ক্রাইমবার্তা রিপোর্ট
শেখ শাওন আহমেদ সোহাগ, কালিগঞ্জ: কালিগঞ্জের ধলবাড়িয়া ইউনিয়নে সরকারি খাস খাল দখলের উৎসবে মেতে উঠেছে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা। জনগুরুত্বপূর্ণ খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করায় পানি প্রবাহ চরমভাবে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে এলাকাবাসী চরম ক্ষতির সম্মুখিন হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। অবৈধ দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে জানা যায়, সীমান্ত নদী কালিন্দীর সাথে সংযুক্ত তাড়দ্দহ খাল দিয়ে উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাহাদুরপুর, হারিখালী, মহেশ^রপুর, বাজুয়াগড়, পিরোজপুর, উচ্ছেপাড়া, মুড়াগাছা, গান্ধুলিয়া ও মাদকাটি এলাকার পানি নিষ্কাশন হয়। বাঁশঝাড়িয়া বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন পোল্ডার-৫, ডিএস ৬ স্লুইজগেইট দিয়ে কালিন্দীর সাথে প্রায় ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে তাড়দ্দহ খালটি স্থানীয় সুবিধাবাদী ভূমিদস্যূর কারণে এখন মৃতপ্রায়। সরকারি খাল অবৈধ দখল হওয়ায় এসব গ্রামের নিচু অঞ্চল বর্ষা মৌসুমে পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষেত। বর্তমানে দখল আর অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ফলে সরকারি খালের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার মৎস্যজীবীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
বাহাদুরপুর মসজিদের মুয়াজ্জিন এন্তাজ আলী গাজী (৬৫), হরিখালী গ্রামের সুন্নত গাজী (৫০), মহেশ্বরপুর গ্রামের কুদ্দুস গাজী (৫২), বাজুয়াগড় গ্রামের আব্দুল ওয়াহেদ গাজী (৫৫), পিরোজপুর গ্রামের আব্দুস সাত্তার গাজী (৫৬), স্থানীয় ৪নং ওয়ার্ড মেম্বর গোলাম মোস্তফা গাজী (৪৮) সহ আরও কয়েকজন জানান, তাড়দ্দহ খালের মাধ্যমে স্লুইচগেট থেকে মহেশ^রপুর পর্যন্ত পানি প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। সরকারি এই খালের বেশ কয়েকটি স্থানে চিহিৃত ভূমিদস্যুরা অবৈধভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছে। কেউ কেউ পুকুর খনন করেছেন, আবার কিছু ব্যক্তি খালের পাড় মাটি ভরাট করে দিব্যি চাষাবাদ করছেন। বর্তমানে খালের মাত্র অর্ধ কিলোমিটার পর্যন্ত পানি প্রবাহমান রয়েছে। দখলবাজদের থাবা থেকে এখনও যেটুকু খাল মুক্ত রয়েছে তার মধ্যেও নেটপাটা দেয়ায় বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি প্রবাহ। কিছু স্থানে খাল অদৃশ্য হয়ে সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে।
তারা আরও জানান, একসময় উচ্ছেপাড়া, গান্ধুুলিয়া, বজরকাটি, পিরোজপুর, মহেশ্বরপুর, বাজুয়াগড়, হরিখালী, বাহাদুরপুর এলাকায় প্রায় ৪ শ’ একরের মতো ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক চিংড়ি ঘের ছিল। বর্তমানে পানির অভাবে প্রায় অর্ধেক ঘের বন্ধ হয়ে গেছে।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসী জানান, উচ্ছেপাড়া গ্রামের প্রভাবশালী জিয়াদ মিস্ত্রী খাল দখল করে সেমি পাকা ভবন নির্মাণ করেছেন। একই গ্রামের আরশাদ আলী ঘরবাড়ি নির্মাণ ছাড়াও বেশ কিছু জায়গা ঘিরে নিয়ে দখল করে নিয়েছে। বজরকাটি গ্রামের আফতাব তরফদার, আনোয়ার তরফদার, তার দুই সহোদর সিরাজ তরফদার ও হবি তরফদার, মহেশ^রপুরের সিদ্দিক গাজী, বাজুয়াগড়ের কওছার গাজী নির্মাণ করেছেন অবৈধ স্থাপনা। আবার কয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তি খাল ভরাট করে পজেশন আকারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। অবৈধ দখলের থাবা বিস্তার করতে ওই মহল স্লুইচগেইট দিয়ে খালে পানি উত্তোলন স্থায়ীভাবে বন্ধের জন্য মহাপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। এজন্য গত পয়লা মার্চ বজরকাটি গ্রামের আনোয়ার তরফদার হাইকোর্টে একটি রীট পিটিশন (২৪১৩/২০১৮) করেছেন।
তারা জানান, রীটকারী আনোয়ার তরফদার গান্ধুলিয়া গ্রামের হাফেজ আশরাফুল আলমের মালিকানাধীন প্রায় ৫ একর জমি নিয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাছের ঘের করেন। জমির মালিকের সাথে হারিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় পরবর্তীতে তিনি ঘের করতে ব্যর্থ হন। এখন অন্যরা যাতে ঘের করতে না পারে সেজন্য পরিকল্পিতভাবে রীট করেছেন। তাছাড়া আনোয়ার তরফদার ও তার দুই ভাই সরকারি খালের বেশ কিছু অংশ দখল করে নিয়েছেন। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে রীট পিটিশনটি খারিজ হয়ে যাবে বলে দাবি এলাকাবাসীর।
তারা বলেন, পয়লা এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মৎস্য ও চিংড়ি সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির ৩য় সভায় চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রান্তিক চিংড়ি চাষিকে এক অংকবিশিষ্ট সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। তাছাড়া চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম টেকসই ভিত্তিতে পরিচালনার জন্য উপকূলীয় এলাকায় বিদ্যমান অবকাঠামো, বিশেষত: পোল্ডারের স্লুইজচগেটসমূহ চিংড়ি ঘেরে পরিকল্পিত পানি প্রবেশ ও নির্গমন উপযোগী করে সংস্কার বা পুন:নির্মাণে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড তথা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তুস্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা চিংড়ি চাষ নিয়ে সরকারের এই মহাপরিকল্পনা ব্যর্থ করতে তৎপরতা চালাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, একই এলাকায় গেল্লের খাল খ্যাত বাজুয়াগড়-হরিখালী খালের জায়গা দখল করে নির্মিত অবৈধ স্থাপনা গত ৪ মার্চ উচ্ছেদ করেন তৎকালীন কালিগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নুর আহমেদ মাছুম। এসময় বাজুয়াগড় গ্রামের মৃত মোনতেজ গাজীর ছেলে গোলাম গাজী, শুকচাঁন গাজীর ছেলে গোলাম গাজী ও উচ্ছেপাড়া গ্রামের মৃত সেফাত উল্যাহ গাজীর ছেলে কাশেম গাজীর ঘরসহ কয়েকটি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কিছুদিন পর আবারও এসব স্থানে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। অবিলম্বে সরকারি খাস খালের অবৈধ দখল বন্ধ ও ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভুক্তভোগীসহ সচেতন মহল প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।