আল জাজিরা: সৌদি আরবের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করা হয় সৌদি যুবরাজের সমালোচক হিসেবে পরিচিত দেশটির খ্যাতনামা সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে। সেদিন ইস্তাম্বুলে নিযুক্ত সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের ‘দুই ঘণ্টার’ মধ্যেই খুন করা হয় তাকে। তুর্কি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ খবর জানা গেছে।
তুরস্কের উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মনে করেন, জামাল খাশোগিকে খুন বা অপহরণের জন্য আগে থেকেই ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে অপেক্ষমাণ ছিল সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় কিলিং স্কোয়াড বা খুনি বাহিনী। তারা মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় ছিলেন কখন খাশোগি হাজির হন। কনস্যুলেটে এটা ছিল তার দ্বিতীয় প্রবেশ। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ চূড়ান্ত করতে এর আগে আরও এক দফায় সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। তখন তাকে জানানো হয়, কাগজপত্র ঠিক নেই। মঙ্গলবার আবার আসতে হবে। সে অনুযায়ী, দ্বিতীয় দফায় কনস্যুলেটে গিয়েই সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় হিট স্কোয়াডের নৃশংস শিকারে পরিণত হন তিনি।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানসহ দেশটির কর্মকর্তারা অবশ্য সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার খবর নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের দাবি, সেদিন কনস্যুলেট থেকে বের হয়ে গেছেন খাশোগি। এর প্রেক্ষিতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়্যব এরদোগান সৌদি আরবের কাছে খাশোগির দূতাবাস ত্যাগের প্রমাণ চান। সৌদি আরব প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হলে বিষয়টি নিয়ে বিশদ তদন্তের কথা বলেন তুর্কি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তুর্কি কর্মকর্তারা দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর কাছে সৌদি আরবের এমন কর্মকাণ্ডকে ‘যথেষ্ট নোংরা’ কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এই কর্মকর্তা বলেন, সাংবাদিক জামাল খাশোগি যেদিন নিখোঁজ হন সেদিনই ১৫ সৌদি এজেন্ট (রাষ্ট্রীয় কিলিং মিশনের সদস্য) দুইটি চার্টার ফ্লাইটে তুরস্কে এসে পৌঁছায়। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই তারা তুরস্ক ছেড়ে যায়। আঙ্কারা শনাক্ত করেছে যে, ওই ১৫ জনের সবাই বা অধিকাংশই সৌদি আরবের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কিংবা সরকারি চাকরিজীবী। তাদের মধ্যে একজন ময়নাতদন্ত বিশেষজ্ঞও ছিলেন। সম্ভবত নিহতের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করতে সহায়তার জন্য তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এরই মধ্যে এ ঘটনা নিয়ে তুর্কি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানকে অবহিত করা হয়েছে। সেখানে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরেই ওই সাংবাদিকের খুন হওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
তুর্কি সংবাদমাধ্যম ডেইলি সাবাহ মঙ্গলবার জানিয়েছে, অন্য দেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়ে এ ইস্যুতে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। এতে জামাল খাশোগি খুন হওয়ার বদলে বরং তিনি নিখোঁজ রয়েছেন; এমন সম্ভাবনার প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে দেশটির একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে এই ঘটনার তদন্তে বিদেশী গোয়েন্দাদের সংশ্লিষ্টতার খবর নাকচ করে দিয়েছেন।
তুর্কি কর্মকর্তারা অবশ্য এ ব্যাপারে এখনই বিস্তারিত তথ্য দিতে রাজি নন। কারণ তাদের আশঙ্কা, তাদের হাতে আসা তথ্য এখনই ফাঁস হয়ে গেলে তা ভবিষ্যতে এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সৌদি এজেন্টদের বিচারকাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আরেক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যম নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য টাইমসকে বলেছেন, ওই হত্যাকা-ের একটি ভিডিও হাতে পেয়েছে তুর্কি গোয়েন্দারা।
কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ করতে না চাইলেও এরদোগানের একজন সহযোগী মঙ্গলবার প্রকাশ্যেই ওই ভিডিও নিয়ে কথা বলেছেন। কেমাল ওজতুর্ক নামের সরকারপন্থী এই কলামিস্ট বলেন, তাকে খুনের মুহূর্তের ভিডিও রয়েছে।
এদিকে সংবাদিক জামাল খাশোগি নিখোঁজের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।’ খাশোগির নিখোঁজের ঘটনা তদন্তে সহযোগিতার জন্য তুরস্ক ও সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন। তুরস্কের প্রতি বিষয়টি নিয়ে বিশদ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি।
ট্রাম্প বলেন, ‘এ সম্পর্কে বেশ কিছু বাজে গল্প আছে। আমি এগুলো পছন্দ করি না।’ ট্রাম্পের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এটা নিয়ে পরস্পরবিরোধী খবর আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র খাশোগির নিখোঁজের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, বিষয়টি ভালোভাবে তদন্তে সহায়তা করতে ও স্বচ্ছভাবে তুলে ধরতে আমরা সৌদি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
এ ঘটনায় সৌদি কর্তৃপক্ষকে হুঁশিয়ারি দিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব সমান মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করে’।
জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনের মুখপাত্র রাভিনা শ্যামদাসানি তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি’কে বলেন, সৌদি কনস্যুলেট থেকে খাশোগির নিখোঁজের ঘটনাটি ‘মারাত্মক উদ্বেগজনক’। তিনি বলেন, ‘যদি তার মৃত্যু ও এর ফলে উদ্ভুত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সত্য হয়, তাহলে এটা সত্যিই দুঃখজনক। আমরা খাশোগির নিখোঁজের ঘটনাটির দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত করে তা প্রকাশ করার জন্য তুরস্ক ও সৌদি আরবকে সহযোগিতার আহ্বান জানাইন।’
শ্যামদাসানি আরও বলেন, ‘খাশোগি কনস্যুলেটে প্রবেশের পর ঠিক কী ঘটছে তা নিয়ে এখন অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তাই এ নিয়ে আর কোনও মন্তব্য করার আগে আমরা বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।’
নির্বাসিত সাংবাদিক খাশোগি সৌদি আরবের প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বড় সালোচক। সৌদি অভিজাত পরিবারে জন্ম নেওয়া এই সাংবাদিক গত বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে রয়েছেন। নির্বাসনে থাকা অবস্থায় তিনি যুবরাজের নেতৃত্বে শুরু হওয়া সংস্কার কর্মসূচির সমালোচনা করে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এ কলাম লিখতেন।
উল্লেখ্য, সৌদি আরব থেকে নির্বাসিত সাংবাদিক ও কলামিস্ট খাশোগি ২ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তুরস্কের কর্মকর্তারা বলছেন, কনস্যুলেটের ভেতরে সৌদি থেকে আসা এজেন্টরা তাকে হত্যা করেছে। তবে ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করলেও জামাল খাশোগি’র ব্যাপারে কোনও সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে রিয়াদ