পুণ্যভূমি সিলেট থেকে সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা করতে যাচ্ছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বুধবার সিলেটের সমাবেশ থেকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সাত দফা মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দেবে নতুন এ জোট। দাবি না মানলে অসহযোগের মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। পাশাপাশি দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে জনগণের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলারও আহ্বান জানাবেন নেতারা।
পুণ্যভূমিতে নেমেই প্রথমে হজরত শাহজালাল (রহ.), হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজার এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর কবর জিয়ারত করবেন জোটের শীর্ষ নেতারা। বেলা ২টায় রেজিস্ট্রারি মাঠে এই সমাবেশ হবে। এ কর্মসূচি সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। সমাবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আলাদা চিঠিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছেও সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নয়া এই জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব সোমবার বলেন, ‘সিলেটের সমাবেশ থেকে আমরা চূড়ান্ত আন্দোলনে যাব। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সাত দফা দাবি আদায়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আশা করি তফসিল ঘোষণার আগেই সরকার আমাদের দাবি মেনে নিয়ে সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম করবে।’
এর আগে বহু নাটকীয়তার পর সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি) রোববার ১৪ শর্তে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ২৪ অক্টোবর সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রথম ২৩ অক্টোবর সিলেটে সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়। সে অনুযায়ী পুলিশ প্রশাসনের কাছে অনুমতিও চাওয়া হয়। কিন্তু অনুমতি না মেলায় সমাবেশের কর্মসূচি একদিন পিছিয়ে দেয়া হয়।
পাশাপাশি সমাবেশের অনুমতি না দেয়া কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবেন না- তা জানতে চেয়ে উচ্চ আদালতে রুল জারির আর্জি জানানো হয়। রোববার হাইকোর্টে রিট করেন বিএনপি নেতা আলী আহমদ। আবেদনে সমাবেশ করতে দেয়ার আবেদনও করা হয়। সোমবার এই রিটের শুনানির তারিখ ধার্য করেন আদালত। এর আগেই পুলিশ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সমাবেশের অনুমতি দেয়।
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার বিষয়সহ সাত দফায় আরও বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ১৩ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। গণফোরাম ছাড়াও বিএনপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া এবং নাগরিক ঐক্য মিলে গঠিত হয় এই জোট। আত্মপ্রকাশের দিন ফ্রন্টের নেতারা ৭ দফা ও ১১টি লক্ষ্য দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করেন। এরপর কয়েক দফা বৈঠক করে স্টিয়ারিং কমিটি ও সমন্বয় কমিটি গঠন করেন তারা। একই সঙ্গে আন্দোলনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন।
সিলেটে কর্মসূচির পর ঢাকার বাইরে ধারাবাহিকভাবে সভা-সমাবেশ করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের অন্যতম নেতা ও গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘সিলেটের সমাবেশ থেকে আমরা নতুন বার্তা দেব। সরকারকে দাবি-দাওয়া মেনে নিতে আলটিমেটাম দেব। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই যাতে সংসদ ভেঙে দিয়ে তারা সংলাপে বসে- সে আহ্বান জানাব। পাশাপাশি জনগণের প্রতিও আহ্বান জানাব যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়।
জানা গেছে, সিলেটের সমাবেশ সফল করতে ইতিমধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। সব ধরনের সংঘাত-সহিংসতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সিলেটসহ আশপাশ এলাকার লোকজনও কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকবেন। এজন্য নেয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেবেন। প্রধান বক্তা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উপস্থিত থাকবেন- গণস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির পক্ষে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির পক্ষ থেকে দলটির সভাপতি আসম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, গণফোরামের পক্ষে দলটির নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু, নাগরিক ঐক্যের পক্ষে দলটির আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মেদ।
ড. কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, মোস্তফা মহসিন মন্টু, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা মঙ্গলবার সকালে বিমানে সিলেট যাবেন। পরদিন বুধবার সমাবেশ করে সিলেটেই রাত্রিযাপন করবেন। বৃহস্পতিবার সকালে বিমানে তারা ঢাকায় ফিরবেন। আর সড়ক পথে সিলেট যাবেন বাকি নেতারা।
এদিকে সিলেটের সমাবেশসহ কর্মসূচি সফল করতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সমন্বয় কমিটির বৈঠক সোমবার বেলা ১১টায় আরামবাগের ইডেন কমপ্লেক্স গণফোরাম কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপি নেতা মনিরুল হক চৌধুরী। অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক, শহীদুল্লাহ কায়সার, হাবিবুর রহমান হাবিব, আ.ও.ম শফিক উল্লাহ, মমিনুল ইসলাম ও মোশতাক আহমেদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মনিরুল হক চৌধুরীকে সমন্বয় কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। এছাড়া সিলেটের সমাবেশ সমন্বয় করার জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য মো. শাজাহান ও সুলতান মো. মনসুর আহমেদকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
বৈঠকে জেলায় জেলায় কমিটি গঠনের উদ্যোগ এবং আগামী ২৬ অক্টোবর বিকাল ৩টায় ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েও আলোচনা হয়। এর বাইরে পূর্বঘোষিত চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে সমাবেশের কর্মসূচি পালন উপলক্ষে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। আগামী ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামে এবং ২ নভেম্বর রাজশাহীতে সমাবেশ করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এর আগে শিক্ষক এবং আলেম-ওলামাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তারা। ঢাকায় মহাসমাবেশ আয়োজনের বিষয় নিয়েও এদিন আলোচনা হয়।
ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি : এদিকে সিলেট ব্যুরোপ্রধান সংগ্রাম সিংহ জানান, বুধবার সিলেটে অনুষ্ঠেয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। বৈঠক চলছে দফায় দফায়। সমাবেশ আয়োজনে প্রশাসনের অনুমতি পাওয়ার পর রোববার রাতেই সভায় বসেন সিলেটের ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। সোমবার সকালেও তারা একসঙ্গে বসে আলোচনা করেন।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ জানান, সমাবেশ সফল করার প্রস্তুতি চলছে। বিভাগের জেলা-উপজেলা থেকেও বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী আসবেন। তিনি জানান, স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগসহ সব প্রস্তুতি সম্পন্নের পথে। তার দাবি, সমাবেশ ঘিরে বুধবার সিলেটের ঐতিহাসিক রেজিস্ট্রারি মাঠ লোকে লোকারণ্য হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের আজ মঙ্গলবার সিলেটে পৌঁছানোর কথা। পাশাপাশি বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শাহজাহান খানের নেতৃত্বে একটি টিমও আসবে। সমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সভাপতিত্ব করার কথা। তবে মেয়র আরিফ যুগান্তরকে বলেন, আমাকে সভাপতিত্ব করার কথা বলা হলেও বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
দেরিতে সমাবেশের অনুমতি পাওয়ায় লোক সমাগম কম হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি যুগান্তরকে বলেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় দলমত নির্বিশেষে আমরা সর্বস্তরের সিলেটবাসীর সহযোগিতা চাই। জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম যুগান্তরকে বলেন, সমাবেশের অনুমতি আগে দিলে ভালো হতো। তবে দেরিতে দিলেও ক্ষতি নেই, আমরা ব্যাপক লোক সমাগম ঘটাতে পারব। জনগণ সমাবেশের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। তিনি জানান, কৌশলগত কিছু কারণে এই সমাবেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর সমাবেশ বলা হচ্ছে না। গণফোরাম সিলেট জেলা সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিলেন্দু দেব যুগান্তরকে বলেন, সমাবেশের অনুমতি না পাওয়ায় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের শুধু মাজার জিয়ারতের কথা ছিল। যেহেতু অনুমতি মিলেছে তাই আমরা সমাবেশ করব।
এদিকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র আবদুল ওয়াহাব জানান, শর্ত সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বিবেচনায় নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
আয়োজকরা জানান, সমাবেশ আয়োজনে ১৪ দফা শর্ত দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনুষ্ঠানস্থলে পর্যাপ্ত নিজস্ব পুরুষ-মহিলা স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ, রাষ্ট্রবিরোধী কোনো বক্তব্য-বিবৃতি না দেয়া, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হানে এমন বক্তব্য-বিবৃতি না দেয়া এবং অনুরূপ ব্যানার-ফেস্টুন ব্যবহার না করা, জনচলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি না করা, বেলা ২টা থেকে ৫টার মধ্যে সমাবেশ সম্পন্ন করা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা সৃষ্টি করে এ ধরনের বক্তব্য প্রদান না করা, মাইক ও শব্দযন্ত্র ব্যবহারে আশপাশের অসুবিধা না হয় তা নিশ্চিত করা, ব্যাগ, সিগারেট, দিয়াশলাই, লাইটার ইত্যাদি নিয়ে অনুষ্ঠানে প্রবেশ না করা, লাঠিসোটা ধরনের অস্ত্র কিংবা লাঠিযুক্ত ব্যানার-ফেস্টুন বহন না করা, সিলেট নগরীর সুরমা পয়েন্ট থেকে তালতলা পর্যন্ত কোনো গাড়ি পার্কিং না করা, অনুষ্ঠানস্থলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে আয়োজকরা দায়ী এবং শর্ত লংঘন করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে সমাবেশের অনুমতিপত্রে। সর্বশেষ বলে দেয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ দর্শানোর অনুমতি ব্যতিরেকে ওই অনুমতি, আদেশ বাতিল করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে।যুগান্তর