ক্রাইমবার্তা ঢাকা:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রার্থীদের অভিযোগ যেন থামছে না। বলা যায়- হামলা, মামলা ও হয়রানির শিকার ভুক্তভোগীদের অভিযোগের স্তূপ এখন পাহাড়ে রূপ নিচ্ছে।
তবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্টভাবে পরিসংখ্যান জানাতে পারেননি। তাদের মতে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে এ পর্যন্ত চার শতাধিক অভিযোগ ইসি সচিবালয়ে এসেছে।
এ ছাড়া প্রতিটি জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতরে জমা পড়া অভিযোগের সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বেশি। ইসিতে জমা পড়া অভিযোগের সিংহভাগই নির্বাচনী প্রচারে বাধা, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা এবং পুলিশ ও জনপ্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। অভিযোগকারীদের বেশিরভাগই বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, স্বতন্ত্র ও সরকারবিরোধী মতের প্রার্থী। অভিযোগকারীর তালিকায় আছেন সরকারি দল আওয়ামী লীগের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী। আছেন সরকারি কর্মকর্তারাও। ইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এর বাইরে বিপুলসংখ্যক অভিযোগ জমা পড়লেও সব আমলে নিচ্ছে না ইসি। অভিযোগকারী ও অভিযোগের ধরন বুঝে বাছাই করা কিছু কিছু অভিযোগ আমলে নেয়া হচ্ছে। আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন সংক্রান্ত ৫০টির বেশি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। ৩৪টির ঘটনায় তদন্ত কমিটি ইসির কাছে প্রতিবেদন পাঠালেও সেখানে কারও বিরুদ্ধে অপরাধের সুনির্দিষ্ট তথ্য ও সাজার সুপারিশ করেনি। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়া হলেও এর মধ্যে মাত্র ১৪ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে বিএনপিসহ কয়েকটি দল ও প্রার্থীর অভিযোগের বিষয়ে কমিশন সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সেগুলো ‘আইনানুগ’ ও ‘প্রয়োজনীয়’ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের চিঠি দিয়ে দায় সেরেছে।
ঢাকা, নোয়াখালী, যশোর, বি-বাড়িয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন আসনে সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়া বেশ কয়েকজন ওসিকে এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি। এসব অভিযোগের তালিকায় পুলিশ ও জনপ্রশাসনের আরও কয়েকজন বিতর্কিত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের জোর অনুরোধ জানানো হয়।
কিন্তু সবই যেন ফাইলবন্দি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, যেসব অভিযোগ আমলে না নিলেই নয়, এমন বিষয়ে কঠোর হচ্ছে ইসি। এটি ইসির মুখরক্ষার পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়। তারা বলেন, চোখের সামনেই অনেক অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ লক্ষ করছেন কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, কতগুলো অভিযোগ এসেছে তার পরিসংখ্যান করি নাই। তবে অভিযোগের মেরিট বিবেচনা ও ধারণাবিশেষে আমরা অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছি। কিছু অভিযোগ পুলিশের আইজি, কিছু ডিআইজি, কিছু রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ সুপার ও নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে পাঠিয়েছি। পাশাপাশি টেলিফোন করেও এসব অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানিয়েছি।
কোনো অভিযোগই পেন্ডিং রাখি না। তবে নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে সব অভিযোগই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন।
বৃহস্পতিবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, ইসিতে যেসব অভিযোগ জমা পড়ছে সেগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত অ্যাকশনে যাওয়া উচিত। এতে নির্বাচনী পরিবেশ ভালো থাকবে। তিনি বলেন, প্রশাসন ও পুলিশের কারও বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ পাওয়া গেলে এবং ওই অভিযোগের সত্যতা থাকলে তাকে সরিয়ে দেয়া এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, অভিযোগের ৯০ শতাংশই সিইসি ও ইসি সচিব বরাবর পাঠানো হয়। অপসারণসহ অভিযোগের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তা আবেদনপত্রের ওপর নির্দেশনা দিয়ে দেন। ওই নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি আরও জানান, নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ পাঠানো হলেও সেগুলোর সত্যতা পাচ্ছে না প্রায় সব কমিটি। কয়েকটি কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা উঠে এলেও সেগুলোকে ফৌজদারি অপরাধ উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেয়ার ভার পুলিশের ওপর ছেড়ে দিচ্ছে। এসব কারণে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। আর পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে, প্রায় সব ক্ষেত্রে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ অভিযোগের প্রমাণ মিলছে না।
যত অভিযোগ : ইসি সূত্রে জানা গেছে, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার ও থানার ওসির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে প্রায় দু’শ অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও স্বতন্ত্রসহ কয়েকটি দলের প্রার্থী রয়েছেন।
এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নোয়াখালী-৫ আসনের প্রার্থী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এক অভিযোগে ওই আসনের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ করেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তাদেরকে বদলি করতে কমিশনে আবেদন করেন তিনি। অপরদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার টিএম মোজাহিদুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুব আলম খানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুল ওদুদ। এতে তিনি ওই কর্মকর্তাদের অন্যত্র বদলির আবেদন করেছেন। পুলিশের এ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি মু. খুরশিদ আলম (বাচ্চু)।
আরও জানা গেছে, যশোর-৪ আসনের বিএনপির প্রার্থী টিএস আইয়ুব এক অভিযোগে বাঘারপাড়ার ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তার নির্বাচনী এলাকার অনেক নেতাকর্মীকে গায়েবি মামলায় গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ওসি। এ থানার ওসিকে বদলির আবেদন করেছেন তিনি। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মো. শফিকুল ইসলাম শফি। অভিযোগে তিনি ওসিকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর অভিযোগ এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের প্রতিবেদনের আলোকে এ পর্যন্ত অন্তত ৮ জন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর মধ্যে অভিযোগের কারণে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ কমিশনার ও তিনজন ওসি রয়েছেন। এ ছাড়া পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতিবেদনের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার ওসি, রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রতিবেদনের আলোকে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার ওসি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিবেদনের আলোকে রংপুরের মিঠাপুকুর থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য কারণে খুলনার পুলিশ কমিশনারকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে ইসি।
প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের যত অভিযোগ : আরও জানা গেছে, গত ১০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব নিয়ে ইসিতে দু’শর বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে।
এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক অভিযোগ তদন্ত করতে পুলিশ সুপার ও নির্বাচনী তদন্ত কমিটিকে নির্দেশনা দিয়েছে কমিশন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিশন ব্যবস্থা নিতে বলেছে।
অভিযোগকারীদের মধ্যে রয়েছেন- নীলফামারী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, নোয়াখালীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিএনপি প্রার্থী মোহাম্মদ ফজলুল আজিম, একই দলের কক্সবাজারের মো. সরোয়ার কামাল, ঢাকা-১০ আসনের আবদুল মান্নান, গাজীপুর-৪ আসনের শাহ রিয়াজুল হান্নান, ঢাকা-৯ আসনের আফরোজা আব্বাস, ঢাকা-১৯ আসনের দেওয়ান মো. সালাহউদ্দিন ও সাতক্ষীরা-১ আসনের সাবেক এমপি মো. হাবিবুল ইসলাম হাবিব। এসব অভিযোগে প্রার্থীর ওপর হামলা ও গুলি, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, নির্বাচনী প্রচারে বাধা এবং নেতাকর্মীদের মারধর করার অভিযোগ আনা হয়েছে।অপরদিকে আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রতিপক্ষ বিএনপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে ঢাকা-৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবের হোসেন চৌধুরীর পক্ষে তার প্রধান সমন্বয়কারী আবদুল মান্নান সিইসির কাছে অভিযোগ করেছেন। এতে তিনি প্রতিপক্ষ আফরোজা আব্বাসের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রচার চালানোর অভিযোগ আনেন।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, এসব অভিযোগের মধ্যে অর্ধশতাধিক অভিযোগ রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার ও নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা জানান, এ নির্বাচনে সারা দেশে ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটি কাজ করছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩৪টি ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এসেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এসব প্রতিবেদনে কাউকে দায়ী করা হয়নি। তবে কয়েকটি সহিংস ঘটনার সত্যতা পেলেও সেগুলোকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে সুপারিশ করার এখতিয়ার রয়েছে নির্বাচনী তদন্ত কমিটির।