এবারের নির্বাচনে অনেক রেকর্ড তৈরি হচ্ছে বা হবে। তার একটি হলো প্রার্থী ও দলের সংখ্যা। দলের সংখ্যা অগুনতি। তারা অনেকে মিলে আবার ‘জোট’ বানিয়েছে। তো জোটের সংখ্যাও বেশ কয়েকটি। জোটের নেতারা সবাই তাঁদের জোটভুক্ত সব দলের নাম বলতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এদের বেশির ভাগেরই নিবন্ধন নেই। তাতে কী? দল বানানোর স্বাধীনতা তো আছে। ছোটবেলায় স্কুলে পড়েছি, ‘কয়েকটি ঘর লইয়া একটি বাড়ি হয়।’ এখন কয়েকটি লোক লইয়া একটি দল হয়, কয়েকটি দল লইয়া একটি জোট হয়।
নির্বাচনের ময়দানে মুখ্য জোট দুটি। একটি হলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘মহাজোট’, অন্যটি হলো বিএনপিকেন্দ্রিক ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’। দুই জোটেই ধর্মাশ্রয়ী দলের ছড়াছড়ি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে এদের সংখ্যা কম, মহাজোটেই বেশি। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার কথা বুলন্দ আওয়াজে যতই ডংকা বাজানো হোক না কেন, ‘মুসলমান’ ভোটব্যাংকটির দিকে নজর উভয় পক্ষেরই। ঐক্যফ্রন্টের ঘরের মধ্যে একটি অদৃশ্য জানালা আছে। সেটি হলো ২০-দলীয় জোট। তার অন্যতম শরিক হলো জামায়াতে ইসলামী। দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেলেও তার অবস্থান পাল্টায়নি। এই দলের লোকেরা ঐক্যফ্রন্টের মার্কা ‘ধানের শীষ’ নিয়ে লড়বেন। এ নিয়ে প্রতিপক্ষ আওয়ামী মহলে গুঞ্জন-দেখো দেখো, কামাল-রব-সিদ্দিকী-মান্নারা জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। ছি ছি, কী অধঃপতন!
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে যে নির্বাচনটি হওয়ার কথা ছিল, তার আগে আওয়ামী লীগ ধর্মান্ধ খেলাফত মজলিশের সঙ্গে একটি পাঁচ দফা চুক্তি করেছিল। চুক্তির অন্যতম দফা ছিল ‘আলেম’দের ফতোয়া দেওয়ার অধিকার মেনে নেওয়া। ওই নির্বাচনটি আর হয়নি। ওই চুক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগও পরে আর উচ্চবাচ্য করেনি। কিন্তু সরলপ্রাণ মুসলমান ভোটারের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট নেওয়ার কৌশল থেকে দলটি পিছিয়ে এসেছে-এ কথা বলা যাবে না। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাদের সাম্প্রতিক মোলাকাত ও বোলচাল সে রকমই ইঙ্গিত দেয়। ‘হেফাজত’ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এর প্রধান নেতা আল্লামা শফী বলেছেন, আওয়ামী লীগ যে এত ভালো দল, শেখ হাসিনা যে এত খাঁটি মুসলমান, এটা তিনি আগে বুঝতে পারেননি। তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছিল। এখন তিনি খাঁটি সোনা চিনতে পেরেছেন। তিনি এ-ও বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম কোনো দলের হয়ে কাজ করবে না। যদি কেউ করেন, তিনি তা নিজ দায়িত্বে করবেন।
হেফাজতের দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক আছে। আছে সারা দেশ অচল করে দেওয়ার ক্ষমতা। এই ক্ষমতার একটি নমুনা তাঁরা দেখিয়েছিলেন ২০১৩ সালে ঢাকার মতিঝিলে, শাপলা চত্বরে। শেখ হাসিনা যেভাবেই হোক, একরকম সমঝোতা করে তাঁদের আপাতত ‘নিউট্রালাইজ’ করতে পেরেছেন। এটি তাঁর রাজনৈতিক পারঙ্গমতার প্রমাণ।
কিন্তু মহাজোটের কোলের মধ্যে বসে আছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আওয়ামী লীগ সব সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে। ইতিহাস কিন্তু বলে অন্য কথা। অসমসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মঞ্জুর হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একাত্তর সালে কর্মরত এরশাদ। তাঁর একসময়ের প্রধানমন্ত্রী এবং শুরু ও শেষের দিকে আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী এরশাদ সম্পর্কে একটি তথ্য ফাঁস করেছিলেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল, তৎকালীন লে. কর্নেল এরশাদ ছিলেন তার চেয়ারম্যান। তো এ রকম একজন মহাজন ব্যক্তি মহাজোটে আলো ছড়াচ্ছেন। ১৯৯৬ সালে দায়ের করা মঞ্জুর হত্যা মামলাটি এখনো বিচারাধীন, নিষ্পত্তি হয়নি ২২ বছরেও। রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে এক সপ্তাহের মধ্যেই মামলাটির মীমাংসা হয়। এটি শিগগিরই হচ্ছে না। কেননা, এরশাদ হলেন মহাজোটের তুরুপের তাস, যেমনটি হলো বিএনপির জন্য জামায়াত। বিএনপি ভালো করেই জানে, জামায়াতকে ছাড়া নির্বাচনের পুলসিরাত পার হওয়া অসম্ভব। আওয়ামী লীগও বুঝে গেছে, মুশকিল আসান করে দেবেন এরশাদ তথা তাঁর জাতীয় পার্টি।
তারপরও স্বস্তিতে নেই কেউ। বিএনপি এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে দল ভারী করেছে। আওয়ামী লীগও ‘যেখানে দেখিবে ছাই, কুড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার মানিক রতন’-এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বিকল্পধারাকে আঁচলে বেঁধেছে। বিপরীত মেরুর মানুষদের নিয়ে নতুন এই মেরুকরণ এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। শেষমেশ কিন্তু নজর থাকবে জামায়াত আর এরশাদের দিকেই। নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে তারা যে নিয়ামক হতে পারে, এটি অতীতেও দেখা গেছে।
আদর্শ-ফাদর্শ-এসব হলো ছেঁদো কথা। লক্ষ্য হাসিলের জন্য যে কাউকেই সঙ্গী হিসেবে নেওয়া চলে। ইংরেজিতে বলা হয়, ইন পলিটিকস, ইউ স্লিপ উইথ স্ট্রেঞ্জ বেড-ফেলোজ-টুডে উইথ ওয়ান, টুমরো উইথ সামবডি এল্স।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক