সবার নজর গণভবনে: সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাই হবে বড় ফ্যাক্টর

ক্রাইমবার্তা রিপোট:    গণভবন নিয়ে সাধারণ মানুষের এরকম আগ্রহ সর্বশেষ কবে দেখা গিয়েছিল তা অবশ্যই ভাবার বিষয়। সাধারণ মানুষ গণভবন নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখান না বা এনিয়ে খুব বেশি মাতামাতিও করেন না। হঠাৎ সংলাপের ঘোষণায় দেশের মানুষের চোখ এখন গণভবনের দিকে। তারা ভালো কিছুর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে।

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট ১৪ দল এবং বিএনপি নিয়ে নবগঠিত জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে সংলাপ আজ বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। সংলাপে ১৪ দলের নেতৃত্ব দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দেবেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তবে সংলাপের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা কোন নৈশ্যভোজে অংশ নেবেন না।

তাই আজ গণভবনে কী হচ্ছে সেদিকে চোখ থাকবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ দেশবাসীর। কারণ এর মাধ্যমে দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। আর যদি সংলাপটি লোক দেখানো হয় তাহলে দেশে আবার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা যায়।

সরকারি দল নাটকীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে বসার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে দারুণ কৌতূহল তৈরি হয়েছে। সংলাপের উদ্যোগকে বিভিন্ন মহল স্বাগত জানালেও সফলতা নিয়ে রয়েছে সংশয়। আশা-নিরাশার দোলাচলেই সংলাপে অংশ নিচ্ছেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। তারা কট্টর মনোভাব নিয়ে নয়, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে খোলা মন নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে ফ্রন্টের নেতারা বলেছেন সংলাপ যদি লোক দেখানো হয়, তাহলে তারা নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগোবেন।

সংলাপে বসার এসব উদ্যোগে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বস্তি ফিরলেও উভয় পক্ষের বেশকিছু শর্ত শংকাও তৈরি করছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড, কামাল হোসেনকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধান সম্মত সকল বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। অনেকেরেই প্রশ্ন, এর মানে কি এই যে প্রধানমন্ত্রী সংলাপে রাজি হলেও ‘বর্তমান সংবিধানে যা আছে সেভাবেই নির্বাচনের’ অবস্থান থেকে নড়ছেন না?

এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দাবিই হলো, ‘সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। কিন্তু এটা করতে হলে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু সরকারি দল সংবিধানের বাইরে যেতে আগ্রহী নয়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠেছে, বিরোধীদের দাবি মেনে কতটুকু ছাড় দেবেন প্রধানমন্ত্রী! উপেক্ষিত হলে বিরোধীদের সামনেই বা বিকল্প কি?

সরকারি দল তারা সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো আলোচনায় আগ্রহী নন বলেই জানা গেছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবি চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। আলোচনার টেবিলে সেগুলো নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরা হবে। তবে সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নাটকীয় কোনো ঘোষণা দিতে পারেন এমন আভাসও দিয়েছেন কেউ কেউ।

নির্বাচনের তফসিলের আগে সংলাপে বসতে গত ২৮ অক্টোবর সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে চিঠি দেয় ঐক্যফ্রন্ট। সেই চিঠির একদিন পরই সরকারি দল সংলাপে বসতে রাজি বলে ঘোষণা দেয়। ঐক্যফ্রন্টের পাশাপাশি আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটের সাথেও আলোচনায় বসবেন প্রধানমন্ত্রী।

ঐক্যফ্রন্টের যেসব নেতা সংলাপে অংশ নিবেন

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল আজ এ সংলাপে অংশ নেবেন। প্রতিনিধিদলে আছেন বিএনপি থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও মির্জা আব্বাস। জেএসডি থেকে আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল মালেক রতন ও তানিয়া রব। গণফোরাম থেকে মোস্তফা মহসিন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরী। নাগরিক ঐক্য থেকে থাকবেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও এস এম আকরাম। ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আ ব ম মোস্তফা আমিন এবং স্বতন্ত্র হিসেবে থাকবেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

জানা গেছে, সংলাপের সাফল্য নিয়ে সংশয় থাকলেও ইতিবাচক মানসিকতা নিয়েই সরকার প্রধানের সাথে খোলামেলা আলোচনায় অংশ নেবে ঐক্যফ্রন্ট। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ঐক্যফ্রন্ট যে সাত দফা ঘোষণা করেছে, সেই সাত দফাই হবে আলোচনার মূল ভিত্তি। এর মধ্যে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার প্রস্তাব সংবিধানের ভেতর থেকেই লিখিতভাবে তুলে ধরবে ঐক্যফ্রন্ট।

ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার মধ্যে রয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার, তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দেয়া, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপে সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা বাদ দেয়া এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ভোটকেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেসি মতাসহ সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ নিশ্চিত করা।

সংলাপে নিজেদের অবস্থান চূড়ান্ত করতে ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা গত দুই দিন একাধিক বৈঠক করেছেন। জানা গেছে, বৈঠকে সাত দফা এবং কেন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন তা লিখিতভাবে বিস্তারিত তুলে ধরবেন ড. কামাল।

জানা গেছে, ঐক্যফ্রন্টের কোনো দফা সরকারি দল আমলে না আনলে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সেক্ষেত্রে রাজধানীর জনসভা থেকে আলটিমেটাম দিয়ে রাজপথ বেছে নেয়া হতে পারে।

ঐক্যফ্রন্টের সিনিয়র এক নেতা বলেছেন, সংলাপের কথা বলে ক্ষমতাসীনেরা যদি সময়ক্ষেপণের কৌশল নেয়. তাহলে পাল্টা কৌশল নেবে ঐক্যফ্রন্ট। সেক্ষেত্রে রাজপথের কর্মসূচির পাশাপাশি সংলাপও চলতে পারে।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, সংলাপ, আন্দোলন ও নির্বাচন একসাথে চলবে। তিনি বলেন, এতদিন যে কৌশল নিয়ে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছি সেটি ফলপ্রসূ হয়েছে। সরকার সংলাপ করতে সম্মত হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে মতাসীন দলের মন্ত্রীরা সংলাপ নাকচ করলেও, এখন তারা দেশের মানুষের মনের কথা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

সংলাপ নিয়ে আশাবাদী সরকার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতত্বে সংলাপে আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক নেতারাও থাকবেন। ক্ষমতাসীন জোটের পক্ষে ২৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল ঐক্যফ্রন্টের ১৬ নেতার সাথে কথা বলবেন। গতকাল দলের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমে এ তালিকা পাঠানো হয়। তালিকা অনুযায়ী শেখ হাসিনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফর উল্লাহ, ড. আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল মতিন খসরু, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, দলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, ডা: দীপু মনি, আব্দুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, দফতর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ এবং আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম উপস্থিত থাকবেন। ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদ একাংশের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাসদ আরেক অংশের কার্যকরী সভাপতি মঈনুদ্দিন খান বাদল সংলাপে অংশ নেবেন।

 

সরকারের সদিচ্ছা বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপরই সংলাপের সফলতা নির্ভর করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে যেসব দাবি জানানো হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই মানা সম্ভব। তারা বলছেন, ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি ও বিরোধী নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার, সংসদ ভেঙ্গে দেয়া, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নিয়োগ, ইসি পুনর্গঠন ইত্যাদি। পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সবাই জানে, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো করা হয়েছে তার সবই রাজনৈতিক। তাকে মুক্তি দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করাটা কোনো বিষয় নয়। সংবিধান পরিবর্তন করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনও কোনো সমস্যা নয়। এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেই দিয়েছেন, সংবিধান পরিবর্তন মাত্র মিনিটের বিষয়। এছাড়া বিরোধী জোট থেকে বলাও হয়েছে, তারা যে দাবিগুলো দিয়েছেন তার মধ্যে মোটেও নড়চড় হবে না এমনটি সঠিক নয়। আলোচনার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের সদিচ্ছা থাকাই মূল কথা। তবে সংলাপের অতীত ইতিহাস বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, ক্ষমতসীন আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপে তেমন ফলাফর পাওয়া যাবে না। তারা সংলাপকে আশা-নিরাশার দোলাচল বলে মনে করেন। এতে আশার থেকে নিরাশার কথাই বেশী বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সূত্র মতে, সংবিধানসম্মত সকল বিষয়ে আলোচনার জন্য ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে সংলাপে বসবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ২১জন নেতা। বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়ে মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপ ড. কামাল হোসেনের বাসায় গিয়ে তার হাতে আমন্ত্রণের চিঠি পৌঁছে দেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংলাপে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফরউল্লাহ, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদের কার্যকরী সভাপতি মাঈনুদ্দিন খান বাদল, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, রমেশ চন্দ্র সেন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ, আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম। এর আগে মঙ্গলবার মতিঝিলে প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে ঐক্যফ্রন্টের এক বৈঠকে সংলাপে ১৬ সদস্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের দলনেতা হিসেবে থাকবেন ড. কামাল হোসেন। সংলাপে বিএনপি থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, নাগরিক ঐক্য থেকে মাহমুদুর রহমান মান্না ও এসএম আকরাম, গণফোরাম থেকে মহাসচিব মোস্তফা মহসিন মন্টু ও কার্যকরি সভাপতি এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, জেএসডি থেকে আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল মালেক রতন ও তানিয়া রব, ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে আছেন সুলতান মুহাম্মদ মনসুর ও আ ব ম মোস্তফা আমিন, আর স্বতন্ত্র হিসেবে সংলাপে অংশ নেবেন গণস্বাস্থ্যে প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
সংলাপে খোলা মনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনা করার কথা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, আমরা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে এই সংলাপে সম্মত হয়েছি। একারণেই জননেত্রী শেখ হাসিনা ড. কামাল হোসেনকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই আলোচনা হবে খোলা মনে। তিনি আরও বলেন, ড. কামাল হোসেনের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। তার নীতি নৈতিকতা আছে। কোন চাপের কারণে এই সংলাপে বসা হচ্ছে না জানিয়ে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, আমরা কোনও চাপে এই সংলাপে বসছি না। সংলাপে বসার অর্থ কারও প্রতি নতি শিকার করা নয়। সংলাপরে মাধ্যমে সংকটের সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংলাপের উত্তাপে সংকটের বরফ গলবেই। তারা যেটিকে সংকট বলছে, আমরা সেটিকে সংকট মনে করি না। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে অনেক সংকটই সমাধান হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সংলাপ নিয়ে ইতিবাচক বক্তব্য দিলেও আশা-নিরাশার মধ্যে রয়েছেন পর্যবেক্ষক মহল। তারা বলছেন, সংলাপে যেভাবে আশার কথা শোনানো হচ্ছে সেভাবে নিরাশাও রয়েছে। আশার কথা জানিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিরোধীদের দাবির মুখে সরকার যে সংলাপে বসতে রাজি হয়েছে সেটিই আশার দিক। এই সংলাপে কি হবে সেটি পরের বিষয়। সংলাপে যাই হোক না কেন এর একটা ফলাফল অবশ্যই পাওয়া যাবে।
রাজনীতিক বিশ্লেষকরা আশার দিকগুলো তুলে ধরে বলেন, এই প্রথম রাজনীতিতে একটি বড় ডেভেলপমেন্ট হলো। সেটি হচ্ছে সব দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সংলাপ। এর আগে মধ্যম সারি থেকে সংলাপ শুরু হলেও এবার শীর্ষ নেতারাই আলোচনা শুরু করেছেন। তারা বলেন, বিরোধীদের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের যে দাবি জানানো হচ্ছে সেটি সরকারি জোট মেনেও নিতে পারে। কারণ ক্ষমতাসীন দলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। তিনি হয়ত নির্বাচনে অংশ নাও নিতে পারেন। এ অবস্থায় কেয়াটেকার সরকারের দাবি মেনে নিলেও সমস্যা হবে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের সামনে এখন তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেই। নেতৃত্বে এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই ফ্রন্টের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা আওয়ামী লীগ বিরোধী হলেও অধিকাংশই সাবেক আ’লীগের সমর্থক। এদেরকে আওয়ামী ঘরানার বলাই যায়। এই অবস্থায় নির্বাচন দিলে মহাজোট সরকার আবারো ক্ষমতায় থাকতে পারে। তাই বিরোধী জোটের দেয়া দাবিগুলো মানতেও পারেন।
অন্যদিকে নিরাশার দিকগুলো হচ্ছে, রাজনীতিতে যে মূল শ্লোগান ছিল সেগুলো থেকে বের হয়ে আসা। যেমন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবির মধ্যে রয়েছে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙ্গে দেয়া, খালেদা জিয়াসহ সকল রাজব›ীদর মুক্তি, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিৎ করা। এসব যদি বাস্তবায়ন না হয় তাহলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে লাভ হবে না। সরকারের সংলাপের আচরণ দেখে এসব দাবি পূরণের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। নিরাশার দিক হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়াকে ছাড়াই সংলাপের আয়োজন করতে পেরেছে। এমনকি যেদিন সংলাপের চিঠি দেয়া হলো সেদিনই তার সাজার মেয়াদ আরো ৫ বছর বাড়লো। নিরাশার দিক হচ্ছে নেতৃত্বে মূল আন্দোলনকারী দল বিএনপি নেই। মাঠে নেই খালেদা জিয়া। এগুলো সরকারের জন্য প্লাস পয়েন্ট। তাই নির্বাচন প্রশ্নে যে কোনো ধরনের দাবি মেনে নিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে সরকার। সে ক্ষেত্রে মূল দাবি পূরণ হবে না। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় যাবে। তারা সংলাপের মাধ্যমে চাইবে বেগম জিয়াকে মাইনাস করতে বিশেষ করে নির্বাচন থেকে।
সূত্র মতে, আশা নিরাশার মধ্যেও পর্যবেক্ষক মহলে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সংলাপের ফলাফল নিয়ে। তারা বলছেন, এই সংলাপকে বিরোধী জোটও ব্যর্থ হতে দিবে না। সরকারও চাইবে না সংলাপ ব্যর্থ হোক। কোনো পক্ষই ব্যর্থতার দায় নিতে চাইবে না। তারা বলছেন, নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধান দাবিগুলো মেনে সরকারকেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার উপরই সব কিছু নির্ভর করছে। তবে বেগম জিয়াকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে সেটি বিএনপি বা দেশের জনগণ মেনে নেবে না।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার একদিকে সংলাপের কথা বলছে অন্যদিকে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে। বুধবারও রাজধানীসহ সারাদেশে শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, দলের চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে সংলাপ-নির্বাচন কোনোটাই ফলপ্রসূ হবে না। গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে সংলাপে যাওয়ার একদিন আগে গতকাল বুধবার বিএনপি মহাসচিব এরকম সতর্ক মন্তব্য করলেন। তিনি বলেন, সরকার একদিকে সংলাপের প্রস্তাব করছে, অন্যদিকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তার সাজা বৃদ্ধি করেছে। এই দুইটাই সাংঘর্ষিক এবং তা কখনোই গণতান্ত্রিক কোনো আচরণের প্রতিফলন ঘটায় না এবং সংলাপের যে আন্তরিক সেই আন্তরিকতা প্রমাণ করে না। আমরা সুস্পষ্ট করে বলতে চাই, দেশনেত্রীকে কারাগারে রেখে এখানে কোনো সংলাপ বা কোনো নির্বাচন কখনোই ফলপ্রসূ হবে না। দেশনেত্রীর মুক্তি না হলে কোনো নির্বাচন অর্থবহ হবে না। জনগনের ভোটাধিকার ফিরে পেতে চলমান আন্দোলন সুসংহত করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবানও জানান বিএনপি মহাসচিব।
জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার প্রত্যাশা চাপা রেখেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসছে নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সংলাপের আগেই খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধির রায়ের পর শাসক দলের সঙ্গে আলোচনার ফল নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন তৈরি হওয়ার কথা জানিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল বিএনপি। ফলে, সংলাপের কৌশল ও বিষয় নির্ধারণ করা অব্যাহত থাকলেও আলোচনায় কোনও ফল না এলে পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ হবে বৃহস্পতিবারের পর। ঐক্যফ্রন্ট ও জাতীয়তাবাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা মনে করছেন, একদিকে সংলাপ আয়োজন, অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সাজাবৃদ্ধির বিষয়টি অপরিকল্পিত নয়। এরফলে দু’টি চাপ তৈরি হবে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ওপর। একটি, ঐক্যফ্রন্টের সাতদফার প্রথম দফায় খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি থাকলেও বিএনপি চাইবে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে। বৃহস্পতিবার সংলাপেও তা বড় করে তোলার জন্য ঐক্যফ্রন্টের ওপর চাপ দেবে দলটি। দ্বিতীয়ত, সংলাপের পাশাপাশি এক মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা দেওয়ার কারণে বিএনপিতে একটি অংশ বিষয়টিকে ইস্যু করার সুযোগ পেয়েছে। এই অংশটি বরাবরই বলে এসেছে, খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা মনে করেন, সংলাপের আগে খালেদা জিয়ার সাজাবৃদ্ধির রায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ফ্রন্টের নেতা, জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, আমরা তো বেগম জিয়ার রায়কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলার রায় দেওয়া হচ্ছে তাকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য। মূল লক্ষ্যটা সংলাপ, কিন্তু সংলাপের ডাক দিয়ে খালেদা জিয়ার সাজাবৃদ্ধির বিষয়টি কেমন? এটা সহজ সমাধান হবে না। খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা, এটা তো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ কারণে দলের মধ্যে ভিন্নমত তৈরি হবে। একটি অংশ বলবে যাবে, আরেকটি অংশ বলবে যাবে না। এমাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, সংলাপের ডাক দিয়ে খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়ার মানে হচ্ছে, সরকার ওয়ান পার্টি সিসটেম সৃষ্টি করতে চায়। খালেদা জিয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় নেত্রী, তাকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করায় অনেক সমস্যা আছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, শেষ মুহূর্তে সরকার সংলাপে বসছে। তাদের বোধদয় হয়েছে সংলাপে বসতে। তারা যদি সংলাপ থেকে ইতিবাচক কিছু বের করতে চায়, তাহলে দেশবাসী ও রাজনীতির জন্য ভালো হবে। এই সংলাপ যদি লোক দেখানো না হয়, তাহলে সব মহলের জন্য শুভ হবে। সংলাপের মূল এজেন্ডা খালেদা জিয়া, সেটি হচ্ছে, তাকে তারা মুক্তি দেবে কিনা, সেটা সংলাপের অংশ হতে পারে। তার মামলাটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সহনশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং আওয়ামী লীগের ভুল সংশোধনের জন্য সংলাপ সুযোগ হিসেবে আসছে। শামসুজ্জামান দুদু আরও বলেন, বাংলাদেশের চলমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সংলাপে আলোচনা হবে, এটাই বিশ্বাস করি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে। তার সিদ্ধান্ত নিয়েই দল চলছে। তার সিদ্ধান্তেই নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি সিদ্ধান্ত নেবে। দল বিভক্ত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক জোটের সমঝোতা হবে, এমন সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। এরপর কিছু ঘটলে ঐতিহাসিক। সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা ও ১১টি লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা হবে। এক্ষেত্রে সাত দফা দাবির বিষয়টি মুখ্য থাকবে। সাত দফার প্রথম দফায় চারটি বিষয় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি। ফলে, আলোচনার প্রথম স্বাভাবিক শর্ত হিসেবে এক নম্বর দফাতেই সংলাপ জমে উঠবে, এমনটি মনে করছেন ফ্রন্টের নেতারা।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।