মাঝে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারে উপদেষ্টা নিয়োগে আইনগত কোনো বাধা নেই। কারণ সংবিধানে এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। কিন্তু কোনোভাবেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিবে না। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কোনো দাবিও ক্ষমতাসীনরা মানবে না বলে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, এবার সবার দাবি হওয়া উচিৎ একটাই, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। আমরা আগে থেকে বলেছি কমিশন সংস্কার করতে হবে। তার আগে জাতীয় নিবাচন করা ঠিক হবে না। ইসি কী করছে আমরা বুঝতে পারছি না।
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ এখনও অনিশ্চিত। বর্তমান ইসির আয়োজনে সংলাপে অংশ নিলেও সদ্য সমাপ্ত সিটি ভোটে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে কে. এম. নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রতি আস্থাহীনতার কথা বলছেন দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর ইসি সদস্যরা বলেছিলেন, সব দলকে আস্থায় নিয়েই তারা সংসদ নির্বাচন করবেন। কাজের মাধ্যমেই তারা সবার আস্থা অর্জন করতে চান। অথচ এখনো তারা আস্থা অর্জন করতে পারেননি।
নির্বাচনের প্রস্ততির বিষয়ে এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা বলেছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগেই একাদশ সংসদ নির্বাচন শেষ করতে হবে। তাই অক্টোবরের দিকে তফসিল ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে। ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির শুরুতে ভোটের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হবে। এদিকে, কারিগরি প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকলেও সদ্য সমাপ্ত পাঁচ সিটি নির্বাচনের পর থেকে কমিশন সদস্যদের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে মতবিরোধ প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। যদিও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, তাদের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও মতবিরোধ নেই। তার দাবি, পাঁচ নির্বাচন কমিশনার মিলে একক সত্তা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, তারা দেশবাসীকে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে বদ্ধপরিকর। সাংবিধানিকভাবে তারা দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেতন রয়েছেন।
সুজন সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা নির্বাচন বিশেষজ্ঞ হাফিজ উদ্দিন আহমদ মনে করেন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনে এ মুহূর্তে জনগণের আন্দোলনে নামা উচিৎ। সেই সাথে ইভিএম সংযুক্ত করে আরপিও সংশোধন করা ঠিক হবে না। ইসির ওইদিকে যাওয়াই উচিত নয়। জাতীয় নিবাচন সুষ্ঠু হবে কি না সে বিষয়ে কমিশনকে আগে নিশ্চয়তা দিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, জনগণের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। যদি সত্যিকার অর্থেই তারা মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেন, তাহলে তারা জনগণকে বিপদে ফেলবেন কেন? #dailyinqilab