তৎকালীন ওসি এমদাদুল হক শেখ, তার পরবর্তী ওসি ফিরোজ হোসেন ও এসআই হিমেলসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত দল। পিবিআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ সদস্যরা অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
জনির স্ত্রী জেসমিন নাহারের রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট জনিকে খুঁজে বের করতে পিবিআইকে নির্দেশ দেন। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই দেয়া ওই নির্দেশে দুই মাসের মধ্যে আদালতে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
এরপর পুলিশ সদর দফতরের আইন শাখা থেকে আদালতের নির্দেশে পিবিআই’র বিশেষ পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মিয়া মাসুদ করিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- পিবিআই’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল মতিন (যশোর) এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খুলনা) মোহাম্মদ আনিছুর রহমান। ২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর পুলিশ সদর দফতরের আইন কর্মকর্তার কাছে মিয়া মাসুদ করিম তদন্ত প্রতিবেদন পাঠান।
পিবিআই’র তদন্ত প্রতিবেদেন বলা হয়, সাতক্ষীরা সদর থানা পুলিশ অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে চরম অদক্ষতা ও অবহেলার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। তৎকালীন ওসি এমদাদুল, পরবর্তী ওসি ফিরোজ ও এসআই হিমেলসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে বলে প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়।
এর আগে গত বছরের ২৮ অক্টোবর পিবিআই খুলনা বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার নওরোজ হাসান তালুকদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি পিবিআই’র ডিআইজির কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে।
এ প্রতিবেদনে বলা হয়, জনির নিখোঁজের ঘটনায় মামলা বা জিডি না নিয়ে কর্তব্যে অবহেলার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা বাহিনীর ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
সদর দফতরের নির্দেশ অগ্রাহ্য:
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুলিশ সদর দফতরের আইন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল করিম সংশ্লিষ্ট এআইজিকে চিঠি দেন। এতে বলা হয়, পিবিআই’র গঠিত তিন সদস্যের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের আলোকে জনিকে আটক ও পরে নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে ওসি এমদাদুলের সংশ্লিষ্টতার সত্যতা পাওয়া গেছে।
এ কারণে আইজিপি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এমদাদুলের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হল তা নিম্ন স্বাক্ষরকারীকে (পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট-২) জানাতে বলা হয়।
একই দিন অপর এক চিঠিতে পুলিশ সদর দফতর থেকে এসআই হিমেলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সাতক্ষীরার তৎকালীন এসপি আলতাফ হোসেনকে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এক বছরেও দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর দফতরে গিয়েও তার সাক্ষাৎ মেলেনি। পুলিশ সদর দফতরে অতিরিক্ত ডিআইজি আব্দুল্লাহ হিল বাকীসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পুলিশ সদর দফতরের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা একেএম কামরুল আহসান জানান, এ বিষয়ে বেশকিছু অভিযোগ পুলিশ সদর দফতরে এসেছে। কিছু অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়েছে। কিছু তদন্তাধীন।
ওসি এমদাদুলসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও তিনি জানান। জানতে চাইলে সাতক্ষীরার তৎকালীন এসপি (বর্তমানে টুরিস্ট পুলিশের সদর দফতরে কর্মরত) আলতাফ হোসেন বলেন, গত ডিসেম্বরে তাকে টুরিস্ট পুলিশে বদলি করা হয়েছে।
ওসি এমদাদ বা এসআই হিমেলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা তা তার জানা নেই। জনিকে আটক বা গ্রেফতার করার বিষয়টি অস্বীকার করে ওসি এমদাদুল হক শেখ বলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দফতর থেকে যে চিঠি দেয়া হয়েছিল তার লিখিত জবাব দেয়া হয়েছে।
এরপর তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা তা তার জানা নেই। জনিকে গ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করে এসআই হিমেল যুগান্তরকে বলেন, ঘটনাটি দুই বছর আগের। এ বিষয়ে তার তেমন কিছু স্মরণ নেই। শুনেছি জনি জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল। তবে তার বিচার হতে পারত। এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াটা কাম্য নয়।
সাতক্ষীরা থানায় ৩ দিন থাকার পর নিখোঁজ
জনির ইমামতিতে নামাজ পড়ে হাজতিরা
জুডিশিয়াল তদন্ত * আল্লাহর দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই * ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অন্যত্র পাঠানো হয়!
সিরাজুল ইসলাম ও আবদুল্লাহ আল মামুন ০২ নভেম্বর ২০১৮,
দুই বছর ধরে নিখোঁজ হোমিও চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান জনি থানা হাজতে থাকার সময় জামাতে নামাজ পড়তেন। সেখানে তার ইমামতিতেই অন্যরা নামাজ পড়তেন।
জনির সন্ধানে গঠিত জুডিশিয়াল তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সাতক্ষীরা সদর থানা থেকে ২০১৬ সালের ৮ আগস্টে নিখোঁজ হন ডা. জনি। কিন্তু ৪ আগস্ট সাতক্ষীরা শহর থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়।
জনির সন্ধান চেয়ে ২০১৭ সালের ১ মার্চ হাইকোর্টে রিট করেন তার স্ত্রী জেসমিন নাহার। একই বছরের ৯ মে হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর বেঞ্চ জনির অবস্থান চিহ্নিত করে জুডিশিয়াল তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
২০১৭ সালের ৬ জুন সাতক্ষীরার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হাবিবুল্লাহ মাহমুদ তদন্ত শুরু করেন। তদন্তকালে তিনি ২৩ জনের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এছাড়া সাতক্ষীরা সদর থানার হাজত রেজিস্ট্রার ও জিডি রেজিস্ট্রার খতিয়ে দেখেন এবং থানা হাজত পরিদর্শন করেন।
একই বছরের ২৯ জুন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাফিজুল ইসলামের কাছে তিনি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই দিনই প্রতিবেদনটি সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠানো হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদ বলেন, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পুলিশি অভিযানের কথা স্বীকার করেছেন। জেসমিনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাজতি রেজিস্ট্রার পর্যালোচনা করে সোনামনি শাহানাজ আক্তার ও তার স্বামী আসাদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন।
সোনামনিকে জেসমিনের ছবি (মোবাইল ফোনে তোলা) দেখানো হলে তিনি বলে ওঠেন, এটা তো সেই ভাবী…। সোনামনির এমন জীবন্ত ঘটনার বর্ণনায় যে কাউকে ঘটনার সত্যতার ব্যাপারে প্রত্যয় সৃষ্টি করবে।
সোনামনির সঙ্গে থানায় দেখা হওয়া ও তাদের মধ্যকার কথোপকথনের যে বর্ণনা জেসমিন দিয়েছেন তাতে সোনামনির বক্তব্যের হুবহু মিল রয়েছে। জনির ছবি দেখে আসাদুর জানান, জনিকে থানা হাজতে কখনও হাফহাতা গেঞ্জি ও প্যান্ট এবং কখনও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দেখেছেন।
২০১৬ সালের ৭ আগস্ট গ্রেফতার হাসানও জনির ছবি দেখে চিনতে পারেন। হাসান জানান, জনির বাসা থেকে আনা খাবার তারা থানা হাজতে বসে একসঙ্গে খেয়েছেন এবং জনির ইমামতিতে তারা নামাজও পড়েছেন।
প্রতিবেদনে হাবিবুল্লাহ মাহমুদ আরও বলেন, ৫ আগস্ট আদালতে চালান করা আসামি আমিনুল ইসলামও জনিকে থানায় দেখেছেন। স্থানীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী লায়লা পারভীন সেঁজুতি স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্তভাবে জনির ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি জানান, জনির খোঁজ নিতে তিনি তার স্বামী আজাদকে থানায় পাঠিয়েছিলেন। পরে তিনি নিজেও গেছেন। তৎকালীন ওসি এমদাদ তাকে জানান লাবণী সিনেমা হলের কাছে এক ফটোকপির দোকান থেকে এক জঙ্গিকে ধরা হয়েছে। সেঁজুতির বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে থানা থেকে জনিকে অন্যত্র পাঠানো হয়েছে।
এসআই হিমেল ও জেসমিনের কথোপকথনের অংশবিশেষ জেসমিনের মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা হয়। ৪ মিনিট ১০ সেকেন্ডের রেকর্ডের ৩৩ সেকেন্ডর সময় এসআই হিমেলের কণ্ঠে শোনা যায়, ‘ওরে ঢাকায় পাঠিয়ে দিবা।’
৪৮ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট ৯ সেকেন্ড অংশ পর্যালোচনায় স্পষ্ট, ‘ওরে’ সর্বনাম দিয়ে জনিকেই বোঝানো হয়েছে। ২ মিনিট ১৯ সেকেন্ডেও জনির তৎকালীন অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কিত বিষয় এসআই হিমেলের জানা ছিল।
কথোপকথনের ৩ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডের সময় হিমেল বলেন, ‘অনেক ছেলেপিলে আছে, তাদের কি আমরা ধরছি?’ এতে স্পষ্ট এসআই হিমেলের নেতৃত্বাধীন পুলিশ জনিকে ধরেছিল বলে প্রমাণিত।
এছাড়া কথোপকথনের এক পর্যায়ে কাউকে নির্দেশ দিয়ে এসআই হিমেল বলেন, ‘প্রতিবেদনে রাশেদ, আনোয়ারা, মোখলেছুর (জনি) এই প্রত্যেকের নামের পাশে ভোটার কার্ড এনআইডি নম্বর দিয়ে দিবা।’ জনিকে আটকের বিষয়ে এ রেকর্ড গুরুত্বপূর্ণ ও অকাট্য প্রমাণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসআই হিমেল জিজ্ঞাসাবাদে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ জনির পরিবারের সবাইকে ডাকার বিষয়টি স্বীকার বা অস্বীকার করেননি। থানার ওসি, সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার ও ডিএসবি কর্মকর্তা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর জিডি করতে জেসমিন থানায় গেলে ওসি ফিরোজ মোল্লা (ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই ওসি এমদাদ বদলি হন) জিডি গ্রহণ করেননি। এ সংক্রান্ত কথোপকথনের রেকর্ডও জেসমিন সরবরাহ করেন।
ওসি ফিরোজ মোল্লাও বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী জিডি গ্রহণ করা হয়নি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর জেসমিন সাতক্ষীরার এসপির সঙ্গে দেখা করতে তার অফিসে যান।
ব্যস্ততার অজুহাতে এসপি তার সঙ্গে দেখা করেননি। তবে ওইদিন তিনি এসপি অফিসে ডিআইও-১ (জেলা এসবির প্রধান) পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। ওই কথোপকথন জেসমিন তার মোবাইল ফোনে রেকর্ড করেছেন।
তবে তদন্তকালে জেসমিনের সাক্ষাৎপ্রার্থী হওয়ার বিষয়টি এসপি আলতাফ ও ডিআইও-১ মিজানুর রহমান অস্বীকার করেন। ওই সময়ের এসপি অফিসের রেজিস্ট্রার তলব করা হলে এক চিঠি মারফত এসপি জানান, চলতি বছরের শুরুতে সেটি ধ্বংস করা হয়েছে।
জুডিশিয়াল প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একরামুল হাবীবও জনির বিষয়ে তদন্ত করেছেন। ওই সময় জনিকে ‘আল্লাহর দলের সদস্য এবং সাতক্ষীরা জেলার নায়ক’ বলে উল্লেখ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে এসপি আলতাব সাতক্ষীরা থানার ওসি ও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির বরাত দেন। তবে ওই কমিটির সদস্যরা (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কেএম আরিফ, এএসপি সার্কেল ও ডিআইও-১ মিজানুর রহমান) এ বিষয়ে কোনো তদন্ত করেননি বলে জানান।
জনির সম্পর্কে এ তথ্য অস্বীকার করেছেন ওসি শেখ এমদাদ। তথ্যগুলো এসপি আলতাব কোথায় পেলেন তার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অতিরিক্ত ডিআইজি একরামুল হাবীবের তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জুডশিয়াল প্রতিবেদনে বলা হয়, এসআই হিমেল ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট ঝাউডাঙ্গা-বল্লি বিটে দায়িত্ব পালন করেন।
পরদিন ভোর ৫টা ৫ মিনিটে জিআর ২৪৮/৪ মামলার আসামি জুল হাসানকে গ্রেফতার করে থানায় হাজির হন।
সরেজমিন থানায় গিয়ে জিডি পরিদর্শনে দেখা যায়, ৩ আগস্টের ১০০ নম্বর জিডিতে বিকাল পৌনে ৪টায় জুল হাসান নামের আসামিকে এসআই আবুল কালাম ও এসআই আবদুল মালেক গ্রেফতার করে থানায় এনেছিলেন এবং সন্ধ্যায় ৬টা ১০ মিনিটে ১০৮ নম্বর জিডিতে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে জুল হাসান জানান, পুলিশ তাকে কখনও গ্রেফতার করেনি। এ কারণে জনিকে গ্রেফতারের সময় এসআই হিমেল যাকে গ্রেফতার করেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। ঘটনাটি সাজানো হয়েছে। জিডিতে এ ধরনের অনিয়মের বিষয় আগেও উদঘাটিত হয়েছে।
জুডিশিয়াল প্রতিবেদনে বলা হয়, থানার হাজত রেজিস্টারে কোনো আসামি গ্রেফতারের তারিখ বা সময় উল্লেখ নেই। এমনকি থানায় কখন আনা হল তার সময়ও উল্লেখ করা হয় না। এতে কেবল আদালতে পাঠানোর তারিখ উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনের চূড়ান্ত মতামতে বলা হয়, জনিকে আটকের ব্যাপারে এসআই হিমেল ও ওসি এমদাদুল হক শেখের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এসপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা আছে বলেও প্রতীয়মান। এসব ক্ষেত্রে মামলা বা জিডি না নেয়ার মাধ্যমে পুলিশ বিভাগ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের চরম অবহেলা করেছে।
সাতক্ষীরা থানায় ৩ দিন থাকার পর নিখোঁজ
দুই বছরেও সন্ধান মেলেনি জনির
শিশুসন্তান নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে স্ত্রী * মামলা বা জিডি নেয়নি পুলিশ * এক কোটি টাকা ঘুষ দাবি! * ওসি এসপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত
সিরাজুল ইসলাম ও আবদুল্লাহ আল মামুন ০১ নভেম্বর ২০১৮
সাতক্ষীরার কুখরালি গ্রামের হোমিও চিকিৎসক ডা. মোখলেছুর রহমান জনি দুই বছর ধরে নিখোঁজ। থানা হেফাজতে তিন দিন থাকার পর তার আর খোঁজ মিলছে না। পুলিশ তাকে আটক করে থানা হেফাজতে নিলে তার স্ত্রী জেসমিন নাহার তার সঙ্গে পরপর তিন দিন সাক্ষাৎ করেন। এ সময় পুলিশ তার কাছে এক কোটি টাকা ঘুষ দাবি করে।
ঘুষ না দিলে তাকে জঙ্গি মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। যদিও তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। পুলিশের দাবি, ডা. জনিকে তারা আটক করেনি। তার পরিবারের কাছে ঘুষ দাবির বিষয়টি অবান্তর। এমনকি কাউকে কোনো হুমকিও দেয়া হয়নি।
ডা. জনি বিয়ের এক বছর তিন মাসের মাথায় নিখোঁজ হন। তার নিখোঁজের সময় জেসমিন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তাদের মেয়ে মাইমুনা আনজুম রশনির বয়স এখন ১৯ মাস। রশনি এখনও তার বাবার দেখা পায়নি।
রশনিকে নিয়ে স্বামীর সন্ধানে জেসমিন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোথাও তার খোঁজ মিলছে না। থানা মামলা বা জিডি না নেয়ায় স্বামীর সন্ধান চেয়ে জেসমিন আদালতে মামলা করেছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে জুডিশিয়াল ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করেছে।
উভয় তদন্তে ডা. জনির থানা হেফাজতে থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে। এ দুই তদন্ত প্রতিবেদনসহ সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত যুগান্তরের হাতে এসেছে। জুডিশিয়াল তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এ ঘটনার সঙ্গে ওসি ও এসপিসহ উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট রাতে ডা. জনি নিখোঁজ হন। অসুস্থ বাবার জন্য ওষুধ কিনতে শহরের নিউমার্কেট এলাকায় গেলে সাতক্ষীরা সদর থানার এসআই হিমেল তাকে আটক করে।
তাকে আটকের কথা পুলিশ অস্বীকার করলেও ৫ আগস্ট থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত থানা হাজতে তাকে খাবার দিয়ে আসেন জেসমিন। এরপর থেকে তার আর খোঁজ মিলছে না। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনে যুগান্তরের পক্ষ থেকে সম্প্রতি দুই সপ্তাহ অনুসন্ধান চালানো হয়।
দুটি তদন্তে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন- সাতক্ষীরার তৎকালীন এসপি আলতাফ হোসেন (বর্তমান ট্যুরিস্ট পুলিশের সদর দফতরে কর্মরত), সাতক্ষীরা থানার তৎকালীন ওসি এমদাদুল হক শেখ (ঝিনাইদহে কর্মরত) ও এসআই হিমেল (ঢাকায় কর্মরত)।
যুগান্তরকে জেসমিন বলেন, ওই রাতে তার শ্বশুর শেখ আবদুর রাশেদ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে জনি সাতক্ষীরা নিউমার্কেট এলাকায় ওষুধ কিনতে যান। এরপর থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
রাত ১টার দিকে পুলিশ বাড়িতে তল্লাশি করতে এলে তারা বুঝতে পারেন রনিকে পুলিশ আটক করেছে। পরদিন খুব সকালে শ্বশুরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি থানায় যান। এ সময় পুলিশ জানায় জনি নামে কাউকে আটক করা হয়নি।
এক পর্যায়ে তারা থানা হাজতের গ্রিল ধরে জনিকে দাঁড়িয়ে থাকে দেখেন। তখন রাশেদ বলেন, ‘ওই তো আমার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, আপনারা কেন বলছেন আমার ছেলে থানায় নেই?’ জনির কাছে তারা যেতে যাইতে চাইলে পুলিশ বকাঝকা করে।
ওইদিন (৫ আগস্ট) সকাল ১০টার দিকে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে জেসমিন তাকে কলা ও পাউরুটি দেন। তার সঙ্গে তিনি কিছু সময় কথাও বলেন। তখন জনি জানান, এসআই হিমেলে নিউমার্কেট থেকে তাকে আটক করেছে।
জেসমিন আরও বলেন, থানায় এসআই হিমেলকে দেখে তার শ্বশুর বলেন ‘স্যার আমার ছেলেকে কেন আটক করেছেন? তখন রেগে গিয়ে হিমেল বলেন, ‘তাকে আটক করেছি এটা কে বলল?’ তখন জেসমিন জানান, আমরা তো থানা হেফাজতে তাকে দেখেছি।
খাবারও দিয়েছি। তখন এসআই হিমেল বলেন, ‘জনি যে অপরাধী এ কথা আমরা বলতে পারছি না। এ নিয়ে তদন্ত চলছে। নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। তদন্তের জন্য তাকে রেখে দিয়েছি। তদন্ত শেষে হলে একটা ব্যবস্থা নেব। আর তাকে যে আটক করা হয়েছে এ বিষয় দুই কান থেকে তিন কান করবেন না। বিষয়টি জানাজানি হলে জনির ক্ষতি হবে।’
জেসমিন বলেন, পরদিন তিন বেলা থানা হেফাজতে জনিকে খাবার দেই। থানায় ঘোরাঘুরি করতে দেখে ওসি এমদাদ আরেক আসামির স্ত্রী ও আমাকে তার রুমে ডাকেন।
এ সময় তিনি ওই মহিলাকে বলেন, ‘তোর স্বামী ডাকাত কেন এবং তাকে কক্ষ থেকে বের করে দেয়।’ এরপর ওসি আমাকে গালিগালাজ শুরু করেন। এ সময় এসআই হিমেল ওসির রুমে গেলে তিনি বলেন, এটাকেও (জেসমিন) জঙ্গি বলে চালান দে।
দ্বিতীয় দিন দুপুরে খাবার দিতে গেলে ওসি এমদাদ তার রুমে আমাকে ডেকে নেন। তখন তার কক্ষে এসআই হিমেল ও এসআই হাসিব ছিলেন। এ সময় ওসি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কত টাকা নিয়ে এসেছ?
স্বামীকে ছাড়িয়ে নিতে হলে টাকা দিতে হবে। কত দিতে পারবা? কত টাকা দিতে হবে জানতে চাইলে বলা হয়, ‘এক কোটি টাকা দিতে হবে।’ এক কোটি টাকা কীভাবে দেব বলায় ওসি রেগে গিয়ে বলেন, এটাকেও নিয়ে যা, গ্রেফতার কর, জিজ্ঞাসাবাদ কর।
সাক্ষাৎকারে জেসমিন নাহার বলেন, তৃতীয় দিন ওসি তার শ্বশুর রাশেদকে কক্ষে ডেকে নিয়ে খুব গালিগালাজ করেন। ওসি বলেন, সাতক্ষীরা থেকে তাকে ভিটেমাটিছাড়া করব।
এতে রাশেদ অসুস্থ হয়ে পড়েন ও কান্নাকাটি করেন। এরপর আমাকে ডেকে নিয়ে ওসি বলেন, যেটা বলছি সেটা জনিকে বোঝাও। ‘ও জঙ্গি’ এটা জনিকে বলতে বল। তা না হলে ওকে মেরে ফেলব।
যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলার সময় শেখ রাশেদ কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, তার ছেলেকে পুলিশ অনেক মেরেছে, তার হাত দুটো ভেঙে ফেলেছে। জনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। থানা হাজতে ছেলেকে বলেছিলাম, বাবা তুমি যা জান, তোমার মনে যা আছে সব সত্য কথা বল।
মিথ্যা বলবা না। তখন ওসি এমদাদ আমাকে বলেন, ‘এই শুয়োরের বাচ্চা, এখান থেকে বের হয়ে যা, তোরে কিন্তু শুট করে দেব, বের হ। তোদের যেন আর থানা চত্বরে না দেখি।’
যুগান্তরকে জেসমিন আরও জানান, ওসির সঙ্গে কথা বলার পর তার দুলাভাই ও কমিশনার কালু জানান, ‘জনির জঙ্গি কানেকশন আছে। সে আল্লাহর দল করে। ওকে মেরে দেব।’ তারা আরও বলেন, যদিও তদন্তে তার জঙ্গি কানেকশন পাওয়া যায়নি এবং তার নামে কোথাও কোনো অভিযোগ বা মামলা নেই।’
জেসমিন বলেন, ৮ আগস্ট থানায় এক কনস্টেবল জানান জনিকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে ওসি এমদাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তোর স্বামী কোথায় এটা আমরা জানি না।
আমরা তাকে ধরিনি, যা এখান থেকে বের হয়ে যা, একটা কথাও বলবি না।’ এরপর থানা থেকে বের হয়ে প্রেস ক্লাবে (সাতক্ষীরা) গিয়ে এসআই হিমেলকে ফোন দিয়ে জানতে চাই, জনি কোথায়? তখন হিমেল বলেন, এসপি স্যার (তৎকালীন এসপি আলতাফ হোসেন) তাকে নিয়ে গেছেন। আমি কিছু জানি না।
জেসমিন জানান, প্রেস ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি আবুল কালাম আজাদসহ অন্য সাংবাদিককে বিষয়টি জানাই। সাংবাদিকরা ওসির সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু জনির কোনো খোঁজ পায়নি।
তিনি বলেন, এরপর থেকে থানা, জেলখানা, মেডিকেলসহ বিভিন্ন স্থানে জনির খোঁজ করেছি। কয়েকবার এসপি অফিসে গিয়েও এসপির সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। একই বছরের ২৪ আগস্ট স্বামীর সন্ধান চেয়ে এসপির কাছে আবেদন করেছি। অতিরিক্ত এসপি কেএম আরিফুল হকের (বর্তমানে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত) সঙ্গে কথা বলেছি।