ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট :ঢাকা: তাবলীগ জামাতের ভেতরে দু’টি গ্রুপের দ্বন্দ্ব চলছে বেশ কিছুদিন ধরে – যা সহিংস রূপ নিয়েছে শনিবারের সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে আছেন তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা ভারতীয় মোহাম্মদ সাদ কান্দালভি।
এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই ঢাকার টঙ্গীতে এবার বিশ্ব ইজতেমার একটি তারিখ ঘোষিত হলেও পরে তা হয় নি। খবর বিবিসির।
তাবলীগ জামাতের একটি গ্রুপ ১১ই জানুয়ারি থেকে ইজতেমা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান নভেম্বর মাসে তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপকে নিয়ে বৈঠক করেন- যেখানে ওই তারিখে ইজতেমা না করার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু সাদ কান্দালভি কি করেছেন বা বলেছেন- যা নিয়ে এই বিভক্তি?
বেশ কিছু কাল ধরেই কান্দালভি তাবলীগ জামাতে এমন কিছু সংস্কারের কথা বলছেন- যা এই আন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।
সাদ কান্দালভি বলেন, ‘ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়’- যার মধ্যে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকান্ড পড়ে বলে মনে করা হয়।
সাদ কান্দালভি আরো বলেন, ‘মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত – যাতে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ে।’
কিন্তু তার বিরোধীরা বলছেন, সাদ কান্দালভি যা বলছেন- তা তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের নির্দেশিত পন্থার বিরোধী।
তাদের বক্তব্য, কান্দালভির কথাবার্তা আহলে সুন্নাত ওয়া’ল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে।
সাদ কান্দালভির বিরোধী একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতার মতে, সাদ কান্দালভি এখনো এ মতবাদ ছাড়েন নি। ‘তাই এটা যেন বাংলাদেশে ছড়াতে না পারে এবং মুসলিমরা যেন পথভ্রষ্ট না হয়, সে জন্য তারা কাজ করে চলেছেন।’
তিনি দাবি করেন, এর মধ্যে এক কণাও রাজনীতি নেই।
ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্নি মুসলমানদের বৃহত্তম সংগঠন এই তাবলীগ জামাতের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে- যখন তাদের মূল কেন্দ্র কাকরাইলে দুই দল কর্মীর মধ্যে হাতাহাতি হয়।
এর পর এ বছর জুলাই মাসে ঢাকায় কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমীর শাহ আহমদ শফী’র উপস্থিতিতে তাবলীগ জামাতের একাংশের এক সম্মেলন হয়। এতে সাদ কান্দালভিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়- দিল্লিতে তাবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাদ কান্দালভির বক্তব্য ও মতবাদকে অনুসরণ করা হবে না, এবং আগামী বিশ্ব ইজতেমার সময় তাকে বাংলাদেশে আসতেও দেয়া হবে না।
কিন্তু সাদ কান্দালভির সমর্থকরা বলছেন,তাদের নেতার বক্তব্য বা সংস্কারের প্রস্তাব মানতে না পেরেই বাংলাদেশে সংগঠনটির কর্মকান্ডকে ‘রাজনৈতিক চেহারা’ দেয়া হয়েছে।
তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির এসব চিন্তাভাবনা নিয়ে তাবলীগ জামাতের দু’টি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের প্রভাব ২০১৭ সালের ইজতেমাতেও পড়েছিল।
সে সময় এ নিয়ে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে- যখন সাদ কান্দালভি বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেও ইজতেমা প্রাঙ্গণে যেতে পারেন নি।
সাদ কান্দালভি তার বিরোধী পক্ষের প্রতিবাদের মুখে ঢাকায় তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় কাকরাইল মসজিদে অবস্থান নেন, এবং পরে সেখান থেকেই দিল্লী ফেরত যান।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী এখনো তবলীগ জামাতের প্রধান দফতর কাকরাইল মসজিদেই অবস্থান করছেন, কিন্তু কার্যক্রম চালাচ্ছেন আলাদা আলাদা ভাবে।
সাদ কান্দালভির সমর্থক গোষ্ঠীর একজনের মতে, তাবলীগ জামাতের ৯০ শতাংশই ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’ বা সা’দ কান্দালভি-র অনুসারী হিসেবেই আছেন। কিন্তু তার কিছু কথাকে একটি গোষ্ঠী সহজভাবে নিতে পারছেন না।
তার বিরোধীদের পেছনে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের লোকেরা সক্রিয় বলে বলা হলেও- হেফাজতের নেতারা এ অভিযোগ সরাসরি স্বীকার করেন না।
হেফাজতে ইসলামের একজন উর্ধ্বতন নেতা মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ বলেছেন, এখানে হেফাজত বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
এ বিরোধ এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের তাবলীগ জামাতের অনুসারীদের মধ্যে। ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তাবলীগ জামাতের নেতৃত্বের বিভক্তি দেখা দিয়েছে অনেকদিন আগেই।
বিরোধ মেটানোর চেষ্টা থাকলেও তাতে এখনো ইতিবাচক ফলাফল দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচন পর্যন্ত ইজতেমার সব আয়োজন বন্ধের সিদ্ধান্ত
৩০শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ কারণে নির্বাচন পর্যন্ত ইজতেমার সব আয়োজন বন্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। শনিবার বিকেলে সচিবালয়ে তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্
তের কথা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
তিনি বলেন, সভায় সর্বসম্মতিক্রমে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, ৩০ তারিখে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেজন্য আমরা আগেও বলেছিলাম নির্বাচনের আগে কোন ধরনের ইজতেমা হবে না। আমরা সেটাকেই আবার রিপিট করেছি-ইলেকশন পর্যন্ত ইজতেমার জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি সভা কিংবা জোড় ইজতেমা কিংবা ইজতেমার জন্য সব ধরনের কার্যকলাপ সারা দেশব্যাপী বন্ধ থাকবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা আবারও রিপিট করছি, ইজতেমার তারিখ কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না, ইজতেমার তারিখ শুধু শিফট হচ্ছে, ইলেকশনের পর যে কোন সময়ে এটা হবে।
তিনি বলেন, এখন থেকে ইজতেমার মাঠ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। প্রশাসন সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখবে আমরা সেখানে কাউকে অ্যালাউ করব না। আজকে যে ঘটনা ঘটেছে তারা সবাই নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন।
এ বিষয়ে ফৌজদারি মামলা হবে। ফৌজদারি মামলায় যেভাবে তদন্ত হয় সেভাবেই তদন্ত হবে। তদন্তে চিহ্নিত দোষী ব্যক্তিদের আইনানুযায়ী বিচার হবে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, দিল্লি মারকাজের মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভিপন্থী বাংলাদেশে তাবলিগের শুরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, বিরোধীপক্ষ কওমিপন্থী মাওলানা জুবায়েরের পক্ষ থেকে তাবলিগের উপদেষ্টা মাওলানা আশরাফ আলী ও আবদুল কুদ্দুস প্রমুখ। এদিকে প্রশাসনের পক্ষে বৈঠকে ছিলেন, পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া ও
মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ প্রমুখ।
উল্লেখ্য, এর আগে টঙ্গীতে পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা নিয়ে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দফায় দফায় সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু ও অর্ধ শতাধিক মানুষ আহত হন।