জোটের রাজনীতির সমীকরণ মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে আওয়ামী লীগ

জোট রাজনীতির সমীকরণে গরমিল আওয়ামী লীগে – ছবি : সংগ্রহ

ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট : জোটের রাজনীতির সমীকরণ মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে আওয়ামী লীগ। জোট-মহাজোটকে ঐক্যবদ্ধ রাখার পাশাপাশি পরিধি বৃদ্ধি করে আগামী নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়ার টার্গেট নিয়ে কাজ করছে ক্ষমতাসীনরা। এ জন্য শুরু থেকেই শরিকদের বড় ধরনের ছাড় দেয়ার জন্যও ইতিবাচক মনোভাব দেখায় জোট প্রধান দলটি। কিন্তু শেষমেশ নামকাওয়াস্তে কিছু ভুঁইফোড় দল যুক্ত হয়েছে মহাজোটের সাথে। আর বড় বড় হেভিওয়েট নেতারা ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়ায় জোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সমীকরণে গরমিল দেখা দিয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচন নিয়ে হিসাব কষতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে ক্ষমতাসীনরা। যার কারণে গত মাসে একাধিকবার আসন বণ্টনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করতে গিয়েও সরকারি দল ধাক্কা খেয়েছে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ আশা করেছিল, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে বড় বড় হেভিওয়েট নেতা এবং ২০ দলীয় জোটের বড় একটি অংশ সরকারের সাথে যুক্ত হয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন। কিন্তু শেষমেশ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর সে আশায় ঘুণ ধরেছে। ঐক্যফ্রন্টে আছেন আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান হোসেন মনসুরসহ আওয়ামী লীগের সাবেক হেভিওয়েট নেতারা। সর্বশেষ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া, আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদসহ ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করায় জোটের সমীকরণ উল্টো দিকে মোড় নেয়া শুরু করেছে। ঐক্যফ্রন্টের বাইরে যেসব বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা আছেন তাদের বড় একটি অংশ ঐক্যফ্রন্টের সুরে কথা বলায় এবং মাত্র কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও বিশিষ্ট টকশোবিদ গোলাম মাওলা রনি বিএনপিতে যোগদান করায় সরকারি দল অনেকটা অস্বস্তিতে পড়েছে। তা ছাড়া জোট-মহাজোটের সাথে আসন বণ্টনের দরকষাকষিতে এখনো বনিবনা না হওয়ায় তাদের বন্ধন অনেকটা আলগা হয়ে গেছে। বিশেষ করে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির সাথে আসন বণ্টনের হিসাব এখনো মেলাতে পারেনি। চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ না মেলায় গত মাসে একাধিকবার আসন বণ্টনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করতে গিয়েও পিছু হটে ক্ষমতাসীনরা।

জোট-মহাজোটের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ থেকেই জোটে টানার জন্য তৎপরতা শুরু করে আওয়ামী লীগ। ছোট বড় বেশ কিছু দলের সাথে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যোগাযোগ করেন। আবার কিছু দলও আওয়ামী লীগ জোটে ভেড়ার জন্য ওবায়দুল কাদেরের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেন। এর মধ্যে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার জোট-বিএনএ, জাকের পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ, হেফাজতে ইসলামের একাংশ ও ইসলামিক ইউনাইটেড পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল ও জোট নেতারা ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে সরকারি জোটের সাথে যুক্ত হয়েছেন। গত ১৮ জুলাই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি এবং বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন- এ দলগুলো মিলে নতুন একটি বাম রাজনৈতিক জোট গঠিত হওয়ার পরই ক্ষমতাসীন জোটের বাইরে থাকা গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স, সম্মিলিত ইসলামিক জোট, কৃষক শ্রমিক পার্টি, একামত আন্দোলন, জাগো দল, ইসলামিক ফ্রন্ট ও গণতান্ত্রিক জোটসহ ৯টি দলের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এরপর গত ২৪ জুলাই ওবায়দুল কাদের সিপিবির কার্যালয়ে সিপিবির সভাপতি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সাথে বৈঠক করে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। এর আগে কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টির সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমেদসহ আলোচিত বেশ কিছু নেতার সাথে ফোনে কথাও বলেন। এরপরই গত ২৬ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে বৈঠক করেন কাদের সিদ্দিকী। সম্প্রতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলে সেখান থেকে বাদ পড়ে যুক্তফ্রন্টের সামনের সারিতে থাকা বিকল্প ধারা। দলটি ভেঙে গিয়ে এখন সাবেক প্রেসিডেন্ট বি. চৌধুরীর বিকল্প ধারা সরকারের সাথে যুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এর সাথে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক ন্যাপ ও এনডিপি ভেঙে ক্ষুদ্র একটি অংশ সরকারের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করছেন।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম শরিক ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, রাজনীতির বাইরে অনেকেই অনেক কিছু। কিন্তু নির্বাচনে গেলে বোঝা যায় কার কতটুকু আছে। তিনি বলেন, মহাজোটের সাথে অনেক দলই কাজ করছে। কিন্তু এখনো কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। এটা পরিষ্কারভাবে জানতে হলে, আগামী ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের ১৪ দলীয় জোট আছে। এর বাইরে মহাজোট আছে। সেখানে জাতীয় পার্টি আছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মহাজোটের পরিধি বেড়েছে। এখানে যুক্ত হয়েছে যুক্তফ্রন্ট, ইসলামী ঐক্যজোটসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী দল। তাদের অনেককেই ইতোমধ্যে আসন বণ্টন করে দেয়া হয়েছে। আরো কিছু বাকি আছে। আগামী ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে সেগুলোও চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, ছোট দল নিয়ে জোট গঠন করলে লাভ-ক্ষতি দুটোই আছে। যদি ওই দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকে তাহলে ভোটারদের মধ্যে এর প্রভাব পড়ে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ছোট ছোট দল নিয়ে জোটের রাজনীতি শুরু হয় ভারত বিভাগের পর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে। ওই সময় যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সাথে আওয়ামী লীগ জোট গঠন করে। নব্বই-পরবর্তী রাজনীতিতে একানব্বই সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে রাজনীতিতে জোটের আবেদন বৃদ্ধি পায়। পরে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও জাসদের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বিএনপি ঘরে বসে থাকেনি। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট গঠন করে বিএনপি সরকার গঠন করে। এরপরই জাতীয় পার্টিকে সাথে নিয়ে ২০০৬ সালে মহাজোট গঠন করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। বিএনপি ছোট ছোট দলগুলোকে একত্রিত করার মধ্য দিয়ে চারদলীয় জোট এখন ২০ দলীয় জোটে রূপ নিয়েছে। আবার সম্প্রতি গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে সাথে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে দেশ-বিদেশে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিএনপি। আগামী নির্বাচনে জোটের রাজনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখন দেশবাসী দেখার অপেক্ষায়।

Check Also

তাবলীগ জামায়াতের সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ-সমাবেশ

মুহাম্মদ হাফিজ, সাতক্ষীরা : তাবলীগ জামাতে সাদপন্থীদের বর্বোরিচত হামলার প্রতিবাদ ও সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগের সহসভাপতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।