ক্রাইমবার্তাডেক্স রিপোর্ট সরকারের ‘সদিচ্ছার অভাব ও নেতিবাচক অবস্থানের’ কারণে সংলাপ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, সাড়ে তিন ঘণ্টার সংলাপে সরকার তাদের অনড় অবস্থানের কথাই কেবল পুনর্ব্যক্ত করেনি বরং বেশ কিছু ইস্যুতে তিক্ত মন্তব্যও তাদের শুনতে হয়েছে। সংলাপের শুরুতে ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘অমর’ হয়ে থাকতে পারেন বলে যে আশাব্যঞ্জক বক্তব্য দিয়েছিলেন, সংলাপ শেষে তা হতাশায় রূপ নিয়েছে। কারণ সাত দফার একটিও সুস্পষ্টভাবে মানেনি ক্ষমতাসীনেরা। বিশেষ করে ফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ দাবি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, সংসদ ভেঙে নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে ন্যূনতম কোনো আশ্বাসও মেলেনি।
‘সংবিধানের বাইরে আওয়ামী লীগ যাবে না’, এমন অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর এসব দাবিতে ফের সংলাপে বসেও কোনো লাভ হবে না বলে মনে করছে ঐক্যফ্রন্ট। দাবি আদায়ে রাজপথেই সমাধান দেখছেন ফ্রন্টের নেতারা। জানা গেছে, আন্দোলনের সূচনা হিসেবে আগামী ৬ নভেম্বর ঢাকায় জনসভার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ সমাবেশ থেকে সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দেয়া হতে পারে।
ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না গতকাল বলেছেন, সংলাপে সাত দফার কোনোটিই মানা হয়নি। বরং নেতিবাচক মন্তব্য করেছে সরকারদলীয় লোকজন। দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, সংলাপের ফলাফল শূন্যের কোঠায়। কোনো দাবি তারা মানবে না।
সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার কারণ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গতকাল শুক্রবার বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, সাত দফার মধ্যে প্রধান দাবিগুলো হচ্ছেÑ বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও সংসদ ভেঙে নির্বাচন। এই তিনটি বিষয়ে সুরাহার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি সংলাপে।
জানা গেছে, সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি সংবিধানসম্মতভাবেই সুরাহার আহ্বান জানান। নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ারও কথা বলেন তিনি। জবাবে সংবিধানের কথা বলে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে জানানো হয়। ১/১১ প্রসঙ্গ টেনে দেশে নিরপেক্ষ কে তা জানতে চেয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। এ সময় বিএনপি নেতারা ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথাও বলেন। জবাবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সে সময়ের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। এখন ওই ধরনের কোনো পরিস্থিতি নেই। যদি পরিস্থিতি থাকত তাহলে জনগণ আন্দোলন করত। এখনো প্রয়োজন হলে জনগণ আন্দোলন করবে। পারলে আন্দোলন করেই এই দাবি আদায় করে নেয়ার চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দেয়া হয় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বিএনপির নেতারা দাবি তুললে জবাবে ক্ষমতাসীনেরা জানায়, এটি পুরোপুরি আদালতের বিষয়। তবে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা গায়েবি রাজনৈতিক মামলার বিষয়ে তদন্ত করে বিবেচনা করার আশ্বাস দেয়া হয়। সংলাপে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে এ প্রস্তাবেও ক্ষমতাসীনেরা কোনো সায় দেয়নি।
বিএনপির সিনিয়র এই নেতা জানান, ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেননি শুধু তার ওপর আস্থা রাখার কথা বলেছেন। নিরপেক্ষ সরকার, সংসদ ভাঙা ও খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে কোনো ফয়সালা না হলে প্রধানমন্ত্রীর ওপর কী জন্য আস্থা রাখতে হবে, তা এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রশ্ন। সঙ্গত কারণে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এ দিকে সংলাপের পর থেকে বিএনপির উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সংলাপের প্রকৃত বিষয়বস্তু জানতে আগ্রহী ছিল। ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি নেতাদের কার কি ভূমিকা ছিল তা-ও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের কাছে জানতে চেয়েছেন অনেকে। নেতারা বলেছেন, সঙ্ঘাত নয়, সমঝোতার মাধ্যমে বিএনপি শেষ পর্যন্ত সঙ্কট নিরসনের চেষ্টা করেছে এবং করবে। তবে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা না দেখে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হওয়ারও নির্দেশনা দিয়েছেন নেতারা।
সূত্রমতে, বিএনপির পাশাপাশি ঐক্যফ্রন্টের বেশির ভাগ নেতাও আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের পক্ষে। তবে দু-তিনজন নেতা আছেন তারা মনে করেন সব দাবি আদায় সম্ভব না হলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি এখনো আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব। এ জন্য আলোচনার জন্য আরো কিছু সময় নেয়া যায় কি না তা নিয়ে বিএনপি নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন তারা। জবাবে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, ঐক্যফ্রন্টের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনেরা যে আলোচনা করবে, সেই আলোচনায় কোনো লাভ হবে না। ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসবে না। আন্দোলনের মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যাতে ক্ষমতাসীনেরাই আলোচনার উদ্যোগ নেয়। সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হবে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপের আদ্যোপান্ত নিয়ে দলের শীর্ষ নেতারা গতকাল বৈঠক করেছেন। পরবর্তী করণীয় নিয়ে তারা শলাপরামর্শ করেছেন। দু-এক দিনের মধ্যে দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা ও জোটের সাথে বৈঠক হতে পারে। লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও সংলাপের বিষয়বস্তু জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, বিএনপির হাইকমান্ড প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে ধরে নিয়েই আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্ট নেতাদের এরই মধ্যে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
বিএনপির সূত্রমতে, সংলাপ হলেও তা সফল হবে না ধরে নিয়েই দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। এবার সংলাপ শেষ হওয়ায় চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তফসিল ঘোষণা করা হলে ওইদিন থেকে আন্দোলন শুরু করতে সব ধরনের প্রস্তুতি রাখতে দেশব্যাপী দলের সব ইউনিটে বার্তা দেয়া হয়েছে। আন্দোলন সফল করার জন্য প্রস্তুতির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ঢাকার জনসভা থেকে আন্দোলনের চূড়ান্ত নির্দেশনা আসবে।
৬ নভেম্বর ঢাকায় জনসভা : এ দিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে আগামী ৬ নভেম্বর ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, এ জন্য প্রয়োজনীয় অফিসিয়াল কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে চিঠি দেয়া হয়েছে। গণপূর্ত কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পুলিশের অনুমতি পেলে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
রিজভী জানান, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জনসভা সফল করতে আজ শনিবার বেলা ১১টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের যৌথ সভা হবে।
সংলাপের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিএনপির সিনিয়র এই নেতা বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে সংলাপে সরকারের একতরফা মনোভাব সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায়। সরকারের একগুঁয়ে মনোভাব গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অশনি সঙ্কেত। সংলাপে মানুষের মনে যে আশাবাদ জেগেছিল, সংলাপ শেষে সেই আশার মুকুল ঝরে পড়তে শুরু করেছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সাত দফা দাবি মেনে না নিলে রাস্তায় নেমেই আদায় করা হবে।
নৈশভোজে অংশ নেননি ঐক্যফ্রন্ট নেতারা : এ দিকে সংলাপে অংশ নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা নৈশভোজে অংশ নিয়েছেন বলে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে, সেটি সঠিক নয় বলে জানা গেছে। সংলাপে অংশ নেয়া কমপক্ষে পাঁচজন নেতা জানান, জুস, বাদাম, চিপস জাতীয় খাবার পরিবেশন করা হলে, ভদ্রতার খাতিরে তারা সেগুলো গ্রহণ করেছেন। নৈশভোজে তারা অংশ নেননি।
পরপর দু’টি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়ার ঘটনার প্রতিবাদে নৈশভোজে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপির। পরে ঐক্যফ্রন্ট নেতারাও তাতে একাত্মতা প্রকাশ করেন।