ক্রাইমবার্তা রিপোট: আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মন্তব্যে দেশবাসী স্তম্ভিত ও হতবাক। কারণ তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ‘নির্বাচনের অযোগ্য’! অথচ বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাজানো মামলায় দেয়া দ-ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন এবং তাতে তিনি স্থগিতাদেশ প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু সেই বিষয়ে আদালত এখনো সিদ্ধান্ত দেননি। আদালত আপিল গ্রহণ করেছেন কিন্তু কোনো প্রকার শুনানি হয়নি, আদালত কোনো প্রকার রুল বা আদেশ দেননি। তাহলে তিনি কিভাবে বললেন, বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না?
আজ বুধবার সকালে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রিজভী এসব কথা বলেন।
নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের সকল প্রস্তুতি প্রশ্নসাপেক্ষ। এই কারণে কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের বিজয় আনুষ্ঠানিকতা মাত্র’। সেই একতরফা নির্বাচনের আভাসই আমরা ফুটে উঠতে দেখছি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮৫টি উপজেলায় নির্বাচনী কর্মকর্তা নেই, যা ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমে সংবাদটি বেরিয়েছে। এই অবস্থায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বাছাই করে আওয়ামীমনা কর্মকর্তাদের নির্বাচনী দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোতে। আমাদের অভিযোগগুলো অতিকথন নয়, বরং নির্বাচন নিয়ে সরকারের চক্রান্তের গভীরতা ও ব্যাপ্তি আরো স্পষ্ট হচ্ছে।
রিজভী বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রশ্ন করতে চাই- মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিচারিক আদালতে সাজা হলেও, আপিল চলমান অবস্থায় তারা নির্বাচন করেছেন কিভাবে? অ্যাটর্নি জেনারেল আপনি তো আওয়ামী লীগের নেতা, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে নৌকা মার্কার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন তাহলে আপনি কিভাবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা থাকেন? সরকারি ক্ষমতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আপনার মতো দলবাজ আগ্রাসি আইন কর্মকর্তা থাকলে ন্যায় বিচার পাওয়ার সকল পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সাবজুডিশ বিষয়ে নির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট বক্তব্য রেখে তিনি সংবিধান ও আদালতের অবমাননা করেছেন। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে অবশ্যই পারবেন। এ বিষয়ে আইনে কোনো বাধা নেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে নজির হলো আপিল করেই নির্বাচন করা যাবে। কারণ আপিলকে ধরা হয় চলমান বিচারের অংশ। আপিল বিভাগের রায় আছে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর কে যোগ্য বা অযোগ্য সেটা ঠিক করবে ইসি। আর সেখানে যদি কোনো সংবিধান লংঘনের ঘটনা ঘটে তখন তা কেবল উচ্চ আদালতে আসতে পারে। এখন এটর্নি জেনারেল যা বলেছেন, তা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার শামিল। আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী যেকোনো রিটার্নিং অফিসার বেগম খালেদা জিয়ার তিনটি মনোনয়নপত্রই বৈধ বলে ঘোষণা দিতে পারেন। আইনে তাতে কোনো বাধা নেই।
রিজভী বলেন, ইসির নেয়া সিদ্ধান্তের বৈধতা রিটে পরীক্ষা না করতেও আপিল বিভাগের নির্দেশনা আছে। বৈধতা পরখ করতে চাইলে ভোটের পরে করতে হবে, ভোটের আগে নয়। তফসিলের পরে এগুলো নির্বাচনী বিরোধ হিসেবে বিবেচিত হবে। বিষয়টি দেখবেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। হাইকোর্টের বিচারকদের নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল অনধিক ছয় মাসের মধ্যে রায় ঘোষণা করবেন। আওয়ামী লীগ সরকারের অতীত নজির হলো একই দ-িত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সকালে একরকম আবার বিকেলে অন্যরকম সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিচারিক আদালতে দ-িত হওয়ার পরও আপিল করে সংসদ সদস্যপদ ও মন্ত্রীত্ব বহাল থাকার নজির আছে। দুর্নীতির মামলায় ২০০৮ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি আদালত ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে ১৩ বছর কারাদণ্ড দেন। আর সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় ২০১৬ সালের ৩রা নভেম্বর সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির তিন বছর কারাদ- দেন ঢাকার একটি আদালত। তাদের এমপি মন্ত্রীর পদ তারপরও বহাল থেকেছে। সুতরাং অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য দূরভিসন্ধিমূলকই নয় তিনি একজন চক্রান্তকারী, তিনি আদালতকে ভয় দেখিয়ে সরকারের হীনউদ্দেশ্য সাধনকারী। বিচারাঙ্গণে তার ভূমিকা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ন্যায়।
বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সন্ত্রাসের উর্বর ক্ষেত্র বানাবে ক্ষমতাসীন দল। তার আলামতগুলো এখন ফুটে উঠতে শুরু করেছে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে জনগণের মধ্যে ততো সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের গোপন বৈঠকের তথ্য ফাঁস হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ ও ইসির পক্ষ থেকে এসব বৈঠকের কথা অস্বীকার করা হলেও তথ্যগুলো যে সঠিক এটির বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রিজভী জানান, আওয়ামী লীগ যে কেন্দ্র দখল করে ভোট ডাকাতি করবে এটা তাদের মনোনীত প্রার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় ঘোষণাও দিয়েছেন। গণতন্ত্র, প্রশাসন, সুশাসন ধ্বংসকারীদের অন্যতম হোতা এইচটি ইমাম তার পুত্রকেও নিজের ইমেজে তৈরি করেছেন। এইচটি ইমামের পুত্র তানভীর ইমাম ইতোমধ্যে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ভোটের দিন কেন্দ্র দখল রাখতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ ফরিদপুরে এক সভায় বলেছেন, ‘নৌকার বিপক্ষে গেলে শালাদের গুলি করে মারবো’। এই বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গেমপ্ল্যান খুব সুস্পষ্ট, সেটি হলো বাংলাদেশে একটি পক্ষই থাকবে, সেটি হলো আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা।
রিজভী অভিযোগ করে জানান, সরকারের রিটায়ার্ড উপ-সচিব নিয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়াকে র্যাব-২ অফিসে নিয়ে যাওয়ার জন্য র্যাবের একজন কর্মকর্তা তার বাসায় আসেন। নিয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়ার সাথে ঘন্টাখানেকের জন্য কথা বলবে বলে গতকাল রাত ১০টার সময় তাকে বাসা থেকে নিয়ে যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। প্রশাসন স্বাভাবিক গতিতে চললে নিয়ামত উল্লাহ সাহেব এতদিনে মন্ত্রণালয়ের সচিব হতেন, অথচ তার মতো একজন সরকারি কর্মকর্তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে এখনো ফিরিয়ে না দেয়া সরকারের ভয়ঙ্কর বার্তা। এই ঘটনায় সারাদেশে জনপ্রশাসনসহ সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন, উদ্বেগ ও আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।
দেশজুড়ে চলমান গ্রেফতার এবং বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশী হানা ও তল্লাশীর নামে তান্ডব চালানো হচ্ছে জানিয়ে রিজভী বলেন, বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার জন্য যশোর গেছেন। গতকাল রাতেই অমিতের শান্তিনগরের বাসভবনে পুলিশ হানা দিয়ে তল্লাশীর নামে তান্ডব চালিয়েছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে ধারাবাহিকভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশী তল্লাশী ও গ্রেফতারের ঘটনায় কোন ভাষায় নিন্দা জানাবো তা আমার জানা নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক এধরনের ন্যাক্কারজনক অপকর্ম বন্ধের জোর আহবান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে সারাদেশের মতোই গতকাল ঢাকার নবাবগঞ্জ থানা বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে সিরিজ তল্লাশী শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তল্লাশীর নামে ব্যাপক ভাংচুর ও পরিবারের সদস্যদের সাথে অশোভন আচরণ যেন পুলিশের রুটিনওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাহবাগ থানা বিএনপি নেতা মো: শাহজাহান, মাসুদ, জামালকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশারের ওয়ারীর নিজ বাসা এবং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা মো: হযরত আলীর সেগুন বাগিচার বাসায় ঢুকে পুলিশ ব্যাপক ভাংচুর ও তছনছ করেছে। শেরপুরের শ্রীবর্দী উপজেলা বিএনপি নেতা নূরে আলমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আমি গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের অবিলম্বে নি:শর্ত মুক্তির জোর দাবি করছি এবং নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় পুলিশী তল্লাশীর নামে হামলা ও ভাংচুর বন্ধের আহবান জানাচ্ছি।