জিল্লুর রহমান: ক্রাইমর্বাতা রির্পোট: খুলনা: ভয়াবহ দূষণের কবলে খুলনার খরস্রোতা ময়ূরি নদী। গতি, ছন্দ, সম্পদ আর সৌন্দর্য হারিয়ে এখন অস্তিত্ব বিলিন। ড্রেনের বিষাক্ত পানি, বর্জ্য আর দখলে এটি এতই রুগ্ণ হয়ে পড়েছে যে, অবিলম্বে নদী উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবী খুলনা বাসীর।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের,২৬টি ড্রেনের সাথে সংযুক্ত ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ ময়ূর নদী আজ ভয়াবহ দূষনের কবলে। ২০টি ড্রেনের নোংরা পানি সরাসরি গিয়ে পড়ছে ময়ূর নদীতে। এ ছাড়া গল্লামারী বাজার ও আশপাশের এলাকার লোকজন অবাধে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে নদীটিতে। তাই এ নদীর পানির রঙ এখন কুচকুচে কালো। কোনো কোনো এলাকায় দুর্গন্ধে টেকা দায়। ময়লা-আবর্জনা ও পলির স্তূপে নাব্য হারিয়েছে নদী। সেই সঙ্গে অবৈধ দখলের কারণে সংকুচিত হচ্ছে এর আয়তন। নদীর দুই তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অনেক পাকা স্থাপনা। কোথাও মাটির বাঁধ দিয়ে আবার কোথাও বাঁশের বেড়া দিয়ে নদীর জায়গা দখল করেছে প্রভাবশালীরা। অথচ এই দখল, দূষণের কবল থেকে ময়ূর নদী রক্ষায় সরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ নেই এখনও।
নদী তীরের বাসিন্দারা জানালেন, দুই যুগ আগেও এই নদীতে পালতোলা নৌকা চলত। অনেকে এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা চালাত। গোসল ও থালাবাটি ধোয়ার কাজে নদীর পানি ব্যবহার করত। অথচ এখন নদীর পানি পচে আর ব্যবহারের উপযোগী নেই। নৌকা চলার মতো গভীরতা পর্যন্ত নেই নদীটিতে। কোনো কোনো জায়গায় এটিকে এখন কচুরিপানাপূর্ণ জলাশয় বলেই মনে হয়।
১২ কিলোমিটার দীর্ঘ ময়ূর নদীর সঙ্গে আগে রূপসা নদীর সরাসরি সংযোগ ছিল। এখন স্লুইস গেটের মাধ্যমে জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রিত; কিন্তু স্লুইস গেটটি বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকায় নদীতে আর জোয়ার-ভাটা নেই। এটিও নদীর মৃত্যুর আরেকটি কারণ বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
ময়ূর নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে ৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে খুলনা সিটি করপোরেশন। ২০১৬ সালে শেষ হওয়া এই প্রকল্পের কাজ এতটাই নিম্নমানের ছিল যে, তাতে নদীতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তনই আসেনি। বরং পুরো টাকাই নষ্ট হয়েছে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ উজ জামান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তখন দায়সারাভাবে ড্রেজিং এবং কিছু অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হয়েছিল। পরে নতুন করে আবার অবৈধ দখল হয়েছে; কিন্তু সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে। ফলে নদীর অবস্থা এখন আগের চেয়েও খারাপ।’
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন খুলনা নগরীতে সৃষ্ট ৮০ ভাগেরও বেশি বর্জ্য মিশ্রিত পানি ময়ূর নদীতে নিষ্কাশিত হয়। যার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬০৮ ঘনমিটার। অবৈধ দখলের কারণে ময়ূর নদীর আয়তন ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে গেছে। অবৈধ দখলের পরিমাণ ১ হাজার ৭৫ বর্গকিলোমিটার। প্রতিবেদনে নদী রক্ষায় বাঁধ অপসারণ, ভাসমান ময়লা অপসারণ ও নিয়মিত পরিষ্কার করা, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও পুনরায় খনন করাসহ ৮টি সুপারিশ করা হয়।
কিন্তু ময়ূর নদীর পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে গত মার্চে ডিও ছিল প্রতি লিটার পানিতে ১ দশমিক ৫, এপ্রিলে ১ দশমিক ৬, মে মাসে ১ দশমিক ৫ ও জুন মাসে ১ দশমিক ৬ মিলিগ্রাম। ফলে এই ভয়ানক দূষিত পানিতে কোনো জলজ প্রাণী বাঁচতে পারছে না।
গত ৯ জুন ময়ূর নদী ও ২২টি খাল রক্ষার দাবিতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জনউদ্যোগের আয়োজনে নগরীর লায়ন্স স্কুল থেকে ময়ূর নদী পর্যন্ত পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগেও নদী রক্ষার দাবিতে অনেক আন্দোলন হয়েছে; কিন্তু কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, মানুষের অত্যাচারে ময়ূর নদী আজ মৃতপ্রায়। এখনই নদী উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে তা খুলনাবাসীর জন্য খারাপ পরিণাম বয়ে আনবে।
এ ব্যাপারে খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবদুল আজিজ বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নগরীর ড্রেনের পানি ও বর্জ্য যাতে পরিশোধন করে নদীতে ফেলা যায়, সেজন্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প পাঠানো হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার পরিচালক হাবিবুল হক খান বলেন, ‘ময়ূর নদীর দূষণ রোধে তারা স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার কাজ করছেন। ড্রেনের পানি যাতে পরিশোধন করে নদীতে ফেলা হয় সে জন্য একাধিকবার সিটি করপোরেশনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তিনি জানান, নতুন মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর ময়ূর নদী রক্ষার বিষয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ তিনি নির্বাচনের সময় গ্রিন ও ক্লিন সিটি গড়ার অঙ্গীকার করেছিলেন।’