ক্রাইমবাতা রিপোটঃ বাংলাদেশের সমাজে ধর্মের উপস্থিতি এবং প্রভাব নতুন কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইসলাম সবসময়ই এক ধরণের ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে সমাজ জীবনে ইসলামের দৃশ্যমান উপস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজের ইসলামীকরণ গত এক দশকে যতটা ঘটেছে আগের কোনো সময়েই তা ঘটেছে বলে মনে হয় না। পোশাক-আচরণ-দৈনন্দিন জীবনাচারণ-কথোপথন এগুলোর দিকে তাকালেই সমাজে ও সংস্কৃতিতে ইসলামী ভাবধারার ব্যাপক প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। (বিস্তারিতভাবে আলোচনার জন্যে দেখুন, রীয়াজ ২০১৭-এ)। যা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত তা হচ্ছে বাংলাদেশের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে যে স্থানীয় ও সমন্বয়বাদী (সিনμেটিক) ইসলামের প্রাধান্য ও প্রভাব ছিল বলে ধারণা করা হতো তাঁর প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, বিপরীতক্রমে একটি রক্ষণশীল আক্ষরিক (লিটারালিস্ট) ব্যাখ্যা এবং একই সঙ্গে একটি বৈশ্বিক ব্যাখ্যার ইসলামেরই প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে এবং তা ক্রমবর্ধমান।
সমাজে ইসলামের এই প্রভাব এবং এক বিশেষ ধরণের ব্যাখ্যার প্রতি জনসাধারণের সম্মতির একটি কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম ধর্মের প্রতি পক্ষপাত, অন্যদিকে তা হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের মানস গঠনে বড় ধরণের পরিবর্তন। রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় এই পরিবর্তনের সূচনা হয় কার্যত ১৯৭৪ সালেই, তবে সত্তরের দশকের মাঝমাঝি থেকে বিভিন্ন ঘটনা তাকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে।
এর মধ্যে আছে ক্রমান্বয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অপসারণ, রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে সেক্যুলারিজমের/ধর্মনিরপেক্ষতার অবসান, রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলের আবির্ভাব, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি এবং দল-নির্বিশেষে ধর্মীয় প্রতীক ও রেটরিকের ব্যবহার। নব্বইয়ের দশক থেকে ইসলামপন্থী দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন ধরণের ইসলামপন্থী দলের সংস্কারবাদী, রক্ষণশীল, উগ্রপন্থী, সহিংস চরমপন্থী বিকাশ লাভ করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থেকেছে, এবং ধর্মের প্রশ্নে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার কোনো লক্ষণই আর উপস্থিত নেই। এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক ধরণের ইসলামপন্থী জঙ্গী সংগঠনের উপস্থিতি ঘটতে শুরু করে।
অন্য যে কোনো মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মতোই বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির বিভিন্ন ধারা উপস্থিত ছিল এবং আছে। যদিও দীর্ঘদিন বাংলাদেশের অনেক বিশেষজ্ঞ ইসলামপন্থী রাজনীতি বলতে কেবলমাত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামকেই বিবেচনা করেছেন। এই রাজনীতি বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হলেও প্রবণতার দিক থেকে আমরা একে দুইভাগে ভাগ করতে পারি তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল এবং সংস্কারপন্থী। গত কয়েক বছরে, বিশেষত ২০১১ সালের পর থেকে, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের মধ্যেকার তুলনামূলকভাবে সংস্কারপন্থী ধারা দুর্বল হয়েছে; অতীতের ভুল রাজনীতি, সাংগঠনিকভাবে ভুল সিদ্ধান্ত, বিরূপ রাজনৈতিক পরিবেশ ইত্যাদি তাঁর অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল এই সংস্কারপন্থীদেরকেই তাঁদের চ্যালঞ্জ বলে বিবেচনা করায় এই ধারাটিকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে ফেলার চেষ্টা করেছে এবং তাতে বড় ধরণের সাফল্য অর্জন করেছে। এই জন্যে শক্তি প্রয়োগ, বিচারিক ও বিচার বহির্ভূত ব্যবস্থা ব্যবহৃত হয়েছে এবং সিভিল সোসাইটির একটি অংশ ও গণমাধ্যম তাতে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টার ফলে দলগতভাবে জামায়াতে ইসলামী কার্যত বিপর্যস্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু আদর্শিকভাবে ইসলামপন্থার আবেদন হ্রাস পায়নি, ইসলামপন্থীদের শক্তিও খর্ব হয়নি।
ইসলামপন্থীদের সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত অংশের অনুপস্থিতির সুযোগে গত কয়েক বছরে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীরা রাজনীতির প্রান্তিক অবস্থান থেকে রাজনীতির কেন্দ্রে আসতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীরা কেবল শক্তি সঞ্চয় করেছেন তা নয়, তাঁরাই এখন রাজনীতির এজেন্ডা নির্ধারণের মতো শক্তি রাখেন। এই রক্ষণশীল ধারার সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলামের উত্থান, তাঁদের বক্তব্য, তাঁদের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের সখ্যের আগ্রহ, ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠতা এবং এই গোষ্ঠীর দাবি দাওয়া মেনে নেয়ার ব্যাপারে সরকারের দ্বিধাহীনতা প্রমাণ করে যে এখন বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রধান প্রতিনিধি তারাই। তবে মনে রাখা দরকার যে, তাঁরাই এই ধারার একমাত্র প্রতিনিধি নয়, বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার।
ক্ষমতাসীন দল গত দুই/তিন বছরে এই শক্তিকেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। এটিকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, বাস্তবোচিত পদক্ষেপ, জনসাধারণের মনোভাবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, কৌশল, কো-অপটেশন – যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন এতে করে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে কট্টর রক্ষণশীল ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে এবং রাজনীতিতে তাঁদের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।
আসন্ন জাতীয় সংসদের নির্বাচন যদি সকল দলের অংশগ্রহণমূলক হয় তবে প্রধান প্রধান দল বা জোটের কাছে ইসলামপন্থী দলগুলো গুরুত্ব পাবে, সেই গুরুত্ব ভোটারদের মধ্যে তাঁদের সমর্থনের অনুপাতের চেয়ে অনেক বেশিই হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রধান জোটগুলো তাঁদের ইসলামী পরিচিতিকে প্রাধান্য দেবার জন্যেই এই ধরণের দলের দ্বারস্থ হবেন। এই প্রভাবের মাত্রা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাবে যদি এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যাতে বিএনপি এবং অন্যান্য পরিচিত দল অংশগ্রহণ না করে। কেননা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক হিসেবে উপস্থাপন, তৃণমূল পর্যায়ে ভোটারদের মোবিলাইজ করা এবং একপাক্ষিক নির্বাচনকে দৃশ্যত বৈধতা দেয়ার জন্যে ইসলামপন্থীদের প্রয়োজন দেখা দেবে। এই রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করার রাজনৈতিক উদ্যোগ এখনও অনুপস্থিত, আর আদর্শের লড়াইয়ে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের চেষ্টার পরিণতি ইতিবাচক হয় না।
ভারতের ভূমিকা
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও নিকট প্রতিবেশী হিসেবে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার কারণে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময়ই একটা ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে উপস্থিত থেকেছে। যদিও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশে-ভারত সম্পর্ক সব সময়ই ছিলো ‘অম্ল-মধুর’ তথাপি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত প্রসঙ্গ উপস্থিত থেকেছে আলাপ-আলোচনায়, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধিতায়। অযৌক্তিক ও উগ্র ভারত-বিরোধী এবং ভারতের প্রতি অতিমাত্রায় সহানুভূতিশীল ও ভারত বিষয়ে স্পর্শকাতর জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে সব সময়ই ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে বিবেচনা করার প্রবণতাই প্রধান ধারা।
একথা সাধারণের কাছে স্পষ্ট যে, ভারতের পক্ষপাত সব সময়ই আওয়ামী লীগের অনুকূলে ছিল। অন্যদিকে বিএনপি’র রাজনীতির একটি অন্যতম উপাদান হচ্ছে ভারত-বিরোধিতা। ভারতের নীতি নির্ধারকরা স্ট্র্যাটেজিক বিবেচনায় বাংলাদেশকে তাঁদের পেছনের উঠোন বা ব্যাকইয়ার্ড বলে বিবেচনা করে এসেছেন। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকি হতে পারে এমন যে কোনো কিছুকেই ভারত মোকাবেলা করার তৎপর থেকেছে। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাপারে ভারতের উৎসাহ কেবলমাত্র উৎসাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।
অতীতে ভারতের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব সীমিত থাকার কারণে এবং বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর আগ্রহ ও নির্বাচনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার ফলে ভারত প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু ২০০৭-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পর্দার আড়ালে ভারতের নীতি-নির্ধারকরা তাঁদের প্রভাব বৃদ্ধি করে (মুখার্জী ২০১৭) এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুকূলে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা নেয়, তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের বাংলাদেশ সফরই কেবল তাঁর প্রমাণ নয়, এই একপাক্ষিক নির্বাচনের পরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার বিরুদ্ধে ভারত বাংলাদেশ সরকারের বর্ম হিসেবেই কাজ করেছে। গত কয়েক বছরে ভারত বাংলাদেশের সরকারের কাছ থেকে যা পেয়েছে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায় ‘সারা জীবন মনে রাখবার’ মত (বাংলা ট্রিবিউন ২০১৮)। কিন্তু বিনিময়ে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যে তার প্রাপ্যও পায়নি সেটা এমন কি ভারতীয় বিশেষজ্ঞরাও খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করেন।
২০১৮ সালে এসে চার বছর আগের পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। ভারত বাংলাদেশে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র সরকার চায় চারটি কারণে; প্রথমত বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি; দ্বিতীয়ত এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলা; তৃতীয়ত দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের মিত্রের অভাব এবং চর্তুত ইতিমধ্যে ভারতের যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হয়েছে তা রক্ষা করা। ফলে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাপারে এখন ভারতের আগ্রহ বেশি। এই আগ্রহ এবং সেই মর্মে সক্রিয় থাকার কারণে এটা এখন আরো স্পষ্ট যে ভারত বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের ও সেই সূত্রে বাংলাদেশের রাজনীতির এক নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই বছরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদের ভারত সফর, মে মাসে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শান্তি নিকেতনে নরেন্দ্র মোদির আলোচনা বিষয়ে আনন্দবাজারের প্রতিবেদন (চট্টোপাধ্যায় ২০১৮), জুন মাসে বিএনপি প্রতিনিধি দলের নয়া দিল্লি সফর এবং জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের সফর এই ইঙ্গিতই দেয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাবকে কেউ আর অস্বীকার করছেন না।
বিএনপির প্রতিনিধিদের ভারত সফর যতটা দৃষ্টিকটুই হোক না কেন, দলের ভারত-বিরোধিতার নীতির পরিত্যাগের আন্তরিকতা নিয়ে যত প্রশ্নই উঠুক না কেন এবং এতে আদৌ ফলোদয় হবে কিনা সেই বিষয়ে যত সংশয়ই থাকুক না কেন, এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন ভারতের প্রভাব স্বীকৃত হল তেমনি আরেকটি প্রশ্নও উত্থিত হল – যারা ভারত-বিরোধিতার জন্যে বা ভারতের সঙ্গে অসম সম্পর্কের বিরোধী শক্তি হিসেবে বিএনপিকেই বিবেচনা করতেন বিএনপি’র সেই সমর্থক গোষ্ঠী কোথায় আশ্রয় নেবে? (আহমেদ ২০১৮)। বাংলাদেশের রাজনীতির আগামী দিনে এই গোষ্ঠী কোন পথে অগ্রসর হয় তা লক্ষ্য করার বিষয়।
গত বছরগুলোতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মাত্রা ও প্রকৃতি বাংলাদেশে ভারতের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে কিনা সেই বিষয়ে নির্ভরযোগ্য উপাত্ত আমাদের হাতে নেই, কিন্তু অব্যাহতভাবে এই প্রভাব বিস্তার দীর্ঘ মেয়াদে ভারতের জন্যে ইতিবাচক হবে বলে মনে করার কারণ নেই। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে ভারতের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনা করা দরকার।
উপসংহার
বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি ব্যাখ্যার জন্যে আমি এই প্রবন্ধে চারটি বিষয়ের দিকে মনোনিবেশ করেছি। প্রথমত বর্তমান শাসন ব্যবস্থা, যাকে আমি হাইব্রিড রেজিম বলে বর্ণনা করেছি এবং যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দৃশ্যত গণতান্ত্রিক উপাদানের পাশাপাশি শক্তিশালী কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার উপস্থিতি এবং শাসন পরিচালনার জন্যে শক্তি প্রয়োগের ওপরে নির্ভরতা। এই ধরণের শাসন ব্যবস্থা স্থিতাবস্থায় থাকেনা বলেই পৃথিবীর অন্যত্র দেখা গেছে; সেসব ক্ষেত্রে আরো বেশি ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটেছে এবং আরো বেশি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের জন্যেও সেটা বিবেচ্য হওয়া দরকার। এই ধরণের শাসনের বৈধতা ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পিত নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি হয় যাকে তাঁরা এক ধরণের আনুষ্ঠানিকতা বলেই বিবেচনা করেন। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের সমাজে এক নতুন শ্রেণী বিন্যাস ঘটেছে এবং নতুন ধণিক শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে। রাষ্ট্রের আনূকূল্যে ও ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই শ্রেণীর মধ্যে জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার আকাঙ্খার ঘাটতি আছে, যা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে। নিকট ভবিষ্যতের জন্যে তা ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় না। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সুবিধা বঞ্চিতদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তৃতীয়ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিমধ্যেই রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের প্রভাব বেড়েছে। আগামীতে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির ক্ষেত্র যতই সীমিত হবে, এই শক্তির প্রভাব ও ক্ষমতা বাড়বে। সকলের অংশগ্রহণমূলক অবাধ নির্বাচনের বিকল্প কিছু চেষ্টা করা হলে এই শক্তিই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। চর্তুত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত প্রায় নির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, যা কার্যত সব প্রধান দলই স্বীকার করে নিয়েছে; কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা বলে যে এতে করে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের লাভবান না হবার সম্ভাবনাই বেশি।
উৎস: সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)-এর জন্য আলোচনাপত্র
লেখক পরিচিতি : লেখক, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর